নাগাল্যান্ড ভ্রমণ ও জুকু ভ্যালি ট্রেক
সেই তখন থেকেই নাগাল্যান্ড ভ্রমণের সুপ্ত ইচ্ছাটা মনের ভেতর দানা বাঁধতে শুরু করে। নেটের বিভিন্ন সাইট, ব্লগ আর টিওবি তথ্যভাণ্ডারের সাহায্য নিয়ে সাজানো ট্যুর প্ল্যান নিয়ে গত ৫ সেপ্টেম্বর আমরা রওনা হয়ে যাই নাগাল্যান্ডের পথে। ভিসায় ডাউকি পোর্ট থাকায় আমাদের প্রাথমিক গন্তব্য হয় সিলেটের তামাবিল। ঢাকা-সিলেট (৪৭০ টাকা) ৬ ঘণ্টার এবং সিলেট-তামাবিল (৬০ টাকা) ঘণ্টা দুয়েকের জার্নি শেষে আমরা পৌঁছাই তামাবিলে। বর্ডার পাড় হয়ে ডাউকি বাজার পর্যন্ত মিনিট বিশের রাস্তাটুকু হেঁটেই চলে যাই। বাজারে টাকাকে রুপিতে বদলে নিয়ে উঠে পরি শিলংগামী ট্যাক্সিতে। ৪ সিটের ট্যাক্সি রিসার্ভ ভাড়া ১৫০০ রুপি। ডাউকি-শিলং এর রাস্তার দুপাশের অসম্ভব সুন্দর ভিউ আর মেঘের ছোঁওয়ায় সিক্ত হয়ে ঘণ্টা তিনেকের ভেতর আমরা পৌঁছে যাই শিলং।
শিলং এর এঞ্জেলি মোড় থেকে গাড়ি বদলে উঠে যাই গোহাটির গাড়িতে। মাথাপিছু ৪০০ রুপির ট্যাক্সিতে আসামের রাজধানীতে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় ৪ ঘণ্টা। ট্যাক্সিতে করে সরাসরি রেলস্টেশনে নেমে প্রথমেই টিকিট কেনার পালা। ১৬৫ রুপিতে নাগাল্যান্ড এক্সপ্রেসের স্লিপার ক্লাসের টিকিট কেটে আজকের দিনে প্রথমবারের মত পেটে দানাপানি চালানের জায়গা খুজতে বের হলাম। ষ্টেশন থেকে বের হয়ে রাতের(+দুপুরের) খাওয়া শেষ করে স্টেশনে এসে গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে নিলাম সবাই। ট্রেন চলে আসলো তার নির্ধারিত সময়ে। স্লিপার ক্লাসের বিছানায় শান্তির ঘুম শেষে ভোরবেলা আমরা পৌঁছে গেলাম ডিমাপুর। ট্রেন থেকে নেমেই প্রথমে প্ল্যাটফর্মের প্রায় শেষ প্রান্তে থাকা পুলিশ ষ্টেশনে গিয়ে অনুমতি নিয়ে নেওয়ার পালাটা চুকিয়ে ফেললাম। তারপর আস্তে ধীরে ফ্রেশ হয়ে ষ্টেশন থেকে বের হয়ে আবার ট্যাক্সি নেওয়ার পালা। এবারের গন্তব্য নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমা। মাথাপিছু ৩০০ রুপির ট্যাক্সি নিয়ে ছুটে চলা কোহিমার পথে। তবে ডিমাপুর-কোহিমা মহাসড়কের উন্নয়ন কাজ যেকারো ধৈর্যেরই ভালো একটা পরীক্ষা নিয়ে নেবে। ধৈর্য পরীক্ষার ৫ ঘণ্টায় উত্তীর্ণ হয়ে অবশেষে আমরা পৌঁছলাম কোহিমায়। কোহিমায় নেমে প্রথমেই আমরা চলে যাই ওয়ার সিমেট্রিতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শহীদদের সমাহিত করা হয়েছে এখানে। মেঘে ঢাকা সিমেট্রির বাইরের প্রাঙ্গণ থেকে পুরো শহরের বেশ সুন্দর ভিউ পাওয়া যায়।
সেখানে কিছু সময় কাটিয়ে আমরা রওনা হই বিসসেমার উদ্দেশ্যে (রিসার্ভ ১৫০০ রুপি)। পথে গাড়ি থামিয়ে সেরে নেওয়া হয় লাঞ্চ পর্ব। বিসসেমা গ্রাম পর্যন্ত ভালো রাস্তা থাকলেও গ্রাম থেকে ড্রপিং পয়েন্টের ৮ কিমি রাস্তা পাথুরে। শেষ ৮ কিমি এর সংগ্রামের পর আমরা যখন গাড়ি থেকে নামলাম তখন বিকাল ৪টা। গাড়ি যেখানে নামিয়ে দেয় সেখান থেকেই শুরু হয় খাড়া পাহাড়ের সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাওয়া রাস্তা। ঘন গাছ-গাছালিতে ছাওয়া বনের মাঝ দিয়ে উঠে যাওয়া এই রাস্তা ধরে ঘণ্টা খানেক এগোলেই ভিউ পয়েন্ট। পাহাড়ে অতিদ্রুত সন্ধ্যা নেমে আসে আর সেই সাথে মেঘেরাও গুটি সুটি মেরে আশ্রয় নিতে থাকে পাহাড়ের কোলে। তাই ভিউ পয়েন্টে আমরা যখন পৌঁছলাম তখন মেঘেদের সারির অবস্থান আমাদের থেকেও অনেক নিচে। ভিউ পয়েন্টে কিছুটা সময় বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটা শুরুর পালা তবে এবারের রাস্তা আগের মত খাড়া নয়, একেবারে সমতল। পাহাড়ের গায়ে জড়ানো পায়ে চলা রাস্তা দিয়ে আরও ঘণ্টা দেড়েকের পথ পাড়ি দিলে তবেই ডর্ম। এই রাস্তায় থাকা অবস্থায়ই চারপাশ রাঙ্গানো গোধূলির শেষ আলোটুকু বিদায় নিয়ে আমাদের সঙ্গী হল শরতের এক ফালি চাঁদ। চাঁদের আলোয় ট্রেকের শেষ রাস্তাটুকু পাড়ি দেওয়ার স্মৃতিটা এখনো কেমন যেন মোহের মত মনে হয়। সন্ধ্যা সারে ৭টার দিকে আমরা পৌঁছলাম ভ্যালির ডর্মে। টানা প্রায় ৩০ ঘণ্টার যাত্রা আর ঘণ্টা ৩ এর ট্রেক করে প্রথমবারের মত বিছানার সান্নিধ্য। ডর্মের গরম ধোঁওয়া ওঠা ভাত, সবজি আর ডাল দিয়ে ভরপেট ডিনার শেষে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম আমরা।
পরদিন বেশ ভোরে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় দাঁড়াতেই আমাদের চোখ কপালে ওঠার পালা, ভ্যালির দুপাশের পাহাড়ের কোলে মেঘেদের হুটোপুটি খেলা দেখে। এরকম একটা সকাল হ্যামকে দোল খেতে খেতে অনায়াসেই পার করে দেয়া যায় কিন্তু আমাদের হাতে সময় কম। তাই ফ্রেশ হয়েই আমরা ধরলাম মূল ভ্যালিতে নামার রাস্তা। গতদিনের মতোই পাহাড়ের গা বেয়ে হালকা ঢালু রাস্তা নেমে গেছে ভ্যালির দিকে। হাঁটুসমান উচ্চতার গুল্মের পাতায় জমে থাকা শিশিরকে নিজেদের শরীরে মেখে প্রায় ৪০ মিনিট পর আমরা নামলাম মূল ভ্যালিতে। ভ্যালিতে নেমেই আমরা উপলব্ধি করতে পারলাম কেন একে তুলনা করা হয় স্বর্গের সাথে। ভ্যালির চারপাশে ঢেউ খেলানো পাহাড়, মেঘের দলের অবিশ্রান্ত লুকোচুরি, পাহাড়ি ফুলে ছেয়ে থাকা প্রান্তর, তারই মাঝ দিয়ে ছুটে চলা স্রোতস্বিনী, মেঘেদের ছিঁচকাঁদুনে স্বভাবে তৈরি হওয়া খেয়ালী রঙধনু সবকিছু মিলিয়ে যেন অপার্থিব এক জগত। সেই ঘোর লাগানো জগতে ঘণ্টা দুয়েক পাড়ি দিয়ে আমাদের ফিরতি পথ ধরার পালা।
ডর্ম থেকে ব্যাগবোঁচকা বেঁধে নাস্তা শেষ করে আবার ফিরে চলা কোহিমার পথে। তবে আজকে ফেরার রাস্তা আলাদা। ফেরার পথে জাখামাও আমাদের জন্য বিস্ময় কিছু কম রাখেনি। গতদিনের তুলনায় ফেরার এই রাস্তা ছিল অনেক বেশি লম্বা এবং খাড়া। তবে এখানকার পারফেক্ট আবহাওয়া সেটাকে প্যারার বদলে করে তুলেছে আরও উপভোগ্য। প্রায় ঘণ্টা চারেকের পথ পাড়ি দিয়ে আমরা নামতে পারলাম পাহাড়ের সিঁড়ি থেকে তবে মূল সড়ক পর্যন্ত যেতে হাঁটতে হল আরও প্রায় ১ ঘণ্টা। সেখান থেকে কোহিমার ট্যাক্সি নিয়ে আমাদের ফিরতি পথে রওনার শুরু (রিসার্ভ ৬০০ টাকা) । তবে পথেই পরল নাগা হেরিটেজ ভিলেজ। ট্যাক্সিতে বাড়তি ১০০ টাকা ওয়েটিং চার্জ দিয়ে সেটাও ঘুরে দেখার পালা। এই গ্রামে নাগাল্যান্ডের সব উপজাতির কৃষ্টি এবং সংস্কৃতির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংস্করণ সাজানো রয়েছে। ডিসেম্বর মাসের ১-১০ তারিখে প্রতিবছর এখানে হয় হর্নবিল ফেস্টিভ্যাল। উৎসবমুখর এই পরিবেশের সাক্ষী হতে তখন দেশবিদেশের বহু পর্যটক ছুটে আসে এখানে। ভিলেজের ১ ঘণ্টা ঘোরা শেষে আবার ট্যাক্সিতে ওঠা। ছুটে চলা ফিরতি পথে। আবারো সেই লম্বা যাত্রা। তবে এবারের সঙ্গী হিসাবে বয়ে নিয়ে যাওয়া অভূতপূর্ব সুন্দর নাগাল্যান্ডের স্মৃতি। বেঁচে থাকলে হয়তো আবারো ছুটে আসতে হবে এই সৌন্দর্যের টানে।
আমাদের ট্যুরের সদস্য ৪ জন, মাথাপিছু খরচঃ ৯,০০০ টাকা।
বিঃদ্রঃ সময়, সুযোগ এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় যেখানেই ঘুরতে যাননা কেন, কোন অবস্থাতেই পরিবেশ নোংরা করে নিজের ক্ষুদ্র ও নিচ মন-মানসিকতার পরিচয় দিবেন না।