একশিঙা গন্ডারের রাজ্য জলদাপাড়া ভ্রমণ

জলদাপাড়া অভয়ারণ্যে প্রবেশপথে চোখে পড়লো ‘দ্যা রাইনোল্যান্ড’ খ্যাত পাথরের সাইনবোর্ড খোদাই করা ফটক। ২০১২ সালে জলদাপাড়া বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের নামকরণ হয় জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান। পূর্ব হিমালয়ের ভূটান পাহাড়ের গা ঘেসে পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলায় অবস্থিত এজাতীয় উদ্যানটি। ২১৬ বর্গ কি:মি: বিস্তৃত জলদাপাড়ার খ্যাতি লুপ্ত প্রায় এক শৃঙ্গী গন্ডারের জন্য। মালঙ্গী, হলং, বুড়িবসরা, কালিঝোড়া সহ পূর্ণেন্দ্র পত্রীর কবিতায় যুবতী তোর্সা নদী এই অরণ্যের মধ্য দিয়ে বয়ে গিয়েছে।

অনেক বছর আগের কথা, ২০০৩ সালে রোদ্র খরতাপে তপ্ত মে মাসের একদিন – নেপাল সীমান্তবর্তী মিরিকের পাহাড়ী লেকে ঘুরে প্রায় মধ্যবেলায় শিলিগুড়িতে পৌঁছাই। ব্রীজের পাশে হোটেল ‘স্নোভিউ’তে ফ্রেস হয়ে দুপুরের খাবারের খোঁজে পেয়ে যাই বাসস্ট্যান্ডের পাশের একটি ভোজনশালা। গরম গরম আলু পরাটা, সয়াবিন আর গরম চা খেয়ে তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ডের পশ্চিমবাংলার রাজ্য পরিবহনের একটি বাসে চড়ে বসি। বাসস্ট্যান্ডের যাওয়ার পথে মাঝ বয়সী রিক্স্রাচালকের কাছে জানতে পারি নকশাল বাড়ীর কিংবদন্তী সিপিএম নেতা চারু মজুমদারের বাড়ী আশে পাশেই। শিলিগুড়ির তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যনড থেকে জয়গাঁর বাসে মাদারীহাটের জলদাপাড়া অরণ্যে যেতে সময় লাগবে প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা থেকে চার ঘন্টা।

জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের সামনে বাস যখন থামলো তখন বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা। দীর্ঘ পথ কুচবিহার, জলপাইগুড়ির ডুয়ার্সের চা বাগান পেরিয়ে এসেছি। তোর্সা নদীর তীরে অবস্থিত এই অভয়ারণ্যের সামগ্রিক আয়তন ১৪১ বর্গ কিলোমিটার। । জলদাপাড়া মূলত নদীকেন্দ্রিক বনাঞ্চলময় একটি সুবিস্তৃত তৃণভূমি। জীব ও উদ্ভিদের বৈচিত্রময় সমাবেশ এ অভয়ারণ্যে। এগুলির মধ্যে অবলুপ্তপ্রায় একশৃঙ্গ গণ্ডার বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এইসব প্রাণী ও উদ্ভিদ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ১৯৪১ সালে জলদাপাড়া একটি অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়।

বিশাল আয়তনের সে বিখ্যাত ডুয়ার্স চা-বাগান পেরিয়ে জলদাপাড়া। বাংলা সাহিত্যের অনেক কথা সাহিত্যিকের লেখার পটভূমি নকশালবাড়ী, আঙরাভাসা নদী, ডুয়ার্সের চা বাগানে জীবনচিত্র। বিশেষত সমরেশ মজুমদার, সুনীল গাঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা পড়ে এসব জায়গা ভ্রমণে মনে হয় চারপাশ অনেক চেনাশুনা আর দেখা।

জলদাপাড়া অভয়ারণ্যে নদীর নামে নাম বনবাংলো হলং অতিথিশালায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো। তথ্যকেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত রমেন্দ্র দের সঙ্গে আলাপচারিতা হলো। বাংলাদেশের বন বিভাগে সুন্দরবনে কাজ করেছি তাই কিছুটা বাড়তি আপ্যায়ন। চারপাশে জঙ্গলের মাঝখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে ছোট ছোট কয়েকটা কটেজ। হলং বাংলো কাঠের মাচার উপর। দশ বারোটা সিড়ি ভেঙে কটেজে উঠতে হয়। প্রথমে কয়েকটা ছোট বারান্দা। পরিপাটি বাথরুম, সুন্দর পরিচ্ছন্ন বিছানা, অরণ্যের ভেতরেও নাগরিক সুবিধা। রাতের আলো অন্ধকারে মনে মনে সত্যাজিৎ রায়ের অরণ্যের দিনরাত্রিতে যেন বসবাস। তবে খাবার খেয়ে বিছানায় গা লাগানোর সাথে সাথেই লম্বা বাস জার্নির ক্লান্তি বুঝতে না বুঝতেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙলো খুব সকালে চেনা অচেনা নানা পাখির ডাকে। যেন পাখির স্বর্গরাজ্য – টিয়া, ময়ূর, চিল, বাজ, বক, ধনেশ সহ আরও কতো নাম না জানা পাখি। এখন থেকে ৫৬ বছর আগে ১৯৫৪ সলে জলদাপাড়া বন কে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষনা করা হয়। আর এখন ও তো অভয়ারণ্য- বিভিন্ন জীবজন্তু আর পশুপাখির। একটা ছোট চিড়িয়াখানা রয়েছে অফিসের সাথেই। সেখানে এ অরণ্যে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রজাতির পরিসংখ্যান পাওয়া গেলো।

আসামের কাজিরাঙা জাতীয় উদ্যানের পর ভারতে এই অভয়ারণ্যেই সর্বাধিক সংখ্যক গন্ডারের দেখা মেলে। এই অভয়ারণ্যে বসবাসকারী অন্যান্য বন্যপ্রাণীগুলি হল বেঙ্গল টাইগার, হাতি, সম্বর হরিণ, মায়া হরিণ, চিতল হরিণ, হগ ডিয়ার, বুনো শুয়োর ও গৌর। জলদাপাড়া পক্ষীদর্শকদের কাছে স্বর্গরাজ্য। ভারতের যে অল্প কয়েকটি অঞ্চলে বেঙ্গল ফ্লোরিক্যান দেখা যায়, তার মধ্যে জলদাপাড়া অন্যতম। এখানে দেখা যায় এমন অন্যান্য পাখিগুলি হল ক্রেস্টেড ইগল, পালাস’স ফিশিং ইগল ও শিরকা। এছাড়া দেখা যায় বনমোরগ, ময়ুর, তোতা, বেঙ্গল ফ্লোরিক্যান, লেসার পেইড হর্নবিল প্রভৃতি।

এখানে সরীসৃপের ভেতরে আছে অজগর, গিরগিটি, ক্রেট, কোবরা, গুই সাপ, গিকোস ও মিষ্টি জলে বসবাসকারী কচ্ছপের আটটি প্রজাতি।

১৫ জুন থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়কাল বাদে বছরের অন্যান্য সময় জলদাপাড়া অভয়ারণ্য পর্যটকদের জন্য খোলা থাকে। অক্টোবর-মে মাসে, বিশেষত মার্চ-এপ্রিল মাসে বনে নতুন ঘাস গজায়।

জলদাপাড়া অরণ্যে এলিফ্যান্ট সাফারির ব্যবস্থা আছে। জঙ্গলে সাফারী হয় দুটো ট্রিপে। সকালে আর বিকালে। প্রতি হাতিতে চারজন পর্যটক বক্সারে সাফারী করতে পারে। যেন ধীর গতির গজগামিনীতে অরণ্য দর্শন। হাতির পিঠে চড়ে জঙ্গলের গভীরে যাওয়া যায় এবং বন ও তৃণভূমিতে গন্ডার, হাতির পাল ও অন্যান্য জীবজন্তুর বন্যজীবন প্রত্যক্ষ করা যায়। এলিফ্যান্ট সাফারি ছাড়াও বনে কার সাফারিও করা যায়।

একটু আতংক কাজ করে চিতাবাঘের কথা মনে হলেই। কাজীরাঙা বন থেকে কেবল ভ্রমন শেষ করে আসা এক বৃদ্ধ অরণ্যচারী দম্পতির সাথে দেখা হয়ে যায়। এ বনে হরিণ, হাতির দেখা মেলে সহজেই। পরিদর্শন টাওয়ারে উঠে দূরের দৃষ্টিতে আবছা ভাবে নজরে এলো বিখ্যাত একশিঙা ভয়ংকর রাইনো । আমাদের ট্যুর গাইড বীনা, সবকিছুই যেন তার চোখে আগে ধরা পড়ে। চলাচলের পথে গন্ডারের জন্য মাটিতে ছোট গর্তে লবন রাখা, পাশেই ছোট একটা নদী। পাহাড়ী নদীর স্বচ্ছ কাঁচের মত টলটলে পানি। নীচে পাথরের নুড়ি, খুঁদে রঙ – বেরঙের মাছের মেলা।

রোদ পড়তেই এই অভয়ারণ্যের পোষা হাতিরা সারাদিন মুক্ত জঙ্গলে ঘাস-লতা-পাতা খেয়ে ফিরে আসছে। পাশের নদীতে কয়েকটা হাতি স্নান করছে আমাদের উপেক্ষা করেই।

সাফারী শেষে এবার কটেজে। শুধু খাবারের জন্য নিচে নামতে হয়; চাইলে উপরেও খাবার মেলে। নিরব নিস্তব্ধ রহস্য ঘেরা অরণ্যে এক রাত্রি দুই দিন পাড় করে এবার জয়গাঁ যাওয়ার পালা। প্রকৃতির নিরব নিস্তব্ধতায় আর বনের বন্য মায়ায় মনে হলো ট্যুরের পরিকল্পনাটা বুঝি ভুলই ছিলো। অন্য কোথাও না যেয়ে শুধু পশু-পাখির কাকলীতে নিঃসর্গে কয়েকদিন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সবুজে হারিয়ে গেলে মন্দ হতো না। আর কিছু না হোক তাতে অন্ততপক্ষে নিজেকে খুঁজে পাওয়া যেতো।

অবশেষে মনে মনে ভাবি, আবারও ফিরবো অরণ্যে, নিজেকে সঁপে দিবো অরণ্যের দিনরাত্রিতে।

কিভাবে যাবেন

শিলিগুড়ির তেনজিং নোরগে বাসষ্ট্যান্ড থেকে জয়গাঁর বাসে মাদারিহাট । মাদারিহাট বাসষ্টপের সামনেই জলদাপাড়া অরণ্যের প্রবেশদ্বার ।

কোথায় থাকবেন

জলদাপাড়া অরণ্যের মধ্যে বিলাসবহুল হলং বাংলো অথবা ভুটানের প্রবেশদ্বার জয়গাঁয় রয়েছে নানা মানের হোটেল।

সতর্কতা:

ছবির মতো সুন্দর আরন্য- জলদাপাড়া অভয়ারণ্য । অনেক প্রানীর বিচরণক্ষেত্র এ অরণ্য। দায়িত্বশীল পর্যটক হয়ে বনের উদ্ভিদ-প্রাণী আর প্রাকৃতিক নিসর্গের সৌন্দর্য উপভোপ করতে হবে ।পরিচ্ছন্ন বনটি কোনোভাবে অপরিচ্ছন্ন করা উচিত হবে না।

Source: Marzia Lipi ‎<Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment