ছুটির দিনের ভ্রমণ কথা

কর্মব্যস্ত জীবনে ছুটির দিন ছাড়া নিজেদের পরিচিত গণ্ডির বাইরে বের হওয়ার কল্পনা করার আগে গায়ে কম্পজ্বর আসে। তো জীবনে বেকার দিন হাত গোনা কয়টাই বা পাওয়া যায়? এমনই বেকার দিন পেয়েছিলাম গত বুধবার। হাতের কাজ সেরে যখন এই চিন্তা করছিলাম আজকে তাড়াতাড়ি বাসায় যাব ফোন পেলাম জুয়েল রানার৷ ভাই কোথায়? ফ্রি থাকলে আসেন দেখা করি। রানা ভাইকে আসতে বললাম পুরান ঢাকার কিং ঈসমাইল ভাইয়ের দোকানে। কতদিন সুখ দুঃখের প্যাচাল পাড়ি না, কতদিন ট্রাবল করি না।

ঠিক বিকাল ৪ ঘটিকায় ঈসমাইল ভাইয়ের দোকানে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম জুয়েল ভাই টিপাটিপি করছে। প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, অশ্লীল কিছু ভাবার আগেই বলে নেই উনি ফ্রি সময়ে টিওবি’র (ট্র্যাভেলার অফ বাংলাদেশ) ঝাড়ুদারের কাজ করে। মোবাইল তার ঝাড়ুদারির হাতিয়ার। আধা ঘণ্টা সুখ দুঃখের প্যাচাল পাড়ার পর রানা ভাই কহিলেন, চলেন ভাই এনসার আলীর খুদের ভাকা খেয়ে আসি।

যেই বলা সেই কাজ। কিং ঈসমাইল ভাইকে নিয়ে রওনা হলাম সোয়ারী ঘাটের পথে। পুরান ঢাকার চিপা গলি, অলিগলির ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি। রাস্তা কেটে সব সুয়েজ খাল৷ রিক্সার দাম্ভিকতায় গরীব ট্রাভেলারদের অন্তর কুহু কুহু কাঁদে। আজ গরীব বলে রিক্সায় চড়তে পারলুম না। পুরান ঢাকার কিং ঈসমাইল ভাই না থাকলে যে কী হতো। সোয়ারী ঘাট আসতে আসতে সাড়ে পাঁচটার কাছাকাছি বেজে গেল৷

ঘাটে এসে দেখতে পারলাম বি.আই.ডব্লিউ.টি এর ওয়াটার বাস গাবতলির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাচ্ছে। কোনো কিছু চিন্তা না করে উঠে পড়লাম দৈন্যতার প্রতীক ওয়াটার বাসে। আমরা নেমে যাব খোলামোড়া। ওয়াটার বাস ধীর লয়ে চলছে আর আমরা উপভোগ করছি বর্ষার বুড়িগঙ্গা। ভরা বর্ষায় যেন যৌবনের রানী সেজেছে আমাদের প্রিয় বুড়িগঙ্গা। যে বুড়িগঙ্গার পাড়ে এক সময় ঢাকা শহর গড়ে উঠেছিল সেই বুড়িগঙ্গা আমাদের অবহেলায় বড় অভিমানী।

বাবা বলতো এক সময় এই বুড়িগঙ্গার পানি ছিল গাঢ় নীল৷ এত পরিষ্কার ছিল তার পানি। সেই রূপের খানিকটা ছটা আমরা বর্ষা আসলে দেখতে পাই৷ তাই বুড়িগঙ্গা আমাদের পুরান ঢাকাবাসীর জন্য বর্ষা রানী। ওয়াটার বাসে বসিয়া দেখিতে লাগিলাম মায়াবী জলের খেলা। কখনও সে নীল, কখনও সে টারকুইশ, কখনও বা সে ঘোলা। আহা বুড়িগঙ্গা, তোমার কী রূপ! টেইলর সাহেব কী এই রূপ দেখিয়া বলেছিলেন, বর্ষাকালে যখন বুড়িগঙ্গা পানিতে ভরপুর থাকে তখন দূর থেকে ঢাকাকে দেখায় ভেনিসের মতো?

বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্য বাড়ানোর কাজ করেছিলেন বাংলার সুবাদার মুকাররম খাঁ। তার আমলে নদীর পাড়ের অংশে আলোকসজ্জা করা হতো, নৌকার মাঝিরা জ্বালাত ফানুস বাতি। তাই দূর থেকে ঢাকাকে ভেনিস নগরীর সাথে তুলনা করে টেইলর সাহেব কোনো পাপ করেননি। কালের বির্বতনে নদীর ঐতিহ্য আর সৌন্দর্য বন্দী হয়ে গেছে ইতিহাসের পাতায়৷ বর্ষাকালে ইতিহাসের সামান্য ঝলক দেখায় বুড়িগঙ্গা। নীল আকাশের মেঘের মেলায় চড়েছি জলের ভেলা ভাসিয়ে। ঝিরিঝিরি বাতাসে, মিহি রোদের ছোঁয়ায় নদীর পাড়ের ভাসমান জীবন দেখতে দেখতে নস্টালজিক যাত্রার শেষে এসে পৌঁছালাম খোলামোড়া।

গল্পের শুরুতে বলেছিলাম দৈন্যতার প্রতীক আমাদের ওয়াটার বাস সার্ভিস। রাজধানীর সদরঘাট-গাবতলী নৌপথে ওয়াটার বাস সার্ভিস হবার কথা ছিল মানুষের ভরসার প্রতীক। সেখানে দুর্নীতির ঘুনপোকা জেঁকে বসেছে ওয়াটার বাস সার্ভিসে। ভাসতে গিয়ে ডোবার পথে ওয়াটার বাস। দেখার কেউ নেই, বলার কেউ নেই। এই রুটে এত যাত্রীর চাপ থাকতেও কবির নীরবতা ঘোর সন্দেহের উদ্রেক করে। দুইটি ওয়াটার বাস দিয়ে যাত্রীদের সাথে করছে ভয়ংকর রসিকতা। ভ্রমণে শুধু সৌন্দর্য উপভোগ করলে চলে না। মাঝে মাঝে তুলে ধরতে হয় দেশের কথা, দশের কথা।

পাঠক আপনাদের বিরক্ত না করে সদা ভিউ পেয়ে যাওয়া ঈসমাইল ভাইকে নিয়ে দু’টি কথা বলতে চাই৷ সোজা সরল পুরান ঢাকাইয়া কুট্টি মানুষটার অন্তর বিরিয়ানির মতোই বিশাল। উনি ভ্রমণ পোকার সাথে ছবি পোকাও বটে। যে কোনো জায়গায় গেলে উনি ভিউ পেয়ে যান। খোলামোড়া লঞ্চ টার্মিনাল নেমে আমরা সেই ভিউয়ের ঠেলায় তুলে ফেললাম কিছু ট্রাভেলিং ফটোগ্রাফি। নীল বুড়িগঙ্গার পানি দেখলে এই ট্রাভেলিং সমাজ বিশ্বাস করবে না বিধায় ছবি ব্লার করে টাংগুয়ার হাওর বলে চালিয়ে দেবার কুটবুদ্ধিখানা ভেস্তে গেল নদী পাড়ের বেরসিক বিল্ডিংয়ের কারণে। এবার টার্মিনাল থেকে বের হলাম।

টার্মিনাল থেকে বের হয়ে খানিকটা বাঁয়ে গিয়ে সিএনজি রিজার্ভ করতে গিয়ে আবার কম্প জ্বর উঠলো। ২০০ টাকার দমকে উড়ে গেলাম আরেকটু সামনে। উঠে পড়লাম ব্যাটারি চালিত অটো এবং নসিমনের হাইব্রিড ভার্সনের অদ্ভুতুড়ে এক যানে। সামনের অংশ টেম্পুর আদলে পিছে যাত্রী মাথার ছাউনি নেই। এর মধ্যে ভুড়িয়াল তিনটা মানুষ বসেছে অনেক কষ্টেসৃষ্টে চেপেচুপে। চলা শুরু করল অদ্ভুতুড়ে যান। শেষ বিকেলের মাতাল হাওয়ায় আমার মনে এক অদ্ভুত বোধ জাগে। হতাম যদি ভুবন চিল। অভিমানী কিছু গল্প নিয়ে উড়াতাম আকাশের ওই মায়াভোলা নীলে।

চারপাশে সবুজের সমাহার সেই নস্টালজিয়ার ডাক আরও তীব্র করে। কোণাখোলা নেমে আমরা এবার উঠে বসলাম ব্যাটারী চালিত রিক্সায়। সড়কে বাস-ট্রাকের চাপে তিনজন আরোহী নিয়ে দুরন্ত বেগে ছুটে চলছে সালাম চেয়ারের মোড়। সূর্যটা ডুবে যাচ্ছে। ডাক দিচ্ছে এক নির্জন সন্ধ্যার। সূর্যের সোনালী লাল আভার এই ছবি তুলতে জুয়েল রানা নেমে পড়লো রিক্সা থেকে। আমি চুপচাপ চেয়ে রইলাম আকাশ পানে। হারিয়ে গেছি আমি শেষ বিকেলের সূর্য ডোবা অন্ধকারের এই অমানিশায়। মুগ্ধতা মানেই আকাশ। আর এই আকাশলীনা প্রেমিকা সর্বদা জড়িয়ে রাখে আমায় মেঘের চাদরে। মনে পড়ে যায় জীবনানন্দের কবিতা-
সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,
বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে ;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা :
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে ;
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে ;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার ;
দূর থেকে দূরে—আরো দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়ো নাকো আর।
কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে !
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ :
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।
সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাস :
বাতাসের ওপারে বাতাস—
আকাশের ওপারে আকাশ।
প্রেম পর্ব শেষ হতে হতে পৌঁছে গেলাম এনসার আলী ভাইয়ের দোকানে। ততক্ষণে ঝুপ করে নেমে এসেছে সন্ধ্যা। সন্ধ্যার এই আসর মাতিয়ে রেখেছে এনসার আলীর বিখ্যাত খুদের ভাকা। চার-পাঁচ পদের ভর্তা আর সাথে কড়া লাল করে ভাজা ডিম। আহা! জীবনে আর কী চাই? কানা ভাই (রানার সাথে কানার অনেক মিল বলিয়া প্রেমের সহিত মাঝে মাঝে আমি তাহারে এহেন দুষ্টু নামে সম্বোধন করিয়া থাকি। লেখক নিজেও কানাবাবা, নো হার্ড ফিলিংস) এই প্রথম চেখে দেখলো এনসার আলীর খুদের ভাকা। এক কথায় তোফা স্বাদ।

এনসার আলী ভাইকে নিয়ে তো কিছু বলার নেই। সাইকেলিস্ট ভাইদের প্রচারণায় উনি আজ সার্মথ্যবান একজন সুখী মানুষ৷ তবে এবার খুদের ভাকা প্লেট প্রতি বাড়াইয়া ৪৫ টাকা করিয়াছেন। এরপর কাস্টমারের কমতি নাই। সুখী মানুষরা নাকি শেষ বিকালে হাটে, সন্ধ্যার আকাশ উপভোগ করে। তাই সুখী মানুষটাকে ফোন করে আনাতে হলো। কত বছর পর দেখা। সুখ দুঃখের প্যাচাল শেষে এবার বিদায়ের পালা। ফিরে যাই সুরঞ্জনা নিজ নীড়ে, নিজ মানুষের ভীড়ে। আবার হইবে দেখা বাংলার কোনো এক প্রান্তে।

বিঃদ্রঃ বেকার ভাইরা, ছাত্র সমাজ, ছ্যাকা খাওয়া প্রেমিকের দল যারা অর্থের অভাবে ঘুরতে পারিতেছেন না, খুব সহজেই ১৩৫ টাকা খরচে দেখে আসুন গ্রাম বাংলার রূপ আর পেটের জ্বালা মিটান খুদের ভাকা দিয়ে। সোয়ারী ঘাট থেকে ১০ টাকায় লঞ্চ বা ওয়াটার বাসে বুড়িগঙ্গার রূপ দেখতে দেখতে চলে আসুন খোলামোড়া। খোলামোড়া থেকে পার পারসন ১০ টাকা ভাড়া দিয়ে কোণাখোলা। কোণাখোলা থেকে রিজার্ভ রিক্সা ৫০ টাকা। এক রিক্সায় দুজন মানে ২৫ করে পড়ছে।

একবারে হোটেল সোহানায় নামিয়ে দেবে। এরপর এনসার আলী ভাইয়ের খুদের ভাকা ৪৫ টাকা। আসার সময় একইভাবে ফিরে আসুন। তবে মাথায় রাখবেন সোয়ারী ঘাট যাবার শেষ লঞ্চ ছাড়ে রাত ৮টায়। এরপর কিন্তু সাঁতরিয়ে সোয়ারী ঘাট আসতে হবে। তবে পুরান ঢাকার সোয়ারী ঘাটে ঢাকার কোন প্রান্ত থেকে আসবেন আর কত খরচ হবে এই ব্যাপারে কবি কিছু জানে না।

বিঃদ্রঃ বর্ষা আসলে পুরান গল্প মাঝে মাঝে নতুন মোড়কে বলতে ভাল লাগে। গল্প গুলো রয়ে যাবে, থাকবে না মানুষ গুলো। তাই বর্ষার শেষ সময়টুকু এসে পড়ুন প্রাণের বুড়িগঙ্গার পাড়ে।
Source: Ashik Sarwar‎ < Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment