পৃথিবীর অন্যতম একটি সুন্দর গ্রাম হালস্টাট

বছর দুয়েক ধরে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরে বসবাস করছি । অনেক দিন থেকেই পরিকল্পনা ছিল ইউরোপের অন্যতম ক্রেজ যাকে বলা চলে, অনেকের বর্ণনায় পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর গ্রাম হালস্টাট যাব। আমাকে দেশ থেকে বন্ধুরা প্রায়শ প্রশ্ন করতো অথবা হালস্টাটের বেশ সুন্দর সুন্দর ছবিতে ম্যানশন করে প্রশ্ন করতো কবে যাব !! অবশেষে আমারও সুযোগ হল এই সুন্দর অবলোকন করার।

হালস্টাট, আপার অস্ট্রিয়ায় অবস্থিত। সালসবুর্গ থেকে খুব কাছে। অর্থাৎ সালসবুর্গ, তিরল, এই জায়গাগুলোতে যে সকল পর্যটকরা যায় তাদের জন্য হ্যালস্টাট কিছুটা কাছের গন্তব্য।ঘন্টা দেড়েকের রাস্তা। তবে রাজধানী ভিয়েনা থেকে ট্রেন কিংবা ব্যাক্তিগত গাড়ী নিয়ে যাওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে সময় লাগবে ট্রেনে ৩ ঘন্টা ৪০ মিনিট আর গাড়িতে গুগল ম্যাপ অনুযায়ী ৩ ঘন্টা ১০ মিনিট। তবে গাড়ী নিয়ে ভোগান্তি হচ্ছে পার্কিং। অনেক সময় এক থেকে দেড় কি,মি, দূরে পার্কিং করতে হয়। আর ট্রেনে #হালস্টাট_বানহোফ স্টেশনে নামতে হবে।ট্রেনে আসা-যাওয়াতে ১১০-১২০ ইউরো খরচ হবে (এটা আসলেই একটু বেশী)।আমাদের স্টুডেন্টদের সামার কার্ড করার সুযোগ আছে যেটা দিয়ে আমরা একমাস পুরো অস্ট্রিয়ায় সে কোনো জায়গায় ট্রেনে যাতায়াত করতে পারি।হ্যালস্টাট বানহোফ স্টেশনের বিপরীত পাশেই মূলত হালস্টাট ,মাঝে বেশ সুন্দর লেক। লেক পার হবার জন্য ছোট একটা শীপ থাকে। যাওয়া আসার জন্য ভাড়া গুনতে হবে ৬ ইউরো।লেকের মাঝা মাঝিতে দাড়িয়ে আপনার কাছে মনে হবে আপনি কোনো একটি ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে আছেন। যেখানে কোনো শিল্পী বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে একটা ছবি এঁকেছেন, এবং তা থেকে চোখ সরানো যাচ্ছে না।শীপ থেকে নামলেই , একটু ভেতরের দিকে রঙ বেরঙে সাজানো রেস্তোরা দেখা মিলবে।কিছু আবার পুরানো ধাঁচের ব্যাঞ্ছ পাতা, কিছু মানুষের হাতে বড় বড় মগে বিয়ার, সাথে জমপেশ আড্ডা ।অনেক ধরণের খাবার মিলবে এখানে। তবে কোনো যায়গায় খাবারের দাম কম নয়।

গ্রামটা বেশ ছোট।পায়ে হেটে গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছাতে সময় খরছ হবে মোটে মিনেট পনেরো।রাস্তাগুলো বেশ সরু এবং পুরাতন শহরের আদলে কিন্তু পরিপাটি আর পরিষ্কার, সমস্যা হচ্ছে প্রচুর পর্যটক।শতকরা ৭০ জন মনে হয় চীনা পর্যটক। আমি বুঝি না, এরা পৃথিবীতে যত সুন্দর কিছু দেখে সেটা তারা বানিয়ে ফেলে।তারা হালস্টাটেরর আদোলে একটা কপি হ্যালস্টাট বানিয়ে ফেলেছে। তারপর আপনি যেদিকে তাকাবেন শুধু তাদেরই চোখে পড়বে।

আপনি যখন রাস্তা দিয়ে হাটবেন, সবথেকে ভাল লাগার বিষয় লক্ষ্য করবেন একদিকে হরেক রঙের বাড়ী কিংবা হোটেল পাহাড়ের কোলে একের পর এক সাজানো আর ফুলে ফুলে সুসজ্জিত অন্য দিকে লেক ভিউ। পানিতে রাজহাঁস খেলছে, ছোট ছোট নৌকায় করে কিছু মানুষ লেক থেকে গ্রামের সৌন্দ্রয্য উপভোগ করছে, বেশ দূরে আবার পাহাড়। হেটে দক্ষিণের শেষ মাথায় গেলে দেখা মিলবে একটু খোলামেলা জায়গা। যেখান থেকে লেক, গ্রাম আর পাহাড়ের মিলন মেলার অন্য রকম একটা ছবি ফুটে উঠবে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে জায়গাটার প্রেমে পড়েছি।তবে বৃষ্টি এটার জন্য একটা কারণ হতে পারে।একটা লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে আপনি বৃষ্টি দেখছেন যার চারপাশে পাহাড় আর পাহাড়ের কোলে ছোট্ট রঙ্গিন একটা গ্রাম।

গ্রামটাকে আপনি লেক থেকে দেখেছেন, দুই প্রান্ত থেকে দেখেছেন এখনতো লোভ জাগতেই পারে উপর থেকে দেখতে কেমন হবে!! সে ব্যবস্থাও আছে, এর জন্য আপনাকে কষ্ট করে ৩৫০ মিটার উপরে উঠতে হবে। দ্যা ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ স্কাইওাল্ক। হাইকিং করে উঠা সম্ভব তবে বৃষ্টি ছিল বলে আমরা হেটে উঠি নি। ক্যাবল কার দিয়ে উঠে যাওয়া যায় মিনিট পাচেকের মধ্যে। এর জন্য আপনাকে গুনতে হবে ১২ ইউরো আর যদি নামার পথে ক্যাবল কার ব্যবহার করতে চান সে ক্ষেত্রে মোট ১৮ ইউরো দিয়ে টিকেট কেটে নিতে হবে। স্টুডেন্টরা কাজটা ৯ ইউরোতে সারতে পারবে। পাঁচ মিনিটের যাত্রা অতিক্রম করে আমাদের মনে হল আমরা অন্য একটা জগতে পা রেখেছি। আমাদের চারপাশে মেঘেদের ছুটোছুটি দেখছি, ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। উপর থেকে গ্রামটাকে অর্ধ -গোলাকার দেখতে, আশেপাশের সুউচ্চ পাহাড়ের মাথাগুলো মেঘে ঢাকা। লেকে রাজহাঁসরা খেলছে, কিছু মানুষ দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট নৌকায়।

আমরা নামার সময় হেটে নেমেছি। কেননা মাঝ পথে বেশ সুন্দর একটা ঝর্ণা দেখতে পাওয়া যায় যেটা আমরা মিস করতে চাই নি … হেটে নামতে বা উঠতে খুব বেশী কষ্ট হবে না কারো । রাস্তা খুব বেশী খাড়া নয় তবে এর জন্য কিছুটা পথ বেশী হাটতে হয়। নিচে নামলেই বেশ কিছু কফি শপ আছে। আমরা নিচে নামতেই আবার বৃষ্টি হানা দেয়, এই সুযোগে আমরাও একটু কফি খেয়ে নিয়েছিলাম। বৃষ্টির সাথে চা ব্যাপারটা বেশ যায়, যাই হোক কফিও খারাপ ছিল না ।

হ্যালস্টাট বানহোফ থেকে শেষ ট্রেন ছাড়ার আধ ঘন্টা আগে গ্রাম থেকে শেষ শিপটা ছেড়ে যায়। ৫ঃ৪৫ মিনিটে শেষ শিপ যখন ছাড়বে তখন শুরু হল ঝুম বৃষ্টি। আমরাও তড়িঘড়ি করে উঠে গেলাম। মাঝ লেকে, ঝুম বৃষ্টি, আমি ডেকে দাঁড়িয়ে গ্রামের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এই সময়টা আমার কাছে মনে হল সব থেকে ভাল লাগার সময় এবং সব থেকে কষ্ট লাগার লাগারও। আপসোস হচ্ছিল যদি এখানেই থেকে যেতে পারতাম …।

কেউ চাইলে রাতের হ্যালস্টাড উপভোগ করতে পারেন। তবে হ্যালস্টাডে রাত্রি যাপন একটু ব্যয়বহুল। আগে থেকে বুকিং দিয়ে রাখলে সহজে রুম পাওয়া যাবে।সামারে রুম পাওয়াটা একটু মুশকিল ।

বি.দ্র. জায়গাটা খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, কারণ সবাই ময়লা ফেলার জায়গায় ময়লা ফেলে। আমরা যারা কম বেশি ঘুরতে পছন্দ করি, নিজ দায়িত্বে যদি ময়লা ফেলার জায়গায় ময়লা ফেলি তবে আমাদের চারপাশটা অনেক সুন্দর থাকবে।
Source: Saikat Bhuiyan‎<Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment