সেন্টমার্টিন বা কক্সবাজার ভ্রমনের এটিই সব থেকে ভালো সময়

সমুদ্রের প্রতি অন্যরকম একটা টান কেন জানি খুব কাজ করে… আর সেক্ষেত্রে সেন্টমার্টিনের প্রতি টান টা একটু বেশিই…. তাইতো একই বছরে ৩য় বারের মত ছুটে গিয়েছিলাম এই প্রবাল স্বর্গরাজ্যে… হ্যাঁ, উদ্দেশ্য একটাই স্বচ্ছ প্রকৃতি আর নীল দিগন্তের কাছাকাছি আরও একটিবার নিজেকে সমর্পণ করা……
গত ৫.১২.২০১৭ গিয়েছিলাম এই বছরের জন্য সর্বশেষ ট্যুর দিতে…
মজার ব্যাপার ছিল… বছর টা শুরু হয়েছিল এই সেন্টমার্টিন দিয়ে আবার শেষ ও হল এই সেন্টমার্টিনকে দিয়েই……

প্রথমেই বলে রাখি… সেন্টমার্টিন বা কক্সবাজার ভ্রমনের এটিই সব থেকে ভালো সময়… সেন্টমার্টিন যেতে হলে প্রথমে আপনাকে যেতে হবে টেকনাফ লঞ্চঘাটে… ঢাকার শ্যামলী, কল্যাণপুর, গাবতলী, কলাবাগান, ফকিরাপুল, কমলাপুর, সায়দাবাদ সহ বিভিন্ন যায়গা থেকে প্রতিদিনই বিভিন্ন পরিবহনের এসি/ননএসি বাস টেকনাফের উদ্দেশ্যে সন্ধ্যা ৬ থেকে রাত ৮ টার মধ্যেই ছেড়ে যায়.. ননএসি বাসের ভাড়া সিট প্রতি ৯০০ টাকা…এসি বাসে গেলে আপনাকে গুনতে হবে সিট প্রতি ১৫০০-১৭৫০ টাকা। ঢাকা থেকে টেকনাফের দূরত্ব কম বেশি ৪৭০ কিলোমিটার…. পরদিন সকাল ৮ টা নাগাদ পৌছে যাবেন টেকনাফ লঞ্চ ঘাটে…

বাস থেকে নেমেই জাহাজের টিকিট কেটে নেয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ… টেকনাফ থেকে প্রতিদিনই ৪-৫টি জাহাজ সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়… তবে আবহাওার অবস্থা অনুযায়ী তারতম্য ঘটে… তাই সেন্টমার্টিন ভ্রমণের প্ল্যান করার আগে অবশ্যই আবহাওার পূর্বাভাস দেখে তবেই সিদ্ধান্ত নিবেন… টেকনাফ থেকে প্রতিদিনই এল.সি.টি. কুতুবদিয়া, কেয়ারি সিন্দবাদ, এম ভি গ্রীনলাইন সহ বেশ কিছু জাহাজ সেন্ট মার্টিন যাওয়া আসা করে… তবে ভুল করেও কেউ টাকা বাঁচানোর জন্য ট্রলারে করে সেন্ট মার্টিন যাওয়ার কথা ভাববেন না। জাহাজে বেশ কয়েকটি শ্রেণীর টিকিট রয়েছে… শ্রেণী ভেদে টিকিটের দাম ৫৫০-১৫০০ টাকা পর্যন্ত। তবে ওপেন ডেকে গেলেই আপনি নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরের আসল সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন… জাহাজের টিকিট কাটার সময় চেষ্টা করবেন কাউন্টারের লোকদের যত সম্ভব বুঝিয়ে দাম কমানোর… তবে সেটা অবশ্যই জন সম্মুখে নয়… নিজের ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি কাউন্টারের ভেতর দরদাম করে ওপেন ডেকের ৭০০ টাকার টিকিট ৫৫০ পর্যন্ত নামিয়ে আনতে পেরেছিলাম… তবে যারা প্রথমবার সেন্টমার্টিন যাবেন তাদের জন্য বলছি… টিকিট কাটার সময় কেউ যেন বুঝতে না পারে যে এটিই আপনার প্রথম ভ্রমণ… দেখবেন অনেক কিছুই সহজ হয়ে যাচ্ছে…

সবকটি জাহাজ ই সকাল ৯ঃ৩০ এ ঘাট থেকে রওনা হয়ে যাবে… জাহাজ যত সামনে আগাবে নাফ নদী ততই আপনার সামনে তার সৌন্দর্য তুলে ধরবে… আর জাহাজের দুপাশ দিয়ে অজস্র গাংচিল আপনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে আপনার গন্তব্য পর্যন্ত… জাহাজে অবশ্যই এমন কোন কিছু করা থেকে নিজেকে বিরত রাখবেন যা আপনার জন্য কোন অনাকাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতার কারন হয়ে দাড়ায়… আপনার জন্য যাবতীয় নির্দেশনা জাহাজেই মাইকিং করে আপনাকে জানিয়ে দেয়া হবে… দুপুর ১২ টার মধ্যেই পৌঁছে যাবেন সেন্টমার্টিন জেটিতে… জাহাজ থেকে নামার সময় অবশই সাবধানতা অবলম্বন করবেন… এরপর চলে যাবেন ব্রিজ ধরে সেন্টমার্টিন বাজারে… মান ও সুযোগ সুবিধা ভেদে অনেক রকম রিসোর্ট গড়ে উঠেছে এখানে… নিজের রুচি ও সামর্থ্য যাচাই করেই বেছে নিবেন… ভাড়া রুম প্রতি ১০০০-৩৫০০ পর্যন্ত… তবে অবশ্যই দরদাম করে নিবেন…

ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়ুন দুপুরের খাবারের জন্য… আগেই বলে রাখি… সেন্টমার্টিন এর খাবারের স্বাদের প্রতি আগে থেকেই অনেক বেশি প্রত্যাশা নিয়ে না আসাই ভালো… নিজের পছন্দ মত বুঝে শুনে খাবার নির্বাচন করবেন… তবে এখানে প্রায় সব খাবারের হোটেলে একটা ব্যাপার দেখা যায়… ভাত মাথা পিছু ৪০ টাকা আনলিমিটেড… তবে সামুদ্রিক মাছের স্বাদ না নিয়ে সেন্টমার্টিন থেকে আসবেননা…

সমুদ্রে নামার আগে অবশ্যই জোয়ার ভাটার সময় জেনে নামবেন… আর অবশ্যই লাল পতাকা যুক্ত যায়গা গুলোয় পানিতে নামা থেকে বিরত থাকবেন… সাঁতার জানা না থাকলে খুব বেশি দূর না যাওয়াই ভাল… চাইলে বীচের উপর রাখা চেয়ার ভাড়া নিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে কিছুক্ষন হারিয়ে যেতে পারেন সুবিশাল সমুদ্রের মাঝে… বিকালে চাইলে সাইকেল ভাড়া করে বেরিয়ে পরতে পারেন পুরো দ্বীপটি ঘুরে দেখতে… কারণ পায়ে হেঁটে পুরোটা ঘুরে দেখা বেশ কষ্টকর… আর অবশ্যই সূর্যাস্ত মিস করবেননা… হয়তো এটি ই হতে পারে আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ সূর্যাস্ত… রাতের আকাশে কোটি কোটি তারার মেলা বসে সেন্টমার্টিনের আকাশে… জীবনে মনে রাখার মত কিছু সময় যদি আলাদা রাখতে চান… তাহলে বেরিয়ে পড়ুন রাতের আকাশ টা একবার দেখে আসার জন্য… চেষ্টা করবেন পরদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে… সেন্ট মার্টিনের সূর্যোদয় যেন সৃষ্টিকর্তার আরেকটি উপহার… জেটি থেকে খুব সুন্দর দেখা যায় সূর্যোদয়…

সূর্যোদয় দেখে নাস্তা সেরে বেড়িয়ে পড়ুন ছেড়া দ্বীপের উদ্দেশ্যে। সেন্টমার্টিনে এসে ছেড়া দ্বীপ দেখে না গেলে বলবো এই জীবণে অনেক কিছু দেখা থেকে বঞ্চিত হবেন তাও আবার এত কাছে এসেও….। আর যারা যেদিন আসবেন সেদিনই টেকনাফ ফিরে যাবেন তাদের জন্য ১ মিনিট নিরবতা ছাড়া আর কিছু বলতে পারছিনা….. উপরে যা কিছু বলা হল সব কিছু থেকেই তারা বঞ্চিত হবেন…।

যাই হোক, জেটি থেকে ছেড়া দ্বীপ যাওয়ার ৪টি উপায় আছে…. ট্রলার, গাম বোট, স্পীড বোট এবং পায়ে হেটে…. ট্রলারে যেতে হলে লাগবে কম বেশি ৩০ মিনিট… জন প্রতি লাগবে ১৫০ টাকা…. গাম বোটে যেতে সময় লাগবে ২০ মিনিট আর জন প্রতি লাগবে ২০০ টাকা…..স্পীড বোটে যেতে সময় লাগবে ১০ মিনিট… আর জনপ্রতি ৩০০ টাকা…. যেভাবেই যাননা কেন ছেড়া দ্বীপ ঘুরতে সময় পাবেন ১ ঘণ্টা….আর পায়ে হেঁটে গেলে অবশ্যই ভাটার সময় রওনা হবেন… যদিও সময় বেশি লাগবে…তাও অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা নিতে পারেন… অবশ্যই সেখানকার ডাব খেয়ে আসতে ভুলবেননা… এক কথায় অমৃত….৩০-৪০ টাকার ডাবের পানি খেয়ে লাখ টাকার তৃপ্তি পাবেন এটুকু বলতে পারি।… ছেড়া দ্বীপের কাছাকাছি গেলেই দেখবেন স্বচ্ছ পানির তলদেশে নানা রঙের প্রবাল আর ছোট ছোট মাছ……

দুপুরের খাবার শেষে ২ঃ৩০ এর মধ্যে জেটিতে উপস্থিত থাকবেন…। কারন জাহাজ গুলো ২ঃ৪৫ এ একে একে টেকনাফের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে… যারা শুধুমাত্র সেন্টমার্টিন ভ্রমণের জন্য আসবেন তারা চাইলে সেন্ট মার্টিন থেকেই ঢাকার টিকিট কেটে নিতে পারেন। জাহাজ বিকাল ৫ঃ৩০ এর মধ্যেই টেকনাফ লঞ্চঘাটে পৌঁছে যাবে…। যারা কক্সবাজার যাবেন তারা ঘাট থেকেই রাস্তা পার হয়ে কক্সবাজারের বাসে উঠে যাবেন… টেকনাফ থেকে কক্সবাজারের ভাড়া ১৫০ টাকা…।

একটা কথা সব সময়ই মনে রাখবেন…। প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে যেয়ে প্রকৃতির কোন প্রকার ক্ষতি হয় এমন যে কোন প্রকার কাজ থেকে বিরত থাকবেন…। কারন আপনার বা আমার ছোটখাটো অবহেলাও প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়াতে পারে… আর আমাদের সম্পদের ক্ষতি মানে আমাদের নিজেদের ই ক্ষতি…। আর দেশকে যত কাছ থেকে দেখবেন দেশের প্রতি ভালবাসা ততই বাড়বে…।

Post Copied From:

Tariqul Islam Chowdhury Rafi > Travelers of Bangladesh (ToB)
Share:

Leave a Comment