নৈনিতালের রোমাঞ্চিত মনমুগ্ধকর সকালবেলা

যে কোন নতুন জায়গায় বা নতুন ভ্রমণে আমার একটা নিজস্ব চাওয়া থাকে। সেটা হলো একদম আর একদম নিজের মতো শুধু নিজের একান্ত আনন্দের জন্য কিছু একটা করা। একা একা ভ্রমণ হলে তো কথাই নেই, পুরো সময়টুকুই নিজের মতো করে কাটানো যায়। যদিও সেটা পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে তেমন কিছু সব সময় হয় না। তবে কোনো না কোনো কিছু হুট করেই করে ফেলি একদম কোনো রকম পরিকল্পনা ছাড়াই। যেমন গোমুখে হুট করেই চড়ে বসেছিলাম একটা পাথুরে পাহাড়ের চূড়ায়।

আর দলবেঁধে বা পরিবার নিয়ে গেলেও এমন একটা সময় আমি ঠিক ঠিক খুঁজে বের করি একদমই নিজের জন্য। যেমন লাদাখ ভ্রমণে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুই নদীর সঙ্গম অববাহিকার ঠিক উঁচু পাহাড় থেকে দিয়েছিলাম লাফ! ঠিক এবারও পারিবারিক ভ্রমণে নৈনিতাল গিয়ে পাহাড় ঘেরা বিস্তীর্ণ লেক দেখেই আমার চোখ চকচক করে উঠেছিল আর মন চঞ্চল হয়ে পড়েছিল। কখন আর কীভাবে আমি এই পুরো লেকটা হেঁটে হেঁটে আর ঘুরে ঘুরে দেখবো। হোক সেটা সবাই মিলে বা একদম একা একা। আমার কোনোটাতেই কোনো সমস্যা নেই। আমাকে শুধু এই লেকের চারপাশ জুড়ে একবার হেঁটে বেড়াতে হবে এটাই নিজের জন্য একান্ত চাওয়া।

তো আগের দিন নৈনিতাল পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে ঘুরে ঘুরে দেখে আর খেয়ে-দেয়ে মল রোডে বসে থেকে পাহাড়ি মধ্যরাতে রুমে ফেরা হয়েছে। যদিও এরই মধ্যে সবাইকে পরদিন সকালে পুরো লেকের চারপাশটা, পাহাড়ের গায়ে গায়ে, পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখার প্রস্তাব দিয়ে রেখেছি। কিন্তু আমি জানতাম এই অলস আর আরাম প্রিয় টিমের কাছে মৌখিক সম্মতি দেয়া যতটা সহজ ঠিক তততাই কঠিন কনকনে শীতের সকালে ডাবল লেপ আর উষ্ণ বিছানার মধ্যে থেকে নিজেদেরকে বের করে বাইরে, পাহাড়ে, লেকের পাড়ে হাঁটতে যাওয়া। তারপরেও প্রস্তাবনা তো দেয়া রইলো। কেউ গেলে ভালো আর না গেলে আরও ভালো!

বরাবরের মতোই ভ্রমণে ভাগ্য আমার বেশ সুপ্রসন্ন বলেই হয়তো অনেক রাতে ঘুমিয়েও কনকনে শীতের মধ্যেই ঘুম ভেঙে গেল খুব খুব সকালে। অবশ্যই সূর্য ওঠার অনেক আগে। ঘুম যেহেতু ভেঙেই গেছে সেহেতু বিছানায় অলস শুয়ে থেকে সময় নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। একটু সবার ঘুমের দিকে চোখ বুলিয়ে বোঝা গেল এরা কেউই এখন জাগতে পারবে না। তাই উঠে পড়লাম। গরম কাপড়, জুতা, গ্লাভস, টুপি পরে রুমের বাইরে বেলকোনিতে গিয়েই অবাক চোখে অপলক তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হলাম লেক আর পাহাড়ের দিকে। কী অপূর্ব, কী অপূর্ব আর কী যে অপূর্ব লাগছিল কীভাবে বোঝাই?

একবার ভেবে দেখুন তো যদি আপনি পাহাড় ভালোবেসে থাকেন তাহলে আপনি যেখানে দাঁড়িয়ে বা বসে আছেন তার চারদিকেই শুধু পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে গায়ে নানা রকমের রঙিন আর বর্ণীল বাড়িগুলোর রঙ ছড়ানো, কোনো কোনো পাহাড়ে বসেছে ছোট ছোট মেঘেদের দল। সাদা সাদা নরম, কোমল মেঘেদের দল উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে প্রিয় পাহাড়ের গায়ে গায়ে।

অথবা আপনি হয়তো পাহাড় ভালোবাসেন না খুব একটা। ভালোবাসেন নদী, সমুদ্র, ঝর্ণা বা টলটলে জলের স্বচ্ছ লেকের কোনো পাড় বা জলাশয়। তাহলে? তাহলেও তো আপনি তাকিয়ে থাকবেন মুগ্ধ চোখে। কারণ চারপাশের পাহাড়ের ঘিরে ধরা সমতলেই যে রয়েছে টলটলে জলের বিশাল এক ঝলমলে লেকের আহ্বান। ইচ্ছে করলেই লেকের জল ছুঁয়ে, জলে ভেসে, লেকের জলে পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি দেখেই মুগ্ধ হয়ে যেতে পারবেন।

এমন পাহাড় আর লেকের মিতালী দেখে ছেলের মাকে ডেকেই তুললাম। দারুণ মুগ্ধ চোখে দুইজনে তাকিয়ে রইলাম একজন লেকের জলের দিকে আর একজন প্রিয় পাহাড়ের বুকে। কারণ তার পছন্দ লেক, পুকুর, নদী, সমুদ্র আর ঝর্ণা। মোট কথা পাহাড়ের চেয়ে পানি তার অনেক অনেক বেশি পছন্দ। আর আমার ঠিক তার উল্টো পাহাড়। তবে যে কোনো নদী, পুকুর, সমুদ্র বা ঝর্ণাও আমার বেশ পছন্দের, ভালো লাগার আর উপভোগ করার।

তাই যেহেতু দুজনের ভালো লাগার দুই রকম প্রকৃতিই এই অভিজাত সকালে অভিজাত পাহাড়ি শহরে বিদ্যামান তাই দুজন মিলেই বেশ চুটিয়ে উপভোগ করছিলাম সে তার টলটলে জলের বিলাসী নৈনিতাল লেক আর আমি আমার প্রেয়সী পাহাড়ের রূপ। কিন্তু আমার মাথায় তো পাহাড়ে পা ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকা লেকের চারপাশ ঘুরে দেখার, হেঁটে বেড়ানোর অদম্য ইচ্ছা। সে কথা তাকে জানাতেই সে নিজেও লেকের পাড়ে হেঁটে বেড়াতে দারুণ আগ্রহ দেখালো। চলো তাহলে বেরিয়ে পড়ি? সামান্য কিছু প্রস্তুতি নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতেই দেখি এত এত ভোরে, কনকনে শীতের সকালে কেউ ঘুম থেকেই ওঠেনি আর লোহার গেটে বেশ বড় তালা ঝুলে আছে।

অনেক ডাকাডাকি করেও কাউকে খুঁজে বা জাগাতে পারলাম না। ছেলের মাকে প্রস্তাব দিলাম চলো দেয়াল টপকে লাফ দেই একটা! তিনি তো অবাক আমার পাগুলে প্রস্তাব শুনে! আমার মনে হলো কিছুটা ইচ্ছাও বোধহয় আছে এমন রোমাঞ্চের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারেনি, এই বয়সে পড়ে গিয়ে হাড়গোড় ভেঙে না আবার বিছানায় পড়ে থাকতে হয়, সেই শঙ্কায়। আর তাছাড়া ছেলে উঠে মা-বাবা দুজনকেই না দেখতে পেলে বিচ্ছিরি একটা অবস্থা হয়ে যাবে। তাই অবশেষে ছেলের মা লেকের পাড়ে হেঁটে বেড়ানোর ইচ্ছাকে নিজের মধ্যেই রেখে দিলেন।

কিন্তু আমার কী হবে? আমার পাহাড়ের পায়ে পায়ে, লেকের চারপাশে ধীরে ধীরে হেঁটে হেঁটে রোদেলা সকালে একই সাথে লেক আর পাহাড় উপভোগের কী হবে? কেন দেয়ালের উপরে উঠে লাফ দিয়ে রাস্তায় পড়ে যাওয়ার উপায় আছে না? তাহলে আর ভাবনা কী আর রুখবে আমায় কে? ছেলের মায়ের হাতে ক্যামেরা, মোবাইল দিয়ে দেয়ালের উপরে উঠে গেলাম।

তাই চারপাশের সিসি টিভি ক্যামেরা থাকা সত্ত্বেও হোটেলের দেয়ালের উপরে উঠে, ফুলের টব মাড়িয়ে, একটি লোহার গ্রিলের উপরে উঠে লাফটা দিয়েই দিলাম!

ঢাকা থেকে বাস, ট্রেন বা প্লেনে কলকাতা হয়ে, কলকাতা থেকে ট্রেন বা প্লেনে কাঠগোদাম গিয়ে এক ঘণ্টার বাস, কার বা জীপের পাহাড়ি পথে নৈনিতাল যাওয়া যায়।

Share:

Leave a Comment