হলুদের রাজ্য (মানিকগঞ্জের ঝিটকা)
শীত এলেই যাদের হলুদের রাজ্য ভ্রমণের ভূত মাথায় চাপে তাদের ভূত তাড়ানোর জন্যই মানিকগঞ্জের ঝিটকা হতে পারে অসাধারণ স্থান। আর অল্প কিছু দিন পরে গেলেই দেখতে পাবেন এই হলুদিয়া রাজ্যের রাজত্ব।
আরেকটু হলেই গিয়াছিলাম। হঠাৎ করে বি আর টি সির এমন উদ্ভট ওভারটেকিং! পড়লে একেবারে খাদে। কিছুক্ষণের জন্য যেন অচিন পাখিটা আরো অচিন হয়ে গেল। আরিচা মহাসড়কের দুর্নামটা হয়ত আরেকবার ইতিহাসের পাতায় লেখা হত। গুলিস্তান থেকে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া যে জ্যামের শুরু তা গাবতলি অবধি বিস্তৃত ছিল। তবে আমাদের এই অস্থিরতার ভাললাগার শুরু সাভার ছাড়ার পর থেকে। গাঁয়ের গন্ধ পাচ্ছিলাম। সেই চেনা, চিরচেনা আমার প্রাণের গাঁ।
রাত যখন সাড়ে ১০টা আমরা তখন মানিকগঞ্জ এসে পৌছাই। শীতের রাতের ছোট খাট কাঁপুনি গুলো আমাদের শিহরিত করছিল। দেরি না করে খুব দ্রুত হোটেল ঠিক করে রাতের আয়োজনে মগ্ন হলাম।
ভেবেছিলাম কাকডাকা ভোরেই বেরিয়ে পড়ব। কিন্তু সে পর্যন্ত আর অপেক্ষা না করে নিশীথের পড়ন্ত ঘুমকে আলতো ছোঁয়ায় ভাঙ্গিয়ে দিলাম। বাইরে তখনও অন্ধকার। জানিনা এত ভোরে বাস পাব কিনা। কিন্তু খেজুরের রসের লোভ সকল বাধা কে অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত করলো। যে যার মত করে প্রস্তুত হয়ে নিচ্ছিলাম। অন্ধকার ডিঙ্গিয়ে ভোরের আভা যখন পৃথিবীর বুকে তার আগমন জানান দিচ্ছিল তখন তার সাথে সাথে প্রচণ্ড কুয়াশাও চারিপাশকে আচ্ছান্নিত করছিল। আমাদের যাত্রাশুরুর ধারাভাষ্য ক্যামেরায় বন্দি করলাম।
প্রচণ্ড কুয়াশার মধ্যে বাস এগিয়ে চলছে। আশেপাশের যেদিকে তাকাই শুধুই সাদা। যেন প্রকৃতি তার শুভ্রতার আঁচল বিছিয়ে রেখেছে আমাদের মত প্রকৃতি প্রেমি এই সব মানুষদের জন্য। হলুদ দুটো লাইটের আলো দেখলে বোঝা যায় সামনে গাড়ি আছে, ধীরে চলুন। আমরা কিন্তু রোমাঞ্চিত, আনন্দিত কিছুটা ভীতও।
তরা সেতু পার হয়ে খানিকটা যাওয়ার পরই আমাদের বাসটা বা দিকে ঝিটকার রাস্তায় মোড় নেয়। এ রাস্তাটা সরু। বেশ কিছুটা যাবার পরই আশেপাশের গন্ধটা পরিবর্তন হয়ে গেল। বুঝতেই পারলাম আমরা ইতিমধ্যে হলুদের সমারোহের মধ্যে দিয়ে চলা রাস্তাটায় পৌঁছে গেছি। সরিষার মৌ মৌ গন্ধ আমাদের নাকে এসে লাগল। আশেপাশের কিছুই দেখতে পারছিলাম না। শুধু ইচ্ছে করছিল পৃথিবীর সমস্ত বাঁধা-বিপত্তি, পিছুটান ফেলে আকাশের দিকে দু হাত মেলে দিক-বিদিক ছুটে বেড়াই হলুদের রাজ্যে। হাজার বছরের অপূর্ণতা পূর্ণতা পাক অপার সৌন্দর্যে।
ঝিটকা নেমেই খেজুরের রসের খোঁজে নেমে পড়ি। বাজারে কম বেশি খেজুরের রস পাওয়া যায় এই ধারণা থেকেই বাজারে রসের খোঁজ শুরু। কিন্তু কয়েকজনকে জিগ্যেস করতেই আমাদের ধারণাটাই পালটে গেল। কেউবা বলল মাঝে মধ্যে ঐখানটাতে বিক্রি হয় কিন্তু কই কোথাও কিছুই নেই।
গাছিরা ইতিমধ্যে গৃহস্থের বাড়িতে রস পৌঁছে দিয়েছে। গ্রামের অনেক বাড়িতেই খেজুরের রস থেকে গুড় বানান চলে আসছে অনেক বছর ধরে। সাদা সাদা এক ধরণের খেজুরের গুড় পাওয়া যায় যা হাজারি গুড় নামে পরিচিত। বহু বছর আগে উদ্ভাবিত এই গুড় এখনও তৈরি করছে এ গাঁয়ের অনেক মানুষ। নিপা ভাইরাসের আতঙ্কে আর পুলিশ এর রেড সিগন্যাল এর কারনে কাঁচা খেজুরের রস বিক্রি বন্ধ।
কুয়াশাচ্ছান্ন ঝিটকা তখনও সূর্যের মুখ দেখেনি। রসের আশা যখন ফিকে হয়ে গেল তখন আমরা সূর্য রশ্মির অপেক্ষায় রয়েছি। বাজারের ভিতর দিয়ে হাই স্কুল এর সাথেই শুকনো একটি খাল রয়েছে। ব্রিজ পেরলেই ওপারে গ্রাম। ব্রিজের ওখানেই চায়ের দোকান। শীতের সকালে চায়ের চুমুকে নিজেদের চাঙ্গা করে নিলাম। সবচেয়ে বড় আকর্ষণের খুব কাছেই আমরা। যাওয়ার পথে নিপা ভাইরাসের কারনটা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম গাছে গাছে বাদুরের আধিপত্য দেখে। মারামারি চেচামেচিতে কান ঝালা পালা করে দিচ্ছে পথচারিদের। কাছেই একটা সরিষা ক্ষেতে ঢুকে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের পাঞ্জাবি, পায়জাম্ প্যান্ট মোটামুটি শিশিরে সিক্ত হয়ে গেল। দুরের ক্ষেত গুলো ভাল দেখা যাচ্ছিল না।
বেলা বাড়তে লাগল। কর্মব্যস্ত মানুষের ক্ষেত খামারের ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেল। আমরা তখন ভিতরের একটা গ্রামে ঢুকে পরেছি। দূর থেকেই হলুদের আদুরে চাহনি আমাদের ইশারা করছিল। লোভাতুর প্রেমিকের মত তার যৌবন জালায় লোভী হয়ে ছুটে গেছি পাগলের মত। সূর্যের আলোর ঝলকানি তখন সরিষার রুপে আগুন ঢেলেছে। ইসসস কি সুন্দর! ইচ্ছে হচ্ছিল প্রকৃতিকে চিৎকার করে বলি হে প্রকৃতি তুমি এত সুন্দর কেন, হে বিধাতা তুমি আমাকে আমার রুপসি বাংলাকে দেখার জন্য অমরত্ব কেন দিলে না। আহারে… বেঘোরে মোর প্রান গেল তোর ভালোবাসায়।
দূরে খেজুর গাছের সারিও দেখছিলাম ও পাশে বর্ষীয়ান বটগাছটিও আমাদের ছায়া দিতে মুখিয়ে আছে। আমাদের ল্যান্ডস্কেপ একের পর এক ক্লিক পড়ছিল। বাজারে যখন আমরা ক্যামেরায় ধারাভাষ্য দিচ্ছিলাম তখন ছোটখাটো একটা জটলাও সৃষ্টি হয়ে ছিল। উপজেলা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী এসে আমাদের স্বাগত জানালেন। তার রেফেরেন্সে ঠিকানা দিয়ে দিলেন স্থানীয় চেয়ারমান শামিম হাজারির বাড়ি যেখানে গেলে আমাদের রসের সন্ধান মিলবে। এবার সেখানে যাওয়ার চিন্তা করলাম। হলুদের সমারোহ পেছনে ফেলে আমরা পিছন দিকে ফিরে যাচ্ছি। যেতে যেতে পথে পড়ল ফুলকপি পেঁয়াজ ও অন্যান্য ক্ষেত।
অনাকাঙ্খিত ভাবে আমরা শামিম হাজারির বাড়ি ছেড়ে আরও অনেক দূরে গিয়ে নামি। কিন্তু কি আর করার তখন আর ও মুখো হলাম না। গাঁয়ের রাস্তা ধরে হাঁটা ধরলাম। দু পাশে পড়ন্ত সরিষার আভা, খেজুর গাছে ঝরা রসের হাড়ি ঝোলান। কোথাও ধানের ক্ষেত, মাঝে মাঝে ঝিরি ঝিরি বাতাস। রাস্তার পাসেই ঈদ গাহ মাঠ, সেখানেই বিরাট বড় একটি বর্ষীয়ান বটবৃক্ষ। আমরা সেখানে বিশ্রাম নিলাম।
এবার যাওয়ার পালা। পড়ন্ত দুপুর। ঝিটকা বাজারের পাশ ঘেঁষে বয়ে চলা খালের সামনে আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। বাস স্ট্যান্ড এ যখন এলাম তখন বাসে অনেক যাত্রী উঠে আছে। দেরি না করে আমরাও উঠে গেলাম।
পিছনে ঝিটকা, দু পাশে ঝড়ন্ত সরিষা ক্ষেত। কোথাও সারি সারি খেজুর খাছ। ডিঙ্গি বেয়ে কোথাও মাছের নেশায় খালে নৌকা বেয়ে চলেছে কেউ কেউ। নাকে সরিষার ঝাঁজ। সত্যি এত সুন্দর ঘ্রান! পিছনে আবহমান বাংলার চির চেনা রুপকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছি বিধ্বস্ত ব্যস্ত নগরির দিকে।
কিভাবে যাবেন: ঢাকার গুলিস্থান থেকে বি আর টি সি আর শুভযাত্রা মানিকগঞ্জ এর উদ্দেশ্যে চলাচল করে। বি আর টি সি তে ভাড়া পড়বে ৯০ টাকা। শুভযাত্রায় ৮০। এছাড়াও গাবতলি থেকেও সরাসরি ঝিটকার বাস আছে, নাম ভিলেজে লাইন। সেখান থেকে ১২০ টাকা ভাড়া পড়বে জন প্রতি। মানিকগঞ্জ থেকে ঝিটকার উদ্দেশ্যে প্রায় সারাদিন বাস থাকে। ভাড়া ৩০ টাকা।
কোথায় থাকবেন: বাস যেখানে নামিয়ে দেবে সেখানেই নবিন সিনেমা হলের পাশেই রয়েছে থাকার হোটেল। দুই সিটের প্রতি রুম ভাড়া ১৫০-২০০ টাকা। এছাড়াও টাউন হলের দিকে আরো কিছু হোটেল রয়েছে।
তথ্য: খেজুরের রস খেতে হলে খুব ভোরে ঝিটকা গিয়ে সেখান থেকে রিক্সা নিয়ে যাবেন শামিম হাজারির বাড়ির দিকে। ওদিকে গেলে পাবেন সকাল সকাল অনেক গাছির দেখা তাদের কাছ থেকেই রস সংগ্রহ করতে পারবেন।
খেজুরের এক নম্বর গুড় নিতে হলে পরিচত কেউ থাকতে হয়। এক্ষেত্রে প্রতি কেজি দাম পড়বে ৭০০ টাকা। তাছাড়া বাজারে মোটামুটি ভাল গুড় ১২০-৩৫০ টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায় ।
Post Copied FRom:Iftekhar Hossain>Travelers of Bangladesh (ToB)