নিকলী হাওর, জঙ্গলবাড়ি ও গ্রাম ভ্রমন

ওহে ভ্রমণার্থীগণ, ভরবর্ষায় হাওর ও একে কেন্দ্র করে ঐতিহাসিক স্থান- গ্রাম পর্যটন থাকতে পারে ভ্রমণ তালিকার শীর্ষে। হাওর-এক দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। নদীবাহিত বিস্তীর্ণ চরাচর ভরবর্ষায় পাহাড়ি ঢলের পানিতে ফুলফেঁপে এক মায়াময় রূপ ধারণ করে। যারা দূরে সমুদ্র দেখতে যেতে পারেনি, তাদের জন্য হাওর ভ্রমণ আদর্শ। লম্বা বা সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকার কাছের কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী হাওর ভ্রমণ হতে পারে আটপৌরে নগরজীবনের স্ট্রেস কমানোর এক মোক্ষম উপায়। একদিন, দু’দিন কিংবা তিনদিনের ট্রিপে কিশোরগঞ্জ ঘুরে আসা যেতে পারে। দেশবিদেশের ভ্রমণের মধ্যে সাম্প্রতিক কিশোরগঞ্জ হাওয়ার ট্রিপ আমাদের ভ্রমণতালিকায় সফল ট্রিপ হিসাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কারণ এ জেলায় শুধু হাওর ও বিল বাওর নয়, রয়েছে বাংলার শীর্ষ বারোভুঁইয়া মসনদে আলা ঈসা খাঁর স্মৃতিবিজড়িত জঙ্গলবাড়ি দূর্গ, পঞ্চদশ শতকের কবি চন্দ্রাবতীর টেম্পল ও জন্মভিটে, এশিয়ার বৃহত্তম ঈদগাহ ময়দান শোলাকিয়া, গুরুদয়াল কলেজ পার্ক, পাগলা মসজিদ, ভরা ও কুটিয়ারদীর বিল, অষ্টগ্রাম হাওর ইত্যাদি।

ঢাকা টু নিকলী
বাস, ট্রেন ও গাড়িতে ঢাকা থেকে অনায়াসে কিশোরগঞ্জ যাওয়া যায়। ঢাকার গোলাপবাগ থেকে কিশোরগঞ্জে বাস যায়। গাড়ি ও মাইক্রোবাসে ইচ্ছেমতো যাওয়া যায়। ঢাকার কমলাপুর থেকে এগারোসিন্দুর এক্সপ্রেসে করে কিশোরগঞ্জের মানিকখালী স্টেশনে নেমে সিএনজি ভাড়া করে ১৪/১৫ কিলোমিটার দূরে নিকলীতে পৌছানো যায়। কিশোরগঞ্জ স্টেশন থেকেও নিকলীর যাওয়ার সিএনজি আছে। ঘন্টাখানেক লাগবে। ভাড়া একশ থেকে দেড়শ টাকার মধ্যে। তবে মৌসুম ও সময় ভেদে বাড়তে পারে। দামাদামি করে নেয়া ভাল। এগারোসিন্ধুর সকালে কমলাপুর থেকে ছাড়ে, বেলা এগারোটার দিকে কিশোরগঞ্জ পৌঁছে। ঢাকার গোলাপবাগ থেকে দুইশ আড়াইশ টাকায় বাসের টিকেট কেটে কিশোরগঞ্জ যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। এক্ষেত্রে কটিয়াদী নেমে সিএনজিতে পৌণে একঘন্টায় পৌঁছানো যায় নিকলী। ঢাকা থেকে কটিয়াদী সাড়ে তিনঘন্টা সময় লাগতে পারে। সদর থেকে নিকলীর দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার।

ঢাকা থেকে পূর্বাচলের পাশ দিয়ে তিনশ ফুট রাস্তা দিয়ে কিশোরগঞ্জের দিকে যাওয়ার দুটি পথ একটি ভৈরববাজার হয়ে, আরেকটি নরসিংদীর শিবপুর হয়ে। দুটো রাস্তা দিয়েই আগে কটিয়াদী পৌছাতে হয়। ঢাকা সিলেট মহাসড়কের ইটাখোলা মোড় থেকে রাস্তা দুইদিকে চলে গেছে। ডানদিকে ভৈরব বাজার হয়ে দূরত্ব দশ কিলোমিটারের মতো বেশি হলেও রাস্তার অবস্থা ভাল। এই রাস্তার অনেক জায়গায় সিএনজি পাম্প আছে, গাড়িতে তেল গ্যাস নেয়া সুবিধাজনক। আমাদের আটজনের ট্রিপটি হলিডেয়ার ট্যুর আয়োজন করেছিল কটিয়াদীর জালালপুরে অবস্থিত জালালপুর ইকো রিসোর্টকে কেন্দ্র করে। ফলে আমরা ঢাকা থেকে ভৈরব হয়ে হাইয়েস মাইক্রোবাসে কটিয়াদী পৌঁছাই। ভাড়া করা মাইক্রোবাস দৈনিক ৫হাজার টাকা চার্জ করে, তবে তাতে গ্রূপের সবাই নিজ নিজ বাসা থেকে গাড়িতে উঠতে পারে। ঢাকার খিলক্ষেত থেকে ভৈরববাজার ৭৬ কিলোমিটার, সেখান থেকে কটিয়াদী ৩৯ কিলোমিটার। ছুটির দিনে তিন থেকে সাড়ে তিনঘন্টায় কটিয়াদী পৌছানো যায়।

নিকলী উপজেলাটির একপাশে সমতল, অন্যপাশে হাওর। বেরিবাঁধ নিকলী উপজেলা সদরকে বন্যার হাত থেকে সুরক্ষা দিয়েছে। বর্ষায় নদীর পানি বাড়তে বাড়তে ভেসে যায় চরাচর এবং সাগরের সৌন্দর্য ও দৃশ্য তৈরি করে। স্বত:শ্চল বাতাসে হাওরের পানির ঢেউ বেরিবাঁধে এসে আছড়ে পড়ে। সমুদ্রদর্শনের দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে সকাল বিকাল নিকলী বেরিবাঁধে মানুষের ভিড় জমে ওঠে।

হাওরের মুখ্য মজা হচ্ছে, নৌভ্রমণ ও তাজা মাছের তরকারি দিয়ে উদরপূর্তি। নিকলী উপজেলার সব স্থাপনাকে বাঁয়ে রেখে নিকলী বাঁধ ধরে এগিয়ে যেতে থাকলে ডানদিকে দিগন্ত বিস্তৃত হাওর। দিগন্তের মাঝে মাঝে ছোপ ছোপ গ্রাম ও জনবসতি। নিকলির অপরদিকে যে জনপদটি চোখে পড়ে তার নাম ছাতিয়ার চর। বেরিবাঁধের শেষ মাথায় নৌকাঘাট। বিশটির মতো নৌকা হাওর ভ্রমণকারীদের জন্য নিবেদিত। তবে ভাড়ার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। ভ্রমণকারীদের দরাদরি ভেদে কেউ সারাদিনে একহাজার টাকায় চলে, কেউ ঘন্টায় হাজার টাকা চার্জ করে। আমরা আটজনে দেড়ঘন্টার জন্য একটি নৌকা ভাড়া নিয়ে নৌকাওলাকে ১২০০ টাকা, টাকা আর মাঝিদের বকশিশ একশ টাকা দিয়েও মূল নৌকাওলার মুখে হাসি ফোটাতে পারিনি। ভরা মৌসুম বলে নৌকা ভাড়া নাকি এখন বেশি। সারাদিনের জন্য ভাড়া নিয়ে নৌকাতে রান্না করে খাওয়ানোর ব্যবস্থাও আছে বলে জানা যায়। নিকলীর বিচ্ছিন্ন জনপদ ছাতিয়ার চরে ভ্রমণ করে এখানকার জীবনযাত্রা দেখে আসা যায়। তবে নৌকা ভাড়ার সময় ছাতিয়ার চরে যাওয়ার কথা বলে নিতে হবে। আর ঠকতে না চাইলে অনেকক্ষণ দামাদামি করতে হবে। হাওর অভিজ্ঞতার অন্যতম হচ্ছে হাওরপারের হোটেল থেকে হাওরের নানারকম তাজা মাছের তরকারি দিয়ে উদরপূর্তি। নিকলী মোড়ে অনেকগুলো মোড়ের মধ্যে সেতু হোটেলটিতে আমরা খেয়েছি। এই হোটেলের রান্না ভাল, এরা হোটেলের পিছনের বাড়িতেই রান্না করে থাকে। এখানে প্রতি মাসের দাম ৫০ থেকে ৬০ টাকা, এর সঙ্গে ভাত, ডাল আর সবজি ৩০ টাকা। এর মানে হচ্ছে একশ টাকায় মাছ ভাত, ডাল, সবজি দিয়ে ভরপেট খাওয়া যায়। তবে একাধিক মাছ নিলে তিনশ টাকার মধ্যে অনেকগুলো তাজা মাছের আস্বাদ গ্রহণ করা যায়। তবে চিকন চালের ভাত পাওয়া দুষ্কর। এরা মোটা চালের ভাত রান্না করে থাকে।

কিশোরগঞ্জ
কিশোরগঞ্জ ভ্র্রমণ করলে এখানকার কয়েকটি জিনিস অবশ্য দ্রষ্টব্য। প্রথমটি হচ্ছে পাগলা মসজিদ। এই মসজিদে মানুষজন মানত করে গরু, ছাগল, সোনা, রুপা, টাকা পয়সা দান করে। প্রতি দুই মাস পর নগত কোটি টাকার ওপরে এবং কেজির বেশি সোনাদানা জমা হয়। দানগ্রহণের জন্য মসজিদে একাধিক লোহার সিন্দুকের দানবক্স স্থাপন করা হয়েছে। এই দানবাক্স পাহারার জন্য দশজন সশস্ত্র আনসার নিয়োজিত। পাগলা মসজিদ দেখার জন্য পর্যটকরা এসে থাকেন দলে দলে। দ্বিতীয় দ্রষ্টব্য শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান। ময়দানটি খুব বড় না হলেও এই ময়দানকে ঘিরে সোয়া লাখ লোকের ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। শহরের ঐতিহ্যবাহী গুরুদয়াল কলেজের সামনের চত্ত্বরে নরসুন্দা নদী উন্নয়ন করে চমৎকার পার্ক, ওয়াচটাওয়ার বানানো হয়েছে। প্রতিদিন ভ্রমণপ্রিয় মানুষ এখানে ভিড় জমায়। এই শহরের অদূরেই ঈষা খাঁর জঙ্গলবাড়ি দূর্গ। শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে করিমগঞ্জ সড়ক দিয়ে পৌছাতে হয় জঙ্গলবাড়ি। এখানে কালের গহ্বরে বিলীয়মান ঈসা খাঁর স্মৃতিময় দূর্গের ভগ্নাবশেষ, মসজিদ, স্কুল কলেজ ও বেশ কয়েকটি কবর দেখতে পাওয়া যায়। পাশের পুকুর বা টিউবঅয়েল থেকে ওজু করে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ে ঐতিহাসিক মসজিদটিতে সিজদাচিহ্ন রেখে আসা মুসলিম পর্যটকদের জন্য মন্দ নয়। কিশোরগঞ্জ শহরের একরামপুর মোড় থেকে জঙ্গলবাড়ির কথা বলে সিএনজি বা ইজিবাইকে পৌঁছানো যায় এখানে। চারশ থেকে পাঁচশ’ টাকায় সিএনজি বা ইজিবাইক রিজার্ভ করেও এখানে যাওয়া যায়। এ জেলায় রয়েছে বাংলা ভাষার প্রাচীণ কবি চন্দ্রাবতীর মন্দির ও বাড়ি। এটিও শহর থেকে ছয়কিলোমিটার দূরত্বে। কিশোরগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্র স্টেশন রোডের শহীদি মসজিদ। এখান থেকে সংকীর্ণ একটি সড়ক দিয়ে চন্দ্রাবতী মন্দিরে যেতে হবে ইজিবাইকে চড়ে। জনপ্রতি ১৫/২০ টাকা ভাড়া। জালালপুর বাজারের কিছুটা সামনে চেয়ারম্যানের বাজারে নামিয়ে দেবে ইজিবাইক চালকরা। এখান থেকে চন্দ্রাবতীর বাড়ি যাওয়া যায় হেটে। তবে শহর থেকে অটো রিজার্ভ করেও যাওয়া যায়।

কিশোরগঞ্জ শহর ও আশপাশে আরও দর্শণীয় হচ্ছে কিশোরগঞ্জ স্টেশন ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ।

থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা
কিশোরগঞ্জ শহরে খাওয়ার জন্য স্টেশন রোডে ধানসিঁড়ি, দারুচিনি, গাঙচিল, ইস্টিকুটুম, তাজসহ নানা হোটেল আছে। হাওরের কাছে অসংখ্য হোটেল। তবে হাওরপারে তাজা মাছের তরকারি মেলে, কিশোরগঞ্জে মিলবে ফ্রিজ থেকে বের করে রান্না করা মাছের তরকারি।
শহরে থাকার জন্য উজানভাটি, ক্যাসেল সালাম, নিরালা, গাংচিল, রিভারভিউ এসব হোটেল আছে। তাতে মান খুজতে গেলে চলবে না। শহরে থাকতে হলে শহরের সংকীর্ণ রাস্তায় শত শত সিএনজি, রিকশা, ইজিবাইকের যানজট পোহাতে হয়।

আমরা আমাদের হাওর ট্রিপের সঙ্গে গ্রাম শহুরে সন্তানদের অভিজ্ঞতা দেয়ার জন্য গ্রামপর্যটনকে যুক্ত করেছিলাম। এ জন্য আমাদের থাকা খাওয়ার কেন্দ্র বানিয়েছিলাম কটিয়াদীর জালালপুর ইকো রিসোর্টকে। উপজেলা বাসস্ট্যান্ড থেকে সাড়ে তিনকিলোমিটার দূরত্বে রিসোর্টিটিতে শহুরে আয়েশে থেকে হাওর, কিশোরগঞ্জের ট্রিপ বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল। বাড়তি পাওনা হিসেবে শেখ রাসেল সেতু, পাইকানবাজার জলতরঙ্গ পার্ক ট্রিপ, গ্রামীণ জীবনযাত্রা দেখার সুযোগ পেয়েছি।
Source: Mahmud Hafiz‎ <Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment