ভ্রমন কথা- শিলং
গুয়াহাটি হতে টাক্সি করে সিলং শহরে ক্যান্টনমেন্ট মোড়ে নামলাম। এর আগে কখনো আসিনি। সিলং সম্পর্কে যা জানা তা সব ফেসবুক / ইন্টারনেট হতে। পাহাড়ী শহর, অটো নয়, রিকসা নয়, শুধু টাক্সি চলছে। বিদেশী ছবির মত সবাই ব্যস্ত, চলনে বলনে ফিটফাট। টাক্সিতে পুলিশ বাজারে যেতে ২ মিনিট লাগলো। ভাড়া নিল ১০০ রুপি। আগে হতে হোটেল ঠিক করা ছিল না। সিলিগুড়ি, দার্জিলিং, গুয়াহাটির চেয়ে হোটেল ভাড়া অনেক বেশি। সব হোটেলে বিদেশি Allow না। অনেক খুঁজে একটা মোটামুটি মানের হোটেল পেলাম। আমি ভ্রমনে বিলাসিতা করতে ইচ্ছুক নই, যত কম খরচে বেশি দেখা যায়- এই হলো নীতি। ব্যাগ ছিল, হোটেলে যেতে ২/২.৫ মিনিটের পথ ভাড়া নিল ১৫০ রুপি। ইচ্ছে ছিল বিকেলে শহরের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখবো। সন্ধ্যা হয়ে আসায় সে প্লান বাদ দিতে হলো। সন্ধ্যায় পর্যটনের অফিসে গেলাম। ওদের বিভিন্ন প্যাকেজ আছে। বললো, বাসের সব সিট বুক আছে, কেউ Cancel করলে আমাদের দিবে। পর্যটনের বাস সার্ভিসের আশা বাদ দিলাম। সিলং এর মূল আকর্ষণ সোহরা বা চেরাপুঞ্জি। আমরা দুজন সেখানেই যাব। পরদিন সকালে পুলিশ বাজারে (এরা বলে পি.বি) চা খেতে খেতে দোকানদার (নাম নন্দ লাল) কে বললাম, সোহরা যেতে হলে কি করবো। সে বললো, সোহরাতে ৭/৮ টা itinerary বা দর্শনীয় স্থান আছে, ট্যাক্সি করে গেলে সবগুলো দেখা যাবে। নন্দ একটা ট্যাক্সি ডাকলো, ভাড়া নেবে ১৮০০/- টাকা। ড্রাইভার মুসলিম, নাম জহুরুল। সোহরার দিকে যাত্রা শুরু করলাম। শহর হতে বের হয়ে ক্যান্টনমেন্ট ও এয়ারবেজ পার হলেই ঝকঝকে পাহাড়ী উঁচুনিচু রাস্তা, দুপাশে পাইনের সবুজ সারি। বাড়ীগুলো ছোট ছোট, ছবির মত সুন্দর। সৌন্দর্যের প্রবলতায় গতকালের কষ্টের কথা ভুলে গেলাম। ড্রাইভারের বাড়ী আসাম, খুব ভদ্র ছেলে। দুপাশের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখছি আর ওর সাথে গল্প করছি। প্রথমে পেলাম Mawkdok Valley View Point. পাহাড়ের ছবিটবি তুললাম। তারপর Eco Park (Missing Falls). মেঘগুলো পাহাড়ের নিচে বাঁধা পেয়ে উপরের দিকে উঠে আসছে। অদ্ভূত সুন্দর জায়গা। সুউচ্চ পাহাড়ের উপর বিস্তৃত উপত্যকা। তারপর গেলাম MawSmai Cave. দূর্দান্ত এক গুহা, বেশ বড়। দুএকজন মাঝপথ হতে ভয়ে ফিরে আসছে। এরা শহরে ব্রয়লারের মত। আমরা গুহার ভেতরে ডুবলাম। ভেতরে ডুকে কি শান্তি! ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভব। আল্লাহ্ এর কি অনুপম সৃষ্টি। এরপর গেলাম Mot-Trop Rock. এখান হতে বাংলাদেশ দেখা যায়। আহ্, ঐ যে প্রিয় বাংলাদেশ। বৃটিশরা সব পাহাড় এ দিকে দিয়ে দিয়েছে! সত্যি ওরা বৃটিশ! বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখতে পাইনি, বুধবার বন্ধ তাই। আর রামকৃষ্ণ মিসনে আমরা ডুকিনি। বাইরে হতে view দেখলাম। তারপর Nohkalikai ও Seven Sisters Water Falls দেখে শিলং ব্যাক করলাম। বড় বড় ঝর্ণা, শীতকাল বলে এখন প্রচন্ডতা নেই। পরের দিন সকালে দেখলাম শহরের আশেপাশের কিছু পয়েন্ট। বিকেলে ডাউকি দিয়ে বর্ডার ক্রস করবো প্লান। মূল শহরেই পাহাড়ের নিচে Wards Lake. এরপর দেখলাম এলিফ্যান্ট ফলস। হাতির আকৃতির মত পাথরে ঝর্ণা পড়তো বলে বৃটিশরা এমন নাম দিয়েছিল। পরে ১৮৯৮ সালের ভূমিকম্পে সেই পাথর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমরা ডাউকি যাওয়ার পথে Living Root Bridge দেখবো বলে সময় বাঁচাতে শহরের গলফ কোর্স, যাদুঘর, চার্চ দেখা Skip করলাম। আর Umium lake (এরা বলে বড়পানি) গুয়াহাটি হতে আসার পথে দেখেছি। আমরা মূল সড়ক হতে একটু সরু সড়কে নিচে নামতে থাকলাম। আমাদের তুলনায় ইন্ডিয়ার পর্যটন অনেক পরিপক্ক। আর ওদের উপজাতি নৃগোষ্ঠীগুলো শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে নেই। মূল স্রোতের সাথেই পাল্লা দিয়ে দাপটের সাথে টিকে আছে। সিলং এ মূল জনগোষ্ঠী খাসিয়া। তারা নিজেরা বৃটিশ শাসনামলে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে, শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত হয়েছে এবং অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হয়েছে। এবার Living Root Bridge দেখতে চাই। উপর হতে প্রায় .৫ কিলো মত সিড়ি বেয়ে নিচে নামলাম। পাহাড়ী নদীর নাম Thyllong যার অর্থ পবিত্র নদী। এ নদীর দুপাশে দুটি জীবন্ত রাবার গাছের শেকড় দিয়ে তৈরী করা হয়েছে এ শিকড় ব্রীজ। গ্রামবাসীদের যাতায়াত সহজ করতে এবং প্রকৃতি কে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ১৮৪০ সনে দুটি গাছ রোপন করা হয় বলে জানা যায়। মেঘালয় ভ্রমনের মূল আকর্ষণ ই এই ব্রীজ। তারপর আমরা গেলাম Clean Village এ, নাম Mawlyngnong. এশিয়ার মধ্যে পরিছন্ন গ্রাম বলে এরা দাবী করে। পরিপাটি গ্রাম। পর্যটকেরা আসছে, ঘুরছে, এদের তৈরী জিনিসপাতি কিনছে। আমিও বাঁশ বেতের একটা ট্রে কিনলাম। আসলে পর্যটন হলো বান্ডিং, দরকার প্রচার। পরিছন্ন গ্রামের বান্ডিং করে পুরো গ্রাম পর্যটনের সর্বোচ্চ সুবিধা নিচ্ছে, নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তণ করে ফেলেছে। কিছুই না, শুধু নিজেদের সাজিয়ে গুছিয়ে উপস্থাপন করছে। এবার আমাদের যাত্রা ডাউকির পথে। সীমান্ত শহর। এর আগে বাংলাদেশ হতে ডাউকি ব্রিজ ও নদী বিস্ময় নিয়ে দেখেছি, কাছে যেতে পারিনি। এবার সুদেআসলে তুলে নেয়ার পালা। ডাউকি নদীর জল নীলাভ সবুজ, তলদেশ স্পষ্ট দেখা যায়। নৌকা ভাড়া করলাম। শীতল জল, নদীর নিচে নানা রঙের পাথর দৃশ্যমান। মাঝির কাছ হতে বৈঠা নিয়ে নিজেই নৌকা চালালাম প্রায় ৪৫ মিনিট। নদীর এ প্রান্তে বাংলাদেশ! মন ভরে নৌকা চালিয়ে ডাউকি ব্রিজ পার হয়ে টাক্সি ছেড়ে দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে যখন জিরোপয়েন্ট পার হচ্ছি, তখন সন্ধ্যা হয় হয় বিএসএফ এর একটি দল Flag Down Ceremony করছিল। এভাবেই সিলং ভ্রমন শেষ করলাম।
* প্রয়োজনীয় টিপস :
১. সিলং ভ্রমনে ৪ জন বা ৮/৯ জনের দল একত্রে গেলে সুবিধা, তাতে কার বা জীপের সব সিট ব্যবহার করা যাবে। খরচ কম হবে, আনন্দ বেশি হবে।
২. সিলং এ হোটেল পাওয়া সময়ের ব্যাপার। আগে হতে খোঁজখবর করে তবে যাবেন।
৩. অন্যান্য পাহাড়ী শহরের মতই সন্ধ্যার পর পর ই সিলং দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়।
৪. সিলং এ দেখার মত স্পট অনেক। ৩ দিনের প্লান হলে মোটামুটি সব কভার করা যায়।
৪. পর্যটন অফিস হতে দর্শনীয় স্থানগুলোর তালিকার ছবি মোবাইলে উঠিয়ে নিন। ড্রাইভার সবগুলো দেখালো কিনা মিলিয়ে নিতে পারেন।
৫. পুলিশ বাজার শহরের মূল স্থান। বিশাল মেগা স্টোর সহ অনেক দোকানপাট আছে। সেখানে কেনাকাটা করুন।
৬. সিলং নিরাপদ শহর। নির্ভয়ে ভ্রমন করতে পারেন। টাকা নিজের কাছে রাখুন।
৭. পাসপোর্ট, ছবি এবং পাসপোর্টের জেরক্স/ফটোকপি কাছে রাখুন। হোটেল সহ নানা প্রয়োজনে লাগবে।
Happy Travelling 🙂
Post Copied From: