
কার্তিকপুর জমিদার বাড়ি শরীয়তপুর ভ্রমণ
কার্তিকপুরের ইতিহাস ঘেটে যা পেলাম, মোগলদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী কেদার রায়ের চতুর্থ ও শেষ যুদ্ধের নবম দিবসে কেদার রায় আহত অবস্থায় মোগলদের কাছে বন্দী হন, পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করেন। বিক্রমপুরের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখতে কেদার রায়ের স্ত্রী মহারাণীর নেতৃত্বে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন রঘুনন্দন রায়, শেখ কালু, কালিদাস ঢালীর বাহিনী।
একসময় মানসিংহ মোগল আনুগত্যের শর্ত দিয়ে চুক্তিপত্রের প্রস্তাব দিলে মহারানী তা গ্রহণ করে নেন। যতদিন কেদার মহিশী বেঁচেছিলেন তিনিই সমগ্র বিক্রমপুরের জমিদারি দেখভাল করতেন। তার মৃত্যুর পরে কেদার বাহিনীর সেনাপতিদের মাঝে বিক্রমপুর অঞ্চল ভাগ করে দেয়া হয়। বিক্রমপুরের জমিদারি দেয়া হয় রঘুনন্দন রায় চৌধুরীকে, কমলশরন ও শেখ কালুকে দেয়া হয় কার্তিকপুরের জমিদারি, দেওভোগ ও মুলপাড়ার জমিদারি দেয়া হয় কালিদাস ঢালী ও রামরাজা সর্দারকে এবং পরবর্তীতে ইদিলপুরের জমিদারি দেয়া হয় রঘুনন্দন গুহ চৌধুরীকে।
মোঘলদের অন্যতম সেনাপতি ফতেহ্ মুহাম্মদ নামে এক বীর সেনানী কেদার রায়ের প্রধান সেনাপতি শেখ কালুর একমাত্র কন্যাকে বিবাহ করে কার্তিকপুরেই থেকে যান। আর ফতে মোহাম্মদ-এর পরবর্তী বংশধররাই হচ্ছেন কার্তিকপুরের জমিদার পরিবার। এই জমিদার পরিবারের সাথে পরবর্তীতে আত্মীয়তার সম্পর্ক হয় বোয়ালমারী উপজেলার জাহাপুরের হযরত শাহ বন্দে আলী (র.), ঢাকার নবাব খাজা আহসান উল্লাহ ও নবাব খাজা সলিমুল্লাহ, করটিয়ার জমিদার ওয়াজেদ আলী খাঁন পন্নী, বগুড়ার নবাব আলতাব আলী ও ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়াতুল্লাহ্’র পরবর্তী বংশধরদের সাথে। সেই সূত্রে দানবীর নবাব স্যার সলিমুল্লাহ্ আমাদের শরীয়তপুরের মেয়ের জামাই, যার সবচেয়ে বড় সহায়তা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি দান।
কার্তিকপুর নামকরণের ইতিহাস পড়তে গিয়ে
জান যায় এই অঞ্চলের প্রাচীন নাম ছিল ভাটিতা, ভাটি এলাকা হতে ভাটিতা নামের উৎপত্তি। পঞ্চম শতক পর্যন্ত এই এলাকার নাম ছিল ভাটিতা। পরবর্তীতে লক্ষণ সেনের পৌত্র কার্তিক সেনের নামানুসারে এটি কার্তিকপুর নামে নামায়িত হয়।
ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের পর কার্তিক সেন এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। প্রবাদ আছে রাম ও ভদ্র নামে কার্তিক সেনের দুই ছেলে ছিল। তাদের নামানুসারে এলাকাটির গুরুত্বপূর্ণ অংশের নাম রামভদ্রপুর রাখা হয় যা বর্তমানে রামভদ্রপুর ইউনিয়ন হিসেবে ভেদরগঞ্জ উপজেলার আওতাধীন রয়েছে, আর কার্তিকপুর গ্রামের কিয়দংশ এই চৌধুরী বাড়ি রয়েছে ডিঙ্গামানিক ইউনিয়নের আওতায় নড়িয়া উপজেলায়। শ্রীযোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত ‘বিক্রমপুরের ইতিহাস’ বইতে উল্লেখ করেছেন ষোড়শ শতকে বিপ্লবী কেদার রায়ের গুরু গোসাজ্ঞী ভট্টাচার্যের পুত্র রামভদ্রের নামানুসারে একটি অঞ্চলের নাম রামভদ্রপুর নামায়িত হয়। এটি সেই অঞ্চলও হয়ে থাকতে পারে।
এরপরে আমরা আবার ছুটলাম আমাদের মূল গন্তব্যের দিকে। কার্তিকপুর উচ্চবিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে জমিদারবাড়ির ঘাটায়। এরপেছনেই জমিদারবাড়ি, মূল সড়ক থেকে জমিদারবাড়ির মূল ফটকের দূরত্ব হবে ৮০মিটার কিন্তু সেখানে যাওয়ার মতো সুন্দর রাস্তা এখন আর নেই, উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠ টপকেই যেতে হয়। এখানের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ১৮৯৯সালের প্রতিষ্ঠিত।
আমরা এগুলাম সামনে…
মূল ফটকটি আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তবে কোন লেখা আর বুঝার উপায় নেই। এরপরে প্রাসাদ পর্যন্ত যেতে সড়কের দুপাশে ৮ থেকে ১০ফিটের উঁচু বেশকিছু কারুকাজ করা মিনার ছিল যার বেশিরভাগ এখন ধ্বংসপ্রায়।
৪০০বছরের পুরনো দুইতলার বাড়িটি দেখেই যে কারও প্রাণ জুড়াবে। অসম্ভব সুন্দর কারুকাজ করা বাড়ির নকশা যেন আধুনিক বাড়িগুলোর বৈচিত্রকেও ছাড়িয়ে যায়।
খুব অবহেলা আর অযত্নে পড়ে আছে বাড়িটি, তবে মূল বাড়িটির প্রধান দরজায় শরীয়তউল্লাহ্’র নামে একটি সংগঠনের সাইনবোর্ড দেখা গেলো। সম্ভবত বাচ্চাদের পড়ানো হয়। বাহির থেকে ছাঁদে ওঠার সিঁড়ি তালা দেয়া নোটিশ সেটে দেয়া আছে “অপরিচিতদের ছাঁদে ওঠা নিষেধ”। প্রাসাদের ডানদিকে একটি খালি ভিটে আছে পাকা করা ভিটেটি দেখলেই বুঝা যায় এখানে কিছু একটা করার পরিকল্পনা ছিল সম্ভবত আর করা হয়নি। প্রাসাদের বাম পাশের সম্মুখে কিছু পুরনো কবরস্থানে দেখলাম নিয়মিত দোয়া দুরুদ হয়। পাশের পুরনো জরাজীর্ণ ভবনে সম্ভবত কিছু অস্থায়ী লোক বসবাস করেন।
প্রাসাদের পেছনের অংশে দেখা গেলো ছাঁদের অতিরিক্ত সিলিঙে ঝুলছে অসংখ্য কবুতরের বাসা, কবুতরের গান বাজছে, খড়কুটো ছড়িয়ে আছে মাটিতে।
ভবনটি ধ্বসে পড়ার আশংকায় লোহার পাত দিয়ে সাপোর্ট দেয়া হয়েছে।
আমাদের অযত্ন অবহেলায় চিরঅপরাধী করে না জানি কবে ধ্বসে যায় এই প্রাসাদ।
ইতিহাস ঐতিহ্যের এই পথ, প্রাসাদ, প্রাঙ্গণ আমার বেশ চেনা, বেশ পরিচিত মনে হলো।
এছাড়াও এখানে জমিদারদের নির্মিত আরও বেশকিছু পুরাতন স্থাপনা আছে যার অনুসন্ধান হবে অন্য কোনদিন। বেঁচে থাকুক প্রিয় প্রাচীনেরা।
#যেভাবে_আসবেন: স্থানটিতে শরীয়তপুর সদর থেকে বাসে এলে ভেদরগঞ্জ বাজারে এসে অটোরিকশা নিতে হবে। ঢাকা থেকে মাওয়া, মাঝির ঘাট হয়ে আসা খুবই সহজ, লঞ্চে মাঝির ঘাট নেমে নড়িয়া ভেদরগঞ্জের বাসে উঠে বসলেই হলো কার্তিকপুর জমিদারবাড়ির পাশ দিয়েই বাস যায় আপনাকে জায়গামতো নামিয়ে দেবে। আরও সহজ পদ্ধতি রয়েছে যারা সদরঘাট থেকে লঞ্চে আসতে চান, সকালবেলা উঠে যাবেন সুরেশ্বরগামী লঞ্চে, দুপুর ১টার দিকে লঞ্চ পৌঁছে যাবে সুরেশ্বর ঘাটে, সেখান থেকে অটোরিকশা নেবেন ভাড়া পড়বে ২০০টাকার মতো।
#বিদ্রঃ পুরো ভ্রমণে কোনোখানেই অপচনশীল দ্রব্য এদিক-সেদিক ফেলে পরিবেশ দূষিত করবেন না। আপনি একটা জায়গা ঘুরে আসার পথে দরকার হলে জায়গাটা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য পরিষ্কার করে দিয়ে অাসুন, কোনোভাবেই নোংরা করবেন না।
Source: Nahedi Mannan Hamidi<Travelers of Bangladesh (ToB)