মহেশখালি ও সোনাদিয়া দ্বীপ ভ্রমণ বিতান্ত

সোনাদিয়া ৯ বর্গকিমি এলাকার এক অনন্য সুন্দর দ্বীপ যা সাগরকেন্দ্রিক বিভিন্ন জীববৈচিত্র্যের এক আধার। মহেশখালি থেকে এই দ্বীপ একটি খাল দ্বারা বিভক্ত। দ্বীপটিতে দুটি পাড়া, পূর্বপাড়া ও পশ্চিমপাড়া। নৌকা থেকে নেমে আমরা পশ্চিমপাড়ায় যাই যেখানে স্থানীয় জসিম ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করে আগে থেকেই আমরা থাকা খাওয়ার ব্যাপারগুলো ঠিক করে নিই। উল্লেখ্য যে, সোনাদিয়া দ্বীপে থাকার বা খাওয়ার কোন হোটেলের ব্যাবস্থা নেই। এখানে থাকতে ও খেতে হলে একমাত্র স্থানীয় মানুষদের সাথে আগে থেকে বন্দোবস্ত করে নিয়েই থাকা যায়। স্থানীয় জসিম ভাইয়ের কন্টাক্ট আমরা টিওবি থেকেই সংগ্রহ করেছিলাম। খুবই অমায়িক ও অতিথিপরায়ন জসিম ভাই আমাদের জন্য খুব সুন্দর ও অল্প খরচে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। দ্বীপে পা দেয়ার পরপরই সাইকেল চালিয়ে ও হেঁটে সোজা চলে যাই সমুদ্রপাড়ে।

সোনাদিয়া ভ্রমণের আগে আমার দেখা দেশের সেরা সমুদসৈকত ছিল কুতুবদিয়া সৈকত, কিন্তু জনমানবশুন্য ও আবর্জনাবিহীন সোনাদিয়া সমুদ্র সৈকত দেখে কুতুবদিয়াকে টপকে সোনাদিয়াকেই উপরে রাখতে বাধ্য হলাম। নির্জন সৈকতের ঢেউয়ের শব্দ আর ঝাউবনের শনশন শব্দের এক অদ্ভুত মাদকতায় কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমে গেল কেউ টেরই পাইনি। জসিম ভাইয়ের ছিমছাম শান্ত বাড়ীতে গিয়ে টিউবওয়েলের ঠান্ডা পানিতে গোসল করে ধোঁয়া উঠা ভাতের সাথে ডাল, আলুভর্তা আর মুরগীর মাংস দেখে পেটের চরম ক্ষুধার কথা সবার মনে পরে গেল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগে কয়েক বাড়ী পাশেই ছোট এক দোকানে চা খেয়েই ছুটলাম খালের পাড়ের দিগন্ত বিস্তৃত সবুজেঘেরা মাঠের উদ্দেশ্যে। পড়ন্ত বিকেলে ঘাসের চাদরে বসে শুরু হল ডাবের সুমিষ্ট পানিপান।

কপাল ভাল থাকলে যা হয় আর কি, বোনাস হিসেবে পেয়ে গেলাম পূর্ণ চাঁদের আলো। সন্ধ্যা থেকে রাত প্রায় সাড়ে ৯ টা পর্যন্ত সৈকতে বসে নিজেদেরকে চাঁদের শুভ্র আলোতে স্নান করানোর সুযোগ কি আর মিস করা যায়। বর্ষার সময় বলেই তাঁবুবাস ও বারবিকিউ এর ইচ্ছা মাথা থেকে বাদ দিয়েছিলাম, নয়তো তাঁবুবাসেরও ভাল ব্যবস্থা আছে। জসিম ভাই সে ব্যবস্থাও করে দিতে পারেন। শহরের ব্যস্ততা ও কোলাহল থেকে দূরে, বৈদ্যুতিক আলো ও বাতাসের কৃত্রিমতা ফেলে প্রকৃতির খুব কাছে থেকে নিজেকে ও জীবনকে উপভোগ করার জন্য দারুন এক জায়গা সোনাদিয়া দ্বীপ। শীতের সময় আরো একবার যাওয়ার ইচ্ছা মনে পুষে রেখে পরদিন খুব ভোরে সূর্যোদয় দেখে ও গরম গরম খিচুড়ি খেয়ে আবার নৌকায় চেপে চলে বসলাম মহেশখালির উদ্দেশ্যে।

ভ্রমণসহায়ক কিছু তথ্যঃ
১) সোনাদিয়া দ্বীপে ইলেক্ট্রিসিটি নেই তাই মোবাইল চার্জের জন্য পাওয়ার ব্যাংক নেয়া আবশ্যক। নেটওয়ার্ক ৩জি পর্যন্ত পাওয়া যায়।
২) মহেশখালি ঘটিভাংগা ঘাট থেকে প্রতি সকালে জোয়ারের সময় (সকাল ১০-১১ টার দিকে) সোনাদিয়ার উদ্দেশ্যে বোট ছাড়ে, ভাড়া ৩০ টাকা প্রতিজন। আমাদের মত সাইকেলসহ পাড় হলে অবশ্য কিছু বাড়তি দিতে হবে, আমরা সাইকেল প্রতি ৩০ টাকা করে দিয়েছিলাম।
৩) সোনাদিয়ায় থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা একমাত্র স্থানীয়দের বাড়িতেই সম্ভব। তাই যাওয়ার আগে অবশ্যই যোগাযোগ করে সব বন্দোবস্ত করে যাবেন। টিওবিতে সোনাদিয়া দ্বীপ সার্চ করলেই কয়েকজনের কন্টাক্ট পেয়ে যাবেন। আমরা যোগাযোগ করেছিলাম জসিম ভাইয়ের সাথে, খুবই ভদ্র, সাহায্যকারী ও সোজা কথার মানুষ তিনি। উনার মোবাইল নাম্বারঃ ০১৮১৭৭০০২১২
৪) যেখানেই থাকেন না কেন পুরোটাই গ্রাম, তাই এমন কোন কিছু করা থেকে বিরত থাকবেন যা দেখে স্থানীয় মানুষজন বিরক্ত হয়। সবাই খুবই আন্তরিক ও সহজ সরল।
৫) আমরা চট্টগ্রাম থেকে সাইকেলে গিয়েছিলাম। যারা গাড়ীতে যেতে ইচ্ছুক তারা চট্টগ্রাম নতুন কর্ণফুলী সেতুর মোড় থেকে সানলাইন নামক গাড়ীতে সরাসরি বদরখালি জনতা বাজার পর্যন্ত যেতে পারবেন, ভাড়া পরবে ২২০ টাকা। জনতা বাজার থেকে সরাসরি সিএনজিতে চড়ে চলে যেতে পারেন আদিনাথ সড়ক বা গোরকঘাটা বাজারে (ভাড়া ১০০) যেখানে স্থানীয় হোটেলে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে রওয়ানা দিতে পারেন ৬-৭ কিমি দুরের ঘটিভাংগা ঘাটের উদ্দেশ্যে। আমরা আদিনাথ সড়কের হোটেল গ্রীন প্যালেসে উঠেছিলাম। দুইটি ডাবল বেড (৪ জন) নিয়ে এক রুমের ভাড়া পরেছিল ৫০০ টাকা, এক রাতের জন্য।
৬) সোনাদিয়ায় জসিম ভাইয়ের বাড়ীতে একরাত থাকা ও তিন বেলা খাবারের জন্য দিতে হয়েছিল জনপ্রতি ৬০০ টাকা করে। দুপুর ও রাতের মেনু ছিল ভাত, আলুভর্তা ও মুরগী আর সকালে ছিল গরম খিচুড়ির সাথে ডিমভাজা।

বিশেষ জ্ঞাতার্থেঃ
১) সোনাদিয়া দ্বীপটিতে ভ্রমণপিয়াসীদের ভীড় নেই বললেই চলে যে কারনে মানুষসৃষ্ট ময়লা আবর্জনাও নেই। দ্বীপে ভ্রমণকালে যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলে অন্যান্য সমুদ্র সৈকতগুলোর মত এই সমুদ্র সৈকতটিকেও নোংরা করা থেকে সবাই বিরত থাকব।
২) এই দ্বীপে সমুদ্রের পানিতে গোসল করতে নামলে অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত কারন কোন অঘটন ঘটলে সাথে সাথেই সাহায্য পৌঁছানো অসম্ভব কারন সৈকতে জনমানুষের আনাগোনা খুবই কম।
৩) যদিও এই দ্বীপে অবস্থানকালে কোন ট্রাভেলার এখনো পর্যন্ত কোন অপ্রীতিকর ঘটনার সন্মুখীন হননি। তবে একটু দূরে বা নির্জনস্থানের দিকে কৌতহলবশত যদি যেতেই হয় তবে অবশ্যই স্থানীয় কোন ব্যাক্তির পরামর্শ নিয়ে গেলেই ভাল হয়।
৪) এই দ্বীপটিতে একটি কচ্ছপ প্রজননকেন্দ্র রয়েছে। তাই সৈকতে অবস্থানকালে একটু সাবধানতা অবলম্বন করবেন যেন কোনভাবে আপনার গতিবিধি কচ্ছপের চলাফেরায় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

Source: Shaurav Barua <Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment