
জুমারিং ও র্যাপ্লিং
শীতের শুরুতে ঝিরিতে পানি বেশ কম। সহস্রধারা ঝর্ণার উপরে উঠে বুঝতে পারলাম পানি কম হলেও ঠাণ্ডার প্রকোপ বেশ বেশী হবে কারণ পানি বেশ ঠাণ্ডা। ইকুইপমেন্টগুলো পরিচিত ছিল তাই ম্যাকানিজমে কোনো গণ্ডগোল বাঁধেনি বলেই র্যাপ্লিং শুরু করার সময় বেশী লাগেনি। এর আগে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন দুইজন প্রথমেই নামার জন্য নির্বাচিত হয়ে দড়ির সাথে ফিগার অফ এইট যুক্ত করলেন।
ঝর্ণার দিকে যতই এগুচ্ছেন ওনারা, আমার বুকের মধ্যে ডিপ ডিপ শব্দ যেন ততই বেড়ে চলেছে। নাদিয়া আপু ঝর্ণার অংশটা দিয়ে নামছিলেন আর বেশ কয়েকবার পিছলে গেলেন। ভয় বাড়ছিলো। পা ফসকে একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই চোখের সামনে যা ঘটবে তা কল্পনারও বাইরে ছিল।

নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে আছি। ফস করে একটা শব্দ হলো, নাদিয়া আপুকে দেখলাম না আর চোখের সামনে। ভয় পেয়ে চিৎকার দিতেই দেখলাম দড়ি সামলে একটু পরে উঠে এসেছেন আপু। ভয় বাড়ছিলো প্রতি মুহুর্তে। মাটি থেকে ১১০ ফুট উপরে দড়িতে ঝুলছে নাদিয়া আপু। ওদিকে তমাল ভাই বেশ স্বাচ্ছন্দে ঝর্ণার পাশ দিয়ে নামছিলেন।
একটু শান্ত হয়ে আবার আস্তে আস্তে লাইনে এসে নামতে শুরু করলেন সবাই। এবার মন একটু শান্ত হলো। ক্রমেই ভয় কেটে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর নিচে থেকে সিগন্যাল আসল দুজনেই ভালোমতো নামতে পেরেছেন। খুশীতে সব ভয় চলে গেলো। ভাইয়াকে বললাম প্রথম ৫ জন নামার পরই আমি নামতে চাই। আমার আত্মবিশ্বাস দেখে ভাইয়া আর না করলেন না।

নিচে থেকে হার্নেস আসার পর আমি হার্নেস পরে ক্যারাবিনার সেট করে নিলাম। ঝর্ণার পাশের জায়গাটা দিয়েই নামতে চাইছিলাম কারণ পিচ্ছিল রাস্তা দেখে ভয় করছিল বেশী, আর একদম ভিজে যেতে ইচ্ছে করছিলো না। মাহি ভাইয়া ভাল করে হার্নেস টাইট করা শিখিয়ে দিলেন। নিজেই ফিগার অফ এইট রোপের সাথে যুক্ত করে ঝুলে পড়লাম রোপের সাথে।
নিচের দিকে তাকিয়ে মনে হলো বিশাল দূরত্ব। যেখানে শেখার সময় অনেকেই ছোট বা অল্প উচ্চতার জায়গায় শুরু করেন, সেখানে আমরা ১১০ ফিট মানে প্রায় ১১ তলা উচ্চতার একটা বিল্ডিংয়ের সমান উচ্চতা থেকে নামছিলাম। নিজের উপর আস্থা রেখে নামতে শুরু করলাম নিচের দিকে।

ডান হাতে পেছনের রোপ ধরে রাখা। এই হাতের গ্রিপের মধ্যেই আসলে থাকে নিজের সেফটি আর রোপ লক করার টেকনিক। মুঠো আলগা করে আড়াআড়ি শুয়ে পড়লাম। রোপ ঢিলা হচ্ছে আমি নিচের দিকে নামছি। ডান হাতের গ্রিপ একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই যে সোজা গিয়ে পাহরের বোল্ডারের উপর পড়ব, সেটা মাথায় রেখেই সেফটি লক করছিলাম মাঝে মাঝে।
অনেকেই দেখলাম সেফটি রোপ হিসেবে অতিরিক্ত একটা রোপ ব্যবহার করেছেন, আমি সেটা ছাড়াই নামার চেষ্টা করছি তাই ভুল করা চলবে না। মাঝামাঝি চলে আসতেই বুঝলাম আমার নামার টেকনিকে একটু ভুল আছে। সোজা হয়ে ছোট ছোট লাফ দিলে আরেকটু দ্রুত নামতে পারব। সেটাই করলাম। প্রথম লাফে বেশ খানিকটা নিচে নেমে এলাম। ভয়ের জায়গাটাতে এখন আনন্দ লাগছে।

কয়েক লাফ দিয়ে একদম নিচে চলে আসলাম। শেষের পথটুকু একটু বেশী সতর্ক থাকতে হয়। চলে এসেছি ভেবে হেলাফেলা করলেও সেটা জীবন নেবার জন্য যথেষ্ট। পিচ্ছিল দেয়ালে পা আটকানো বেশ কষ্টকর মনে হচ্ছিলো। সাবধানে নিজের গতি কমিয়ে এনে নিচের বোল্ডারের উপর পা রাখলাম। প্রথমবারের মতো এরকম আনন্দ আমি খুব কম পেয়েছি। এর পর ধীরে ধীরে সবাইকে নামতে দেখলাম।
সর্বশেষ মাহি ভাইয়া নেমে এলেন। দুপুরের খাবার হিসেবে কিছু শুকনো খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম। সকলে মিলে সেগুলো খেয়ে নিলাম। আবার জুমারিং প্র্যাকটিসের পালা। নামার পর ওঠার ব্যাপারটা খুবই উচ্ছ্বাসের। যেহেতু হাতে সময় ছিল না ও র্যাপ্লিং করেই অনেকের অবস্থা কাহিল সেহেতু আমরা ৬ জন জুমারিংয়ের জন্য হার্নেস পরে নিলাম।

প্রাথমিক লেসন হিসেবে প্রথমেই শেখানো হলো টার্মিনোলজি। জুমারিং করে পাহাড়ের উপরের দিকে ওঠার জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে জুমার নামের যন্ত্রটি, স্লিং, একটি বিলে ডিভাইস, ক্যারাবিনার আর হার্নেস। এগুলো যথাযথভাবে সেট করার পর জুমার ও বিলে ডিভাইসকে রোপের সাথে যুক্ত করেই ওঠা শুরুর করা যায়।
পর্বত আরোহনের জন্য এই শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। কারণ ঢালের পরিমাণ বেশী হলেই সাধারণত জুমারিং করে উপরের দিকে ওঠা শুরু করতে হয়। ঝর্ণার শীতল পানির মধ্যে ভিজে ভিজে আমরা জুমারিং এর কৌশলগুলো আয়ত্ব করতে শুরু করলাম।

র্যাপ্লিং যতটা সহজ, জুমারিং ততটাই কঠিন ও কষ্টের। পায়ের উপর অতি মাত্রায় চাপ পড়ে যখন পায়ের উপর ভর দিয়ে উপরের দিকে ওঠার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু স্ট্যাটিক রোপের উপর জুমারিং করে উপরের দিকে ওঠার অন্য রকম একটা আনন্দ আছে। এক এক করে সবাই করতে শুরু করলাম।
টার্মিনোলজি অনুযায়ী করলে বেশ সহজেই করা যায়। জুমারিং শেষ হতে না হতেই দিনের আলো কমতে শুরু করল। ঝর্ণার পাশেই আমাদের জন্য নৌকা বাধা ছিল। ড্যাম প্রকল্পের বিশাল লেকের মধ্যে দিয়ে শেষ বিকেলে চারপাশের পাহাড় দেখতে দেখতে নৌকায় বসে গান শোনা একটি মধুর বিকেল হিসেবে থেকে যাবে মনের ভেতর।
রুট ও খরচের খসড়া:
ঢাকা থেকে বাসে বা ট্রেনে করে চলে আসতে হবে চট্টগ্রামের মীরসরাই এই ছোট দারগার হাট। ট্রেনে আসলেসীতাকুন্ড স্টেশনে নেমে চলে আসতে হবে এখানে। এখান থেকে ৫০ টাকার ভেতর নাস্তা হয়ে যাবে। দরকারী সরঞ্জাম নিয়ে রিজার্ভ সি.এন.জি ভাড়া পড়বে ১২০ টাকা। সি.এন.জি নামিয়ে দিলে সেখান থেকে হেঁটে বা জনপ্রতি ৪০ টাকা নৌকা ভাড়া দিয়ে সোজা চলে আসা যাবে সহস্রধারা ঝর্ণায়।