পেলিং এর পাহাড়ি পথে

ফুট ওভার ব্রিজ থেকেই সিকিমের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডটা দেখতে পাচ্ছিলাম। ঝটপট নেমে গেলাম পথের বাঁকে বাঁকে। কিন্তু নেমে গেলাম তো গেলাম গিয়ে আর সঠিক স্ট্যান্ড কোনটা সেটা খুঁজে পাইনা, যেখান থেকে পেলিং যাওয়ার জীপ পাওয়া যাবে। কারন নেমে যেতে যেতেই আমি পথ গুলিয়ে অন্য জীপ স্ট্যান্ডে চলে গিয়েছি। কিন্তু কিভাবে সেটা সম্ভব? একটাই তো স্ট্যান্ড দেখলাম হেটে আসার সময়, তাহলে আমি অন্য স্ট্যান্ডে কিভাবে গেলাম? একজনকে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি সিঁড়ি দেখিয়ে উপরে যেতে বললেন। উপরে গিয়ে দেখি সেটাও না, তারও উপরে আরও একটা স্ট্যান্ড আছে যেখান থেকে টিকেট নিতে হয়।

উফ, এতক্ষনে বুঝলাম যে একটা পাহাড়ি শহরের তিনটা পাহাড়ের ঢাল মিলিয়ে তিনতলা ট্যাক্সি স্ট্যান্ড করা হয়েছে কিছু দেয়াল আর পাহাড়ের সাথে ছাদের মত করে তৈরি করে। যাই হোক, টিকেট করে ফেললাম পেলিং যাওয়ার জীপের। মোট ৬ জন হয়েছে আর চারজন হলেই ছেড়ে দেবে। তখন সকাল ৮ টা বাজে। ট্যাক্সি এখনই ছেড়ে যাচ্ছেনা বুঝতে পেরে পাশের চায়ের দোকান থেকে এক কাপ ফালতু চা নিলাম ১০ রুপী নষ্ট করে। (উলেখ্য এলাচ দেয়া দুধ চা আমার মেজাজ খারাপ করে দেয়!) সেটা কাটাতে আবার ১০ রুপী দিয়ে একটু ক্রিম বিস্কিট কিনে নাস্তার মত করে নিলাম।

ছয়জন ছিলাম। এরপর এক বিদেশী এলো টিকেট করে নিয়ে। ব্যাগপত্র জীপের উপরে রাখার পরে পরিচিত হলাম, তিনি স্পেন থেকে দুই মাসের জন্য ভারত আর নেপাল ঘুরতে এসেছেন। পেশায় কুক, স্কটল্যান্ডে থাকে। কিন্তু বেটার হাসি দেখে হাত মেলানোর রুচি আমার চলে গেল। তার পরেও নিরুপায় হয়ে হাতের সাথে একটু হাত ছোঁয়ালাম মাত্র। তারপর আবার নিজের হাত ধুতে হল টাকা দিয়ে কেনা পানি দিয়ে। শালা নোংরা, খচ্চর কোথাকার! মনে মনে ব্যাটাকে গালি না দিয়ে পারলামনা। কেনই বা দেবনা আপনারাই বলুন?

ব্যাটার গায়ের চামড়া যতই সাদা হোক না কেন, ওই ব্যাটা যে স্পেন বা স্কটল্যান্ড থেকে বের হবার পরে, এমনকি হতে পারে তারও অনেক অনেক আগে থেকে দাতে ব্রাস লাগায়নি সেটা ওর জঘন্য, নোংরা, ছ্যাদলা পড়ে হলুদ হয়ে যাওয়া দাত দেখেই আমার বোঝা হয়ে গেল আর সেই সাথে ওর সাথে বা কাছাকাছি না ঘেসার মত যথেষ্ট কারন ঘটে গেল। শালাকে দেখে ভাবলাম, সে ব্যাটা দাতেই মাসের পরে মাস ব্রাস ঘসেনি সে ব্যাটা নিশ্চয়ই কয়েকমাস গোসল পর্যন্ত করেনি! ছিঃ ছিঃ ছিঃ। ভাবতেই ঘেন্নায় আমার গাঁ রি রি করে উঠলো। আর আমি কিনা কাল রাতে গোসল করার পরে, এই শীতের সকালেই আবার গোসল করে তারপরে রুম থেকে বেরিয়েছি। এরপর থেকে সব সময় আমি ওর থেকে দূরে দূরে ছিলাম।

যাই হোক আর একজন হতেই ঠিক সকাল ৯ টায় জীপ ছেড়ে দিল। মনে মনে ভাবলাম যাক ১২ টার মধ্যে পৌঁছে যেতে পারবো। পথের চলাটা শুরু হয়েছিল পাহাড়ি ঢালু পথে, উপর থেকে নিচের দিকে। একটু যেতেই হাতের বাম পাশে একটা জলপ্রপাত পড়লো, বেশ অবাক হয়ে গেলাম, আরে এখানে এই শহরের মধ্যেই এমন জলপ্রপাতের দেখা, দারুণ তো! একটু পরে দেখি সামনে ঝিরঝির করে পথ ভিজিয়ে দেয়া আর একটা ঝর্ণাধারা! আরে বাপরে মজা তো! একটু পরেই দেখি পথ ভেসে যাওয়া জলের ধাঁরা কিন্তু জলপ্রপাত চোখে পড়েনি এবার। তবে বেশ বুঝতে পারলাম আশেপাশেই আছেন তিনি, কোন আড়ালে লুকিয়ে। এভাবে শহরের মধ্যে দিয়ে যেতেই ৭ থেকে ৮ টা জলপ্রপাত দেখে গুনতে শুরু করলাম।

কিন্তু এরপর ইস্ট সিকিম থেকে যখন গাড়ি এক ঘণ্টার বেশী চলে সাউথ সিকিমে প্রবেশ করলো তখন আমি ঝর্ণাধারা গুনে গুনে ক্লান্ত হয়ে শেষমেশ গোনা বন্ধ করে দিলাম। ধুর কয়টা ঝর্ণাই বা আর গোনা যায়? একটা, দুইটা, পাঁচটা, দশটা বা বিশ, পচিশটা। কিন্তু তা তো নয়, এতো অগণিত ঝর্ণাধাঁরা যেখানে শেখানে ঝরে পড়ছে, পথে, পাহাড়ে, বাড়ির দেয়ালে, গাড়িতে, গাছে আবার কখনো কখনো কোন কোন জলপ্রপাতের তেজ এতোটাই ছিল যে গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে ঢুকে ভিজিয়ে দিয়েছিল কয়েকবার!

কি অবাক একটা ব্যাপার, শীতে ভিজে যাওয়া দুঃখের সাথে না চাইতেই জলপ্রপাতের স্পর্শ পাওয়ার অনন্য অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হতেই হল। যেখানে সেখানে ঝোপঝাড়, পাহাড়, জংগল আর পথে পথে ঝর্ণাধারা দেখতে দেখতে যখন ক্লান্ত হয়ে গিয়ে আর দেখতে ভালো লাগছিলোনা, ভাবলাম একটু ঝিমটি দেই। এই কথা ভাবতে ভাবতেই গাড়ি যেন সিকিম ছেড়ে তিন বছর আগের লাদাখের ভয়াবহ খাঁদের কিনার দিয়ে যেমন চলেছিল, ঠিক তেমন পাহাড়ি খাঁদের কিনারে কিনারে চলতে শুরু করলো ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে।

গাঁ শিউরে ওঠার মত সেই পথ, শরীরের রোম খাড়া হয়ে যাওয়ার মত পাহাড়ের খাঁদ আর বাঁক। কোথাও কোথাও তো পাহাড়ের বুকের অনেকটা গভীরে কেটে কেটে তৈরি পথে দিয়ে যাবার সময় দেখতে পাচ্ছিলাম গাড়ির উপরে পাথুরে পাহাড়ের নানা আকৃতির পাথর গাড়িকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলছে। যার সাথে একটু এদিক ওদিক হয়ে গেলেই একদম কয়েক হাজার ফুট নিচের গভীর খাঁদে!

এমন পথ দেখে আর ঝিমিয়ে থাকা যায়না কিছুতেই। তাই তো সিকিমেই লাদাখের রোমাঞ্চকর পথের স্বাদ নিতে অপলক তাকিয়ে থেকে থেকে উপভোগ করেছিলাম পুরো পথটুকু গ্যাংটক থেকে পেলিং যাওয়ার পুরো ৬ ঘণ্টা। পাহাড়, ঝর্ণা, অরণ্য, আর শেষ পথটুকু, যখন ওয়েস্ট সিকিমে ঢুকে পড়েছিলাম সাউথ সিকিমের বিশাল পাহাড়ি পথের বাঁক ছাড়িয়ে তখন কিছু কাঁচা পথের অরণ্য শেষে শেষ পথটুকু ছিল দারুণ মসৃণ, বেশ প্রশস্ত, মিহি আর দুইপাশে সবুজের মুগ্ধতা মাখা, আঁকাবাঁকা আর নানা রকম ফুলের সাথে মিলাতি করা নীল আকাশের সাথে। এভাবে পেলিং পৌঁছে গিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলাম দারুণ মুগ্ধতায়, পাহাড় আর আকাশ, মেঘ আর কুয়াসার, অরণ্য আর ফুলের অন্য রকম আলাপনে।
দয়াকরে কখনো, কোথাও আমরা কেউ যেন আমাদের উচ্ছিষ্ট না ফেলি।
Source:Sajol Zahid<Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment