কাপ্তাই এ একদিন: ঘোরা ও থাকা
দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ত সময় থেকে একটু সময় বের করে ঘুরে আসুন কাপ্তাই। গ্রুপে এটা আমার প্রথম পোস্ট,তাই যেকোনো ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করছি। ট্যুরের আরো কিছু ছবির লিংক প্রথম কমেন্টে দিচ্ছি।
আমাদের ট্যুর প্ল্যান ছিলো রাতে রওনা দিয়ে সারাদিন কাপ্তাই ঘুরে,রাতে কাপ্তাই এ থেকে পরদিন সকালে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়া। তো প্ল্যান মোতাবেক রাত সাড়ে দশটার মধ্যে আমরা সবাই কমলাপুর রেলস্টেশনে হাজির হই, ট্যুরমেট ছিলাম পাঁচজন। ট্রেন সাড়ে এগারোটায় কমলাপুর থেকে ছেড়ে যায়- তূর্ণা নিশীতা ট্রেনের শোভন চেয়ারে করে একটি আরামদায়ক জার্নি শেষে সকাল ৭টায় আমরা পৌঁছে যাই চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে। নেমেই ব্রেকফাস্ট করার পালা। একটা দিক মাথায় রাখতে হবে, খুব সকালে রেলস্টেশনের অপর পাশের খাবার দোকানগুলো আমরা খোলা পাইনি,স্টেশন থেকে বের হয়ে নিউমার্কেট মোড়ের দিকে একটু এগিয়ে গেলেই হাতের বাম পাশে পাবেন খাবার হোটেল, পরোটা-ডাল-ডিমভাজি-চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা রওনা দেই বহদ্দারহাটের উদ্দেশ্যে।খাবার হোটেল থেকে বের হয়ে হাতের বামে দশ পনেরো কদম আগালেই নিউ মার্কেট মোড়, ওখান থেকে ১নং বাস ছেড়ে যায় বহদ্দারহাটের উদ্দেশ্যে,সময় লাগবে সর্বোচ্চ বিশ-পঁচিশ মিনিট। বাসের হেল্পারকে বলবেন আপনাকে বহদ্দারহাট টার্মিনাল নামাতে, বহদ্দারহাটের পরের স্টপেজ হচ্ছে বহদ্দারহাট টার্মিনাল,ভাড়া নিবে ১০/-
টার্মিনালে বাস থেকে নেমে রাস্তা পার হলেই দেখবেন হাপ্তাই( কাপ্তাই) আর লেচুবাগান বলে বাস ডাকছে। কিছু বাস আছে সরাসরি কাপ্তাই যায় আর কিছু আছে লিচুবাগান পর্যন্ত। আমরা সরাসরি কাপ্তাই এর বাসে উঠেছিলাম যা আমাদের নামিয়ে দিয়েছিলো জুম রেস্তোরার একদম সামনে।আপনি লিচুবাগানের বাসে উঠলে,সেখান থেকে নেমে আবার জুম রেস্তোরা পর্যন্ত সিএনজি নিতে পারবেন।
কিংবা আপনি প্রথমে যে ১ নাম্বার বাসে উঠলেন সেটা দিয়ে টার্মিনালে না নেমে আরো একটু সামনে গিয়ে কাপ্তাই রাস্তার মাথায় নামতে পারেন,সেখান থেকে পুরো রাস্তাই সিএনজিতে যেতে পারবেন। তবে যেহেতু লিচুবাগান পর্যন্ত রাস্তা খারাপ,তাই আমার পারসোনাল সাজেশন থাকবে বাসেই যাওয়ার।বাসে জুম রেস্তোরায় পৌঁছাতে সময় লেগেছে ২ঘন্টা ১০ মিনিটের মত।
টার্মিনাল থেকে কাপ্তাই জুম রেস্তোরার বাস ভাড়া ৬০/-
টার্মিনাল থেকে লিচুবাগানের বাস ভাড়া ৪৫/-
জুম রেস্তোরায় আমাদের আগে থেকেই কটেজ বুক করা ছিলো,ওদের তিনটা কটেজ রয়েছে-হেলেন,ভেনাস এবং কর্ণফুলি- কটেজগুলোয় থাকতে আপনাকে দিনপ্রতি যথাক্রমে গুণতে হবে ১০০০,১৫০০ এবং ২০০০ টাকা।
জুম রেস্তোরা সম্পূর্ণ বিজিবির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত, কটেজে ফ্যামিলি নিয়ে থাকলে কোনো রেস্ট্রিকশন নেই কিন্ত ফ্রেন্ডরা মিলে ঘুরতে গেলে ছেলেদের এবং মেয়েদের আলাদা কটেজ নিতে হবে এবং অবশ্যই আগে থেকেই যথাযথ পারমিশন নিতে হবে ডিফেন্স কোনো পারসনের রেফারেন্স সহ। মেয়েদের কটেজের সামনে একজন এবং পুরো জুম রেস্তোরা এলাকায় সর্বমোট পাঁচজন আর্মড বিজিবি প্রহরায় থাকে ২৪ ঘন্টা,তাই সেফটি নিয়ে কিছু ভাবতে হয়নি। কটেজে চেক ইন করে ফ্রেশ হয়ে আমরা বের হয়ে যাই কাপ্তাই কায়াক ক্লাবে যাওয়ার জন্য,জুম রেস্তোরায় কায়াকিং এবং বোটিং এর ব্যবস্থা থাকলেও আমাদের পারসোনাল পছন্দ ছিলো কাপ্তাই কায়াক ক্লাব- যা জুম রেস্তোরা থেকে জাস্ট ১০০ গজ সামনেই।
কায়াকিং পার বোট ২৫০ টাকা, স্টুডেন্ট আইডি সাথে থাকলে ২০০টাকা করে। অর্থাৎ, প্রতিজন মাত্র ১০০টাকা খরচ করে এক ঘন্টা কায়াকিং এর স্বাদ নিতে পারবেন। কায়াকিং অন্যরকম একটা এক্সপেরিয়েন্স, পাহাড়ের মাঝ দিয়ে কাপ্তাই লেকে আপনি ভাসছেন সরু একটা বোটে চেয়ারের উপর বসে,চাইলেই হাত দিয়ে ছুঁতে পারছেন সবুজ পানি-চোখ বন্ধ করে সিনারিও টা চিন্তা করুন শুধু। যত যাই হোক, কায়াকিং এর থ্রিল আপনি কখনো ট্রাভেল এক্সপেরিয়েন্স পড়ে বুঝতে পারবেন না,এজন্য আপনাকে কায়াকিং করতেই হবে 😉
আমরা এক ঘন্টার বিশ মিনিটের মতো কায়াকিং করলেও আমাদের থেকে এক্সট্রা কোনো চার্জ রাখা হয়নি 😀
কায়াকিং শেষে প্রচন্ড ক্ষুধায় আমরা কায়াক ক্লাব থেকে চলে যাই ঠিক দেড়শ হাত সামনেই ফ্লোটিং প্যারাডাইস রেস্টুরেন্টে এবং এই লাঞ্চের স্বাদ আমি জীবনেও ভুলবো না। সিম্পলি দা বেস্ট। একে তো প্রচন্ড ক্ষুধা,তার উপর অনেক বেশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও ফ্রেশ খাবার। আর ডানে তাকালেই দেখবেন কাপ্তাই লেকের মাথা নষ্ট করা ভিউ,যদিও খাবার এত বেশিই মজা ছিলো যে খাওয়ার সময় তাকানো হয়নি আমার,বরং খাওয়াদাওয়া শেষে সামনে বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে কাপ্তাই এর অপরূপ সৌন্দর্য দেখেছি। ফ্লোটিং প্যারাডাইসের মালিক আর খাবার পরিবেশনকারী ভাইটার আতিথেয়তা ছিলো এক কথায় অস্বাধারণ, আমরা চারজন মুরগির মাংস এবং একজন নিয়েছিলো পাবদা মাছ।সাথে ছিলো ডাল, আলুভর্তা, সালাদ, তিনটা কোল্ড ড্রিংকস, এবং দুই লিটার পানি।সবাই পেট ভরে খেয়ে একদম নড়তে পারছিলো না এমন অবস্থা। সবমিলে পাঁচজনের খাবার বিল এসেছিলো ১০৯০ টাকা,৫০ টাকা ডিসকাউন্ট পেয়ে হয়েছে ১০৪০/- :p
লাঞ্চ শেষে আমরা আবার জুম রেস্তোরার সামনে চলে আসি সিএনজি নেয়ার জন্য। ওখান থেকে কাপ্তাই জেটিঘাট পর্যন্ত সিএনজি নেই জনপ্রতি ২৫টাকা ভাড়া। সিএনজি দিয়ে এই রাস্তাটা যাওয়া হচ্ছে স্বপ্নের মতো, একপাশে পাহাড় আর অন্যপাশে কাপ্তাই লেক,তার মাঝে রাস্তা দিয়ে চলছে আপনার সিএনজি। পথে দেখবেন কার্গো পারাপার প্রণালী, পারমিশন থাকলে যেতে পারবেন কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রেও। আমরা জেটিঘাট নামি, জেটিঘাট থেকে আমরা মাঝারি সাইজের নৌকা নেই মাত্র ৭৫/- তে আমাদের নেভি লেকভিউ আইল্যান্ডে নামাবে,কিন্ত নেভি ভিউ আইল্যান্ডের পাশে গিয়ে আমরা ঠিক করি ওখানে যাবো না কারণ দেখে আমাদের ততটা ভালো লাগেনি,তাই আমরা মাঝি ছেলেটাকে বলি আইল্যান্ডের চারপাশে আমাদের ঘুরে দেখাতে, আইল্যান্ড থেকে কাপ্তাই বাঁধ দেখা যায়,চাইলে যেতে পারেন কাছাকাছি। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় আমরা আর ওদিকে যাইনি। আইল্যান্ডের আশেপাশে ঘুরে আমরা আবার চলে আসি জেটিঘাটে,কাপ্তাই লেকের উপর পিচ্চি একটা নৌকায় বসে আমরা সূর্যাস্ত দেখি,ভাবুন অনুভূতিটা :’) অনেকদিন মনে থাকবে ওই সময়টা। যাওয়া আসায় নৌকা খরচ ৭৫+৭৫= ১৫০টাকা। জেটিঘাট থেকেই জুম পর্যন্ত সিএনজি পাবেন। সিএনজিতে ওঠার পর একটু সামনেই কাপ্তাই বাজারে নামি পরদিন সকালের ঢাকাগামী বাসের টিকেট করার জন্য, শ্যামলী এবং সৌদিয়ার বাস কাউন্টার আছে ওখানে, ভাড়া ৫৫০/- করে প্রতিজন। জুম রেস্তোরার সামনে দিয়েই বাস যাবে,আমাদেরকে ওখান থেকেই তুলে নিবে সকালে এমন কথা হলো। টিকেট করা শেষে সিএনজিতে জুম রেস্তোরায় ব্যাক করি,ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। জুম রেস্তোরায় রাতের খাবার সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যেই বানিয়ে ফেলে কিন্ত আমরা চাচ্ছিলাম একটু লেইট করে গরম খাবার খেতে এবং জুমে বারবিকিউ এর ও কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। তাই জুম থেকে বের হয়ে আবার হেটে চলে আসি ফ্লোটিং প্যারাডাইসে, ওদের চুলায় তখন একটু সমস্যা হচ্ছিলো প্রথমে বলেছিলো সেদিন বারবিকিউ কিংবা গ্রিল কোনোটাই পসিবল হবে না হয়তো, রেগুলার ডিনার থাকবে.. কিন্ত ওই যে বললাম এই রেস্টুরেন্টের সাথে রিলেটেড মানুষগুলা বেশি ভালো,নিজেরাই পরে বললো সমস্যা নাই ভাই,আইসেন, ব্যবস্থা করে দিবো। খুশিমনে চিকেন সমুচা আর চা খেয়ে বিল দিতে গেলে বলা হলো, রাতের খাবারের সময় একবারেই বিল দিতে :’) রাত সোয়া নয়টার দিকে ডিনার করতে আসবো বলে চলে আসলাম জুমে। ফ্রেশ হয়ে জুম রেস্তোরার মধ্যেই আড্ডা দেয়ার অনেকগুলো সুন্দর জায়গা আছে, দোলনার পাশে এমন একটা জায়গায় বসে আমরা UNO খেললাম কিছুক্ষণ, তারপর একটা ক্লাসিকাল রেডিওর গানের সাথে লুডো খেলা হলো। এভাবেই আড্ডার সাথে সাথে চলে আসলো ডিনারের সময়। গিয়ে বসলাম, ফ্লোটিং রেস্টুরেন্টের বারান্দায়, সারাটা আকাশ ভর্তি তারার দিকে অনেকক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে ছিলাম আমরা। এরপর গ্রিল আসলো, সাথে পরোটা আর সস! বারান্দায় বসেই গ্রিল খাওয়া শেষে আসলো ফানুশ ওড়ানোর পালা। ঢাকা থেকেই ফানুশ নিয়ে গিয়েছিলাম আমরা, অনেক উঁচু থেকে ফ্লোটিং রেস্টুরেন্টের বারান্দা থেকে ফানুশ ওড়াচ্ছেন ঠিক কাপ্তাই লেকের উপর আর দেখছেন আকাশ ভরা তারা, কেমন লাগবে কিছুক্ষণ ভাবুন আর ডিসিশন নিন কাপ্তাই যাবেন কিনা।সুন্দর একটা দিনশেষে কটেজে গিয়ে শুতেই রাজ্যের ঘুম চলে আসবে আপনার চোখে,ভোরবেলা ঘুম ভাঙলে দেখবেন ঘন কুয়াশায় চারপাশ ঢাকা,একটু একটু করে কুয়াশা কমবে আর আপনি দেখবেন কাপ্তাই এই অন্যরকম একট রূপ। এইসব দেখতে দেখতে রেডি হয়ে সকালে ৮:৪৫ এ জুম রেস্তোরার সামনে থেকে উঠে পড়ুন ঢাকার বাসে।
সর্বমোট খরচ(জনপ্রতি)
ঢাকা- চট্টগ্রাম (ট্রেন) : ৩৪৫/-
ব্রেকফাস্ট: ৬০/-
রেলস্টেশন- টার্মিনাল( ১নং বাস) : ১০/-
টার্মিনাল-জুম রেস্তোরা: ৬০/-
কটেজ : দুইটা (হেলেন ও রজনীগন্ধা) : ১০০০+২০০০=৩০০০/-, প্রতিজন ৬০০/-
কায়াক ক্লাবে কায়াকিং: ১০০/-
লাঞ্চ: ২১০/-
জুম- কাপ্তাই জেটিঘাট (সিএনজি): ২৫/-
সাম্পানে ঘোরা: ১৫০/- (জনপ্রতি ৩০/-) বিভিন্ন সাইজের নৌকা আছে,আপনার উপর নির্ভর করে
জেটিঘাট- জুম: ২৫/-
নাস্তা: ২০/-
ডিনার: ১২০/- (গ্রিল এবং একটা পরোটা ১০০/-, আমরা দুটো করে পরোটা এক্সট্রা নিয়েছিলাম)
কাপ্তাই-ঢাকা: ৫৫০/-
সর্বমোট: ২১৫০/-
জুম রেস্তোরা: 01811460460
ফ্লোটিং প্যারাডাইস রেস্টুরেন্ট: 01823-930265
আমাদের আরো বিভিন্নভাবে এক্সট্রা খরচ গিয়েছে,যেমন আমরা ফানুশ নিয়ে গিয়েছিলাম, ট্রেনে বাসে যাওয়ার পথে টুকটাক খাবার দাবারে খরচ হয়েছে কিছু।আমরা টার্মিনালে না নেমে ভুলে বহদ্দারহাট নেমে গিয়েছিলাম ওখান থেকে রিকশায় যেতে হয়েছে আবার। যাই হোক,সব মিলে ২৩০০ টাকা নিয়ে কাপ্তাই যান, সারাজীবন মনে রাখার মতো ট্যুর হবে কথা দিলাম।
Post Copied From:Rakib Ahmed Akash>Travelers of Bangladesh (ToB)