সিকিমের সন্ধ্যায় মিশ্র অনুভূতি
একটু রাগ, কিছু মান-অভিমান, অল্প ভুল বোঝাবুঝি, এইসব ছাড়া আসলে ভালবাসাটা ঠিক জমে না কেন যেন? যে কারনে একদম মুক্ত হয়ে, অফিস আর বাসা দুই যায়গা থেকেই আন্তরিক ছুটি পাওয়ার কারনেই মনে হয় গ্যাংটক পৌঁছে, হোটেলে চেক ইন করে আমার অদ্ভুত অনুভূতি হতে শুরু করলো। পুরো এমজি মার্গের ঝলমলে সবকিছু, বিশাল হোটেল রুমের ধবধবে বিছানা, প্রকাণ্ড কাঁচের জানালা দিয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে জ্বলে থাকা জোনাকির আলোর জ্বলানেভা, গরম পানিতে ফ্রেস হয়ে নতুন কাপড় পরে বের হয়েই আমার ফুরফুরে মনে একটা বিষণ্ণতার ছায়া অনুভব করতে লাগলাম।
খুবই অদ্ভুত একটা অনুভূতি, ভালো লাগছে খুব খুব আবার পরোক্ষনেই মনে হচ্ছে ইস আমার সাথে কি যেন নেই, কি যেন নেই। কোন কিছু একটার অভাব বোধ হচ্ছিল। মোমো কিনলাম ক্ষুধা মেটাতে, মনে হল কেউ যেন আমার কাছে অন্যকিছুর বায়না ধরেছে আমি অনুভব করছি কিন্তু কাজটা করতে পারছিনা। সব সময়ের প্রিয় উডল্যান্ডে ঢুকলাম কিন্তু মনে হল কেউ যেন আমাকে না বলে কোথাও ছুটে চলে যাচ্ছে, যাকে আমার ধরে রাখতে হবে।
চুড়ির দোকানের সামনে দিয়ে যেতে যেতে মনে হল, এক গোছা রঙিন চুরি কিনে ফেলি কারো জন্য। তক্ষুনি মনে হল, কেউ বুঝি শুধু এক জোড়ায় হবেনা বলে জেদ ধরেছে, তার আরও কয়েক ডজন চুরি চাই। সোয়েটার আর শাড়ির দোকানের সামনে দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় মনে হল ধুর এখানে তো ঢোকার কথা ছিল কিন্তু ঢুকলাম না কেন? আর আইসক্রিম যখন কিনতে গেলাম তখন মনে হল আমার তো তিনটা আইসক্রিম কিনতে হবে আমি কেন একটা আইসক্রিম কিনছি?
কিছু বুঝে উঠতে না পেরে আমি আইসক্রিম না কিনে সোজা রুমের দিকে গেলাম আর একটু হেটে হেটে, দোকান গুলো বন্ধ হয়ে আলো নিভে যাওয়ার শুরু হতেই। হোটেলের সামনে যেতে যেতেই বেশ কয়েকটা ফাঁকা বেঞ্চি পেয়ে গেলাম, যেগুলো একটু আগেও ভরা ছিল। একটা ফাঁকা বেঞ্চিতে একটু বসলাম। কিছু সময় বসে থাকার পরে আমার মনে হল, এতোটা নিশ্চিন্তে তো আমার এখানে বসে থাকার কথা নয়। আমার তো এখানে ওখানে ছোটাছুটি করে বেড়ানোর কথা! আর আমার তো এতো ঠাণ্ডা লাগার কথাও না। এই অদ্ভুত মানসিক অবস্থার কারন খুঁজে পেতে হোটেলে ঢুকে গেলাম। রুমে ঢুকে কাঁচের জানালায় চোখে রেখে ভাবছিলাম, কিসের অভাব আমাকে এমন অদ্ভুত মানসিক সংকটে ফেলে দিল? কে বা কারা আমার আশেপাশে থেকেও নেই? কেন এমন মনে হচ্ছে?
মোবাইলটা হাতে নিয়ে ভাইবারে ঢুকলাম। একটু ছেলের আর তার মাকে আমার সিকিম পৌঁছে যাওয়ার খবরটা দিতে হবে। বিশাল নরম তুলতুলে বিছানায় শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে ফোনটার লক খুলতেই মনে হল, আমি আসলে আমার দুরন্ত, দুষ্ট ছেলে আর তার অভিমানী মাকে মিস করছিলাম এতক্ষণ ধরে। ঠিক সেই মুহূর্তে মনে হল ইস ওরাও যদি এখানে থাকতো তবে কতই না মজা হত। চমৎকার এমজি মার্গে ইচ্ছেমত দৌড়াদৌড়ি করতে পারতো, চিকেন, মোমো আর আইসক্রিম নিয়ে নানা রকম বায়না করতো। ওকে এখান থেকে ওখান থেকে দৌড়ে দৌড়ে আমাকে খুঁজে বের করতে হত। সেই সাথে তার মায়ের শাড়ি, চুড়ি আর সোয়েটারের দোকান গুলোতে ঢুঁ মারা কমাতে আমাকে বারবার চোখ রাঙাতে হত।
হ্যাঁ ঠিক, ঠিক এইসব, মা আর ছেলের এসব আমি এতো সময় ধরে মিস করছিলাম। ইস ওরা সাথে থাকলে এই সবকিছু আরও দারুণ ভাবে সময় নিয়ে, মনের মত করে উপভোগ করা যেত। এই রুম, বিশাল কাঁচের জানালায় জ্বলে থাকা পাহাড়ে পাহাড়ে দাড়িয়ে থাকা ঘর বাড়ির আলোকবর্তিকা, মল রোডের জৌলুষ, নানা রকম খাবার, ঝলমলে সব দোকান পাট, মজাদার আইসক্রিম, ঝকঝকে এমজি মার্গের সবুজ কোন একটা গাছের নিচে অথবা কোন একটা রঙিন ফুলের টবের পাশের কোন একটা ফাঁকা বেঞ্চি খুঁজে নিয়ে তিনজনে মিলে বসে পড়তাম অনেক সময়ের জন্য। ছেলেটা মনের সাধ মিটিয়ে ছুটে বেড়াতে পারতো, ওর মা ইচ্ছে মত দোকানে দোকানে ঘুরতে পারতো আর আমি চুপচাপ ওদের পাগলামি দেখতে পারতাম।
কত করে বললাম আমার সাথে আসতে, কিন্তু এলোনা। অথচ ছুটি নিতে পারতো, পাসপোর্ট ভিসা, পোর্ট এড সবকিছু করাই আছে তবুও শুধু ছেলের পড়াশোনা আর ভর্তির জন্য ওরা আটকে গেল। মনে মনে ঠিক করলাম, নাহ ওদের ছাড়া এতো সুন্দর যায়গা, এতো সহজ আর এতো আয়েশি কিছু একা একা কিছুতেই উপভোগ করতে পারছিনা। কি দারুণ একটা ঘুম দেয়া যেত, খেয়েদেয়ে তিনজনে মিলে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা পরিবেশে তুলতুলে লেপের ভিতরে। ইস হলনা, হলনা। কিন্তু নাহ আমি একা একা আর এতো সুন্দর কিছু কিছুতেই উপভোগ করতে পারবোনা। ওদেরকে নিয়ে একসাথে তিনজনে মিলে আমি গ্যাংটক, সিকিম আর সিকিমের সবকিছু উপভোগ করতে চাই।
ঠিক করলাম কালকে সকালে একটু গ্যাংটক শহরে হেটে হেটে দেখে, দুপুরের দিকে শিলিগুড়ি চলে যাবো। একা একা আমার ভালো লাগছেনা, ওদেরকে খুব খুব আর খুব মিস করছি। সেই ভাবনা মোবাইলে ওদের সাথে কথা বলার জন্য চেষ্টা করতে লাগলাম আর মাঝে মাঝে ফেসবুকে চ্যাঁটিং। এরই মানে এক বড় আপার সাথে আমার মনের সেই সময়ের অবস্থা শেয়ার করার পরে তিনি পরামর্শ দিলেন।
গেলেনই যেহেতু আর কালকেই চলে আসতে চাইলে সরাসরি শিলিগুড়ি না ফিরে পেলিং হয়ে ফিরতে পারেন। খুব সকালে বের হলেই সম্ভব। আপার পরামর্শ মত তাই ঠিক করলাম। কালকেই শিলিগুড়ি ফিরে যাবো, তবে একটু পেলিং হয়ে…
কিন্তু কে জানতো স্বাধীনতা ভালোবাসা আমি কবে থেকে পরাধীনতাকেও ভালোবাসতে শুরু করেছি একটু একটু করে? কে জানতো অবাধ্য আমিও কবে এতোসব মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে গেছি নিজের অজান্তেই? আর কেইবা অনুভব করতে পেরেছিল, মান-অভিমান আর ভুল বোঝাবুঝির বেড়াজালে নিজেকে কবে থেকে নিজেই জড়িয়ে ফেলেছি!
আর কেইবা কল্পনা করেছিল, যে পেলিং আমার জন্য এতো এতো আর এতো কিছু এমনভাবে সাজিয়ে আর নিজেও সেজে থেকে অপেক্ষা করছে…
পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা আমাদের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য হওয়া উচিৎ।
Source: Sajol Zahid<Travelers of Bangladesh (ToB)