খুমের স্বপ্নরাজ্যে বিচরণ
পদ্মঝিরি-দেবতাপাহাড়-অমিয়াখুম-সাতভাইখুম-ভেলাখুম-নাইক্ষ্যং লেক-নাফাখুম-রেমাক্রি-তিন্দু-বড়পাথর-সাংগু
বিশ্ব ভ্রমণের চিন্তাভাবনা যারা করে রেখেছেন, তারা একটু এদিকে আসেন, অর্থাৎ বান্দরবানের দিকে আগে ঘুরে আসেন।
বিশেষ করে যারা পাহাড়-নদী-ঝর্ণার প্রেমে আগে থেকেই নিমগ্ন, তাদের জন্য বান্দরবান পারফেক্ট জায়গা। বাংলাদেশের অনেক জায়গা ভ্রমণ করলেও এই জায়গায় যাওয়ার অতৃপ্তি নিয়ে অনেকদিন বসে ছিলাম, অবশেষে সেই অপেক্ষার প্রহর শেষ হল।
আবার বলা যায় ভ্রমণপিপাসু হিসেবে একটা স্বপ্নপূরণ হয়েছে, সেই ভ্রমণের বর্ণনাই আজকে দিচ্ছি…
২১ নভেম্বর,২০১৮
চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবানগামী পূরবী পরিবহণের ভোর ৬ টা ১০ এর ফার্স্ট ট্রিপে আমাদের ১২ জনের টিমের অফিসিয়ালি যাত্রা শুরু হয়(আনঅফিসিয়ালি ভোর সাড়ে ৪ টা বাস প্রায় ৯ টা নাগাদ আমাদেরকে বান্দরবান নামিয়ে দেয়। আগে থেকে ঠিক করা চাঁন্দের গাড়ি বাস স্ট্যান্ডে এসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। সেটায় উঠে হোটেলে গিয়ে নাস্তা শেষ করে আমরা থানচির উদ্দেশ্যে রওনা করি।
উল্লেখ্য, বান্দরবানে আমাদের সাথে চট্টগ্রাম থেকে আসা ৫ জনের একটা গ্রুপ এড হয়, অর্থাৎ আমরা হয়ে যাই ১৭ জনের এক বিশাল টিম। যাইহোক, থানচি যাবার পথে দুবার বিজিবি ক্যাম্পে আইডি কার্ড জমা দেয়া এবং সাইন করা লাগে, কয়েকটা জায়গায় চেকিং বা ওয়াশরুমের জন্যও দাড়ানো লেগেছে। তার উপর ছুটির দিন হওয়ায় প্রত্যেকটা পয়েন্টে ওইদিন প্রচন্ড ভীড় ছিল। তবু আমাদের ড্রাইভার মামা তার ল্যান্ডক্রুজার নিয়ে ঝড়ের বেগে টানায় ((২)) টার মধ্যেই আমরা থানচি পৌঁছে গিয়েছিলাম।
এখানেও আমাদের গাইড “উখিরাম” দা আগে থেকে স্ট্যান্ডে অপেক্ষারত ছিল। তো থানচি নেমে “হোটেলে ভাত খাওয়া, টুকটাক জুতা এবং খাবার জিনিসপত্র কেনা, পুলিশ ক্যাম্পে আইডি কার্ড জমা দেয়া এবং গ্রুপ ছবি তোলা, বিজিবি ক্যাম্পে নিজের পরিচয় লেখা, প্রত্যেকের জন্য লাইফজ্যাকেট ভাড়া নেয়া, ট্রেকিংয়ের জন্য ড্রেসাপ চেঞ্জ করে রেডি হওয়া এবং ৩ দিনের জন্য নেটওয়ার্কের বাইরে যাবার আগে পরিবারের সাথে একবার কথা বলে নেয়া” এই কাজগুলো করতে করতে প্রায় ৩ টার উপর বেজে যায় আমাদের। তারপর নৌকায় উঠে প্রায় ৩০ মিনিট পরে আমরা পদ্মমুখ এসে পৌঁছাই এবং এখান থেকেই পদ্মঝিরি ধরে ঠিক ৪ টা ১০ মিনিটে আমাদের সুবিশাল ট্রেকিং পথ শুরু হয়।
শীতকাল একটা কারণ এবং পাহাড়ে খুব তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা হয় এটা আরেকটা কারণ, যার ফলে ১ ঘন্টা পরই আমাদের সবার টর্চ লাইট অন করতে হয়। অর্থাৎ পুরো ট্রেকিংটাই আমাদের রাতে করতে হয়েছে। যাবার পথে আমরা তিনটি পাড়া পেয়েছিলাম যার মধ্যে হরিশচন্দ্র পাড়ায় একটা নাস্তার ব্রেক নিই এবং অন্য সময় বিভিন্ন পয়েন্টে দাঁড়িয়ে রেস্ট নিই। অন্ধকারে পিচ্ছিল পাথরের ঝিরিপথ দিয়ে হাটা, কনকনে ঠান্ডা পানিতে পা দিয়ে খাল পার হওয়া, উঁচুনিচু অগণিত ভায়াগ্রা পাহাড় পার হওয়া এবং শেষের দিকে গয়ালের(বন্যগরু টাইপের) মুখোমুখি হওয়া সবকিছুই ছিল এই ট্রেকিংয়ের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। যাবার পথে কতবার যে পায়ের রগে টান খেয়ে দুই পা অচল হয়ে পড়ছিল আর লাইফজ্যাকেট+ব্যাগের ভারে কাঁধ যে কতটা ব্যাথা করছিল তার হিসেব না করলেই ভাল হয়। আমাদের থাকার জায়গা জিনাপাড়ায় যখন পৌঁছাই তখন ঘড়িতে বাজে রাত প্রায় ১০ টা ১৫ মিনিট। থাকার জায়গা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল উখি দা। সবার শরীর তখন অসাড়, কেউ কেউ তো ফ্রেশ হওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে ঘুম দিয়ে দিল। উল্লেখ্য, ট্রেকিংয়ের সময় আমাদের সামনে থাকা প্রায় ৩-৪ টা গ্রুপকে পেছনে ফেলা স্বত্ত্বেও আমাদের ৬ ঘন্টা লেগে গিয়েছিল।
সত্যিকথা বলতে, ১ম দিনের এই ৬ ঘন্টার ট্রেকিং যে আমাদের জন্য এত কষ্টের এবং কঠিন হবে তা আমরা কল্পনায়ও ভাবিনি। ১৭ জনের মধ্যে আমাদের ৪ জনের কেওক্রাডং রুটে ৪৮ কি.মি. ট্রেকিংয়ের অভিজ্ঞতা ছিল, কিন্তু এই ৪ জনের অবস্থাও বেগতিক হয়ে গিয়েছিল।
২২ নভেম্বর,২০১৮
১ম দিনের ট্রমা থেকে উঠতে সবার ই একটু সময় লেগেছে, কারণ অনেকেই বিভিন্ন ওষুধ খেয়ে ঘুম দিয়েছিল। তাই আমাদের একটু দেরী হয়ে যায়। যাদের ঘরে থাকছি, অর্থাৎ সাদু দা এবং দিদি’র বানানো সুস্বাদু ডিম খিচুড়ি খেয়ে সকাল ১০ টায় আমরা অমিয়াখুমের উদ্দেশ্যে রওনা করি। প্রথমেই আমাদের বিশাল এক ভায়াগ্রা পাহাড় পার হতে হয়, এরা আসলে দেবতা পাহাড়ের ছোট ভাই, শুধু উপরের দিকে উঠতেই থাকে তো প্রায় ৪৫ মিনিট ট্রেকিংয়ের পর বিখ্যাত দেবতাপাহাড়ের চূড়ায় এসে পৌঁছাই আমরা, এবার নামার পালা। এই পাহাড় ডিঙানোর বড় সমস্যা হল একেতো ৮০° খাড়া, তার উপর সরু আঁকাবাঁকা পথ, ক্ষণে ক্ষণে বিশাল বিশাল পাথর এবং গাছের গুড়ি পড়ে আছে। নামতে তাই অসম্ভব রকমের সাবধানতা অবলম্বন করতে হয় সাথে বোনাস হিসেবে হাঁটুর জয়েন্টের ব্যাথা তো আছেই! যাইহোক দুপুর ১২ টা নাগাদ আমরা পাহাড়ের নিচে এসে পৌঁছাই। পাহাড় থেকে নামার পর ডানে ভেলাখুম এবং বামে অমিয়াখুম-সাতভাইখুম। যেকোনো খুমে যেতেই ১০ মিনিটের মত পাথরের উপর উঠানামা করা লাগবে। তো আমরা প্রথমে অমিয়াখুমের দিকে যাই।
অমিয়াখুমের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য্য হল এর স্বচ্ছ সবুজ পানি এবং চারপাশে ঘিরে থাকা বিশাল বিশাল পাহাড়। ক্যাম্পিং করে পূর্ণিমা কাটানোর জন্য অন্যতম সেরা একটা জায়গা বটে। পানি অসম্ভব ঠান্ডা হওয়ায় কয়েকজন ছাড়া বাকীরা গোসল করতে নামেনি। দেবতাপাহাড় আমাদের পেটে লাড়াচাড়া দিয়ে ফেলেছিল। তাই এই লাড়াচাড়া বন্ধ করতে উখি দা এবং আকুরণ দা(ইনি আজকের দিনের জন্য সহকারী গাইড ছিল) চটপট ব্যাগে করে আনা ম্যাগি নুডলস নামিয়ে রান্না করে দেয়। নুডলস খেয়ে ছবি তোলা শেষ করে আমরা ভেলাখুমের দিকে যাই।
ব্যক্তিগতভাবে বললে, ভেলাখুম অতটা আকর্ষণীয় লাগেনি যতটা আমরা ছবিতে দেখেছি। দুরত্ব মাত্র ৫-৭ মিনিটের আসা-যাওয়া, সাথে মানুষের তুলনায় ভেলার সংখ্যাও কম, ভেলায় করে ওই পাশে গিয়ে আবার হেঁটে পাওয়া যায় নাইক্ষ্যং লেক। তবে দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে স্বচ্ছ পানির উপরে বাঁশের ভেলা চড়া কিংবা নিজে চালানো একটু ভিন্ন অভিজ্ঞতার যোগান দেয়। ভেলা চড়া শেষ যখন, তখন সাড়ে ৪ টার উপরে বাজে, অথচ অন্ধকার হবার আগে যেকোনোভাবে আমাদের দেবতাপাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছাতে হবে। তাই এক মুহুর্তও দেরী না করে আমরা জিনাপাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা করি। নামতে ছিল ঝুঁকি, এবার উঠতে গিয়ে শুরু হাপানী। তবু নামার তুলনায় আমরা খুব তাড়াতাড়ি এবং কম কষ্ট পেয়ে উঠেছি বলা যায়। সূর্য যখন ডুবে যাচ্ছে, তখন আমরা দেবতাপাহাড়ের চূড়ায়। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে গ্লুকোজ গুলিয়ে খেয়ে এই পাহাড়কে লাল সালাম দিয়ে আমরা গন্তব্যে হাঁটা দেই। যাবার পথে একজনের ডাক শুনে পিছনে তাকিয়ে দেখি পূর্ণিমার চাঁদ আমাদের দিকে তার অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে মায়াবী দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে, দেখে সত্যিই মনটা ভরে যায় পুরো দিনের ক্লান্তিটা যেন এখানেই শেষ। রাত প্রায় সাড়ে ৬ টা নাগাদ আমরা জিনাপাড়ায় পৌঁছাই। সেখানে চা-নাস্তা খেয়ে, আড্ডার আসর বসিয়ে, বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ শেষ করে সকালে নিজেদের জবাই করে দিয়ে যাওয়া পাহাড়ী মুরগী দিয়ে আমরা রাতের খাবার শেষ করি, খাবার টা যা সুস্বাদু ছিল! ২য় দিন এত কষ্ট হলেও কেন যেন আগের দিনের মত ক্লান্তি ছিলনা, হয়তো আমরা ঝর্ণা আর পাহাড়ের সৌন্দর্য্যের কাছে হার মেনে গেছি!
২৩ নভেম্বর, ২০১৮
আজকে আমরা নাফাখুম ঘুরে রেমাক্রি গিয়ে থাকব, তাই অত তাড়া ছিলনা। আগের দিনের মত সকাল ১০টায় রওনা করি। জিনাপাড়াকে বিদায় জানানোর আগে এই পাড়া সম্পর্কে কিছু কথা বলতে হয়। পাড়াটা যথেষ্ট বড়, একটা পাহাড়ের চূড়া বলা যায়, পাড়ার মানুষগুলো অসম্ভব ভাল এবং সুন্দরও বটে উনাদের রান্না ছিল অতুলনীয়, যখনই খেয়েছি ২-৩ প্লেট করে নিয়েছি।
জিনাপাড়া থেকে নাফাখুম যাবার পথ টা অস্বাভাবিক রকমের সুন্দর, রেমাক্রি খালের পাড় ধরে বালু এবং পাথরের উপর দিয়ে হাঁটতে হয়, কখনো খাল পার হতে হয় আর একটা খালের পানি এতটা পরিষ্কার হতে পারে সেটা খালি চোখে না দেখলে কখনো বিশ্বাস হত না, সুবহানআল্লাহ বলতে হয়। আড়াই ঘন্টা মজা করে হাটার পর আমরা নাফাখুম এসে পৌঁছাই। আসার সময় দূর থেকে ঝিরির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল, আর এসে সবাই কিছুক্ষণ হাঁ করে এই রূপসী মায়াবতীর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। দেরী না করে এক এক করে সবাই পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ি, কেউ লাইফজ্যাকেটসহ কিংবা কেউ ছাড়া। এখানে একটা ভয়ানক ঘটনা ঘটেছিল, সেটা শেষের দিকে বলছি, এখন আমার কিংবা আপনাদের কারো মুড নষ্ট করতে চাচ্ছিনা।
তো.. কেমন লেগেছে নাফাখুম?? এই প্রশ্নের এক কথায় উত্তর-“এই ট্যুরের সবচেয়ে সেরা প্রাপ্তি আমাদের প্রত্যেকের জন্যই, শুধু আমার না!” সরাসরি না দেখলে ছবি কিংবা ভিডিও দিয়ে কখনোই কাউকে বলে বোঝানো যাবেনা যে কতটা ভয়ংকর রকমের সুন্দর আল্লাহর এই অপরূপ সৃষ্টি। আয়নার মত স্বচ্ছ পানি, সেই পানি পড়ার আওয়াজ, পানিতে থাকা বিশাল মাছ, চারপাশের সৌন্দর্য আর পানিতে নামার পর পাওয়া সেই স্বর্গীয় অনুভূতি, প্রত্যেকটা জিনিসই আজীবনের জন্য আমাদের মনে গেঁথে গেছে।
অমিয়াখুমে আমরা ঠান্ডার জন্য নামতে পারিনি, অথচ এখানে ঠান্ডাই লাগেনি, লাগলেও সেটা ভুলে গেছি।
তো গোসল, লাফালাফি, ছবি তোলা শেষ করে ঠিক পাশেই থাকা নাফাখুম পাড়ায় গিয়ে আমরা ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার সেড়ে নেই। এখানেও আইটেম ছিল পাহাড়ি মুরগী এবং রান্না ছিল অতুলনীয়। কবির ভাষায়, “যেতে নাহি চাহে মন তবু চলে যেতে হয়” এর মতন করে রূপবতী নাফাখুমকে টাটা জানিয়ে আমরা রেমাক্রির উদ্দেশ্যে রওনা করি।ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটায় সময় ৪টা ১০ মিনিট। নাফাখুম থেকে রেমাক্রি আসার পথের যদি বর্ণনা করি তবে বলতে হবে ভয়ংকর। প্রায় ৫-৬ বার রেমাক্রি খাল পেরোতে হয়। নাফাখুমের আগে যেমন স্রোত এবং পানি কম ছিল, নাফাখুমের পরে তার উলটো। প্রচন্ড স্রোত, হাঁটু/কোমড় পানি, পানির নিচে পিচ্ছিল পাথর, তার উপর অক্টোবরে একটা ছেলে মারা যাওয়ার জায়গাটাও দেখিয়েছিল আমাদেরকে উখিদা। আমরা হাটু পানি পেয়েছিলাম সেখানে, কিন্তু বর্ষায় প্রচুর স্রোত এবং গলাপানি থাকে, দড়ি দিয়ে পেরোতে হয় তখন। যাইহোক, অন্ধকারে টুকটাক ভয়কে সঙ্গী করে অবশেষে সাড়ে ৬ টা বাজে আমরা রেমাক্রি এসে পৌঁছাই। এখানেও আবার সাঙ্গু নদী পেরোনো লাগে | অর্থাৎ আমাদের সাথে হেঁটে এসে রেমাক্রি খাল এখানে সাঙ্গু নদীর সাথে মিশেছে। কিন্তু জায়গাটার সৌন্দর্য দেখে কখন যে সবাই সবার হাত ধরে নদী পার হয়ে গেছি টেরও পাইনি!
তারপর সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে শিরবীলী কটেজ নামক একমাত্র থাকার জায়গায় ব্যাগ নামক বস্তা রেখে ফ্রেশ হয়ে আমরা চটপট নিচে নেমে যাই নাস্তা খেতে।
এইদিন ছিল পূর্ণিমার রাত, চাঁদটা এমনভাবে দেখা যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল “দুই কুয়াশাঘেরা পাহাড়ের নিচ থেকে সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে চাঁদমামা তার অপরূপ মহিমায় আরেকটা ছোট্ট পাহাড়ের উপর সৌন্দর্য্যের ফুলঝুরি ছড়াচ্ছে”। আমি মনে হয় কাউকে বুঝাতে পারিনি সৌন্দর্যরূপটা। আসলে আরো কয়েকটা পূর্ণিমারাত কাটাতে হবে সেখানে, সেই শপথ ইতিমধ্যে করে এসেছি।
এইরাতে আমাদের ক্লান্তি ছিলনা বললেই চলে, গত ২ দিনের তুলনায় ট্রেকিংয়ে কষ্ট ছিল কম, সৌন্দর্য ছিল বেশী, সবশেষে রেমাক্রি ফলস এবং সাঙ্গু নদীর তীরে ক্যাম্প ফায়ার করে পূর্ণিমা উপভোগের স্মৃতিটা আজীবন অমলিন হয়ে থাকবে।
রাতে আমাদের খাবারের বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, বলা যায় এই ট্যুরের একমাত্র। শিরবীলী কটেজে থাকা নিয়ে কোনো অভিযোগ না থাকলেও কটেজের অধীনে থাকা হোটেলের খাবার ছিল তীব্র রকমের জঘন্য, এখানকার জামাল নামক বাবুর্চি আলুভর্তা কে বানিয়ে রেখেছিল মরিচভর্তা, ডালকে বানিয়েছিল “তরকারির লবণ ছাড়া ঝোল”, ভাগ্য ভাল যে আমরা মুরগী অর্ডার না করে ডিমভাজি অর্ডার করেছিলাম। উনাকে ইচ্ছেমত বাঁশ দিয়ে আসছি বটে, কিন্তু পেটকে এখনো শান্ত করতে পারিনি। তাই সবাইকে সাজেস্ট করব নিচের বেড়ার হোটেলগুলোতে খেতে। আমরা নিচেই সকালের নাস্তা করেছিলাম। তো রাতের খাবারের কারণে আমাদের কারোই ভাল ঘুম হয়নি, তবে এখানে আগের ২ রাতের চেয়ে ঠান্ডা ছিল কম, হয়তো নদীর তীর হওয়ায়।
২৪ অক্টোবর, ২০১৮
ভোরে উঠে কুয়াশাঘেরা অন্যরকম এক রেমাক্রিকে দেখতে পেলাম। এইদিন আমাদের তাড়া ছিল, কারণ বান্দরবান থেকে চট্টগ্রামের শেষ বাস সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টা। তাই সকাল ১০ টার মধ্যে রেমাক্রি ফলসে টুকটাক ফটোশুট করে এবং নাস্তা করে নৌকায় উঠে আমরা থানচির উদ্দেশ্যে রওনা করি। এইদিককার নৌকা ভ্রমণ কিন্তু পুরোপুরি ভিন্ন। সরু লম্বা নৌকা, এক পাশে টারবাইন, দুই পাশে বৈঠা হাতে দুই মাঝি, দুইপাশে পাহাড় এবং ছোট-বড় পাথরের উপর কিংবা পাশ দিয়ে নৌকা প্রায় উল্টাবে উল্টাবে এমন অবস্থায় ঝড়ের গতিতে নৌকা চলতে থাকে। বড়পাথরের আগে একটা জায়গায় আমাদের সবাইকে নামতে হয়েছিল, কারণ এখানে স্রোত একটু বেশী, ৬ জনকে নিয়ে নৌকা উল্টে যেতে পারে। তারপর আবার নৌকায় উঠে কিছুক্ষণ পর পৌঁছে যাই “বড়পাথর” নামক জায়গায়। বড় বলতে বিশাল বিশাল সাদাপাথর নদীর উপর রাজার মত দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোকে পাশ কেটে এঁকেবেকে আমাদের নৌকা ছুটে চলেছে। এখানে আপনি এক মুহুর্তের জন্যেও নৌকা দাঁড় করাতে পারবেন না, স্রোত নিয়ে পাথরে বাড়ি খাওয়াবে, আমাদের এক মাঝির বৈঠা পরে গিয়েছিল স্রোতে, পরে অনেক কষ্টে উদ্ধার করেছিলাম। এই জায়গায় আমাদের একটা একশন সেল্ফি আছে, সেটা দেখলে আপনারা আইডিয়া পাবেন যে জায়গাটা কত সুন্দর এবং পানি কতটা পরিষ্কার। নদীপথের এই রোমাঞ্চকর দুই ঘন্টার ভ্রমণ ছিল আমাদের ট্যুরের শেষ এডভেঞ্চার। প্রায় ১২ টা নাগাদ আমরা থানচি এসে পৌঁছাই। তারপর আবার লাইফজ্যাকেট ফেরত, পরিবারের সাথে কথা এবং বিভিন্ন কাজ শেষে চান্দের গাড়িতে উঠি। দুপুর ১টায় গাড়ি চলা শুরু করলেও বান্দরবান পৌঁছাতে বিকেল ৫টা বেজে যায়, কারণ পথে রাস্তার কাজ চলতেছিল বিধায় এক জায়গায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। বান্দরবান নেমে ভাত খেয়ে পূর্বাণী পরিবহণের ৬ টার বাসে উঠে রাত ৯টায় এসে চট্টগ্রাম পৌঁছালে এখানেই আমাদের যাত্রার অফিসিয়াল সমাপ্তি ঘটে।
কেওক্রাডং-বগালেক-কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন এই জায়গাগুলোও কিন্তু সুন্দর, তবে খুমের রাজ্য অন্যরকম। বলা যায় “ভয়ংকর সুন্দর”। এই পাহাড়, পাহাড়ের মানুষ,তাদের মন সব কিছুই বিশাল। তার সাথে যদি আয়নার মত স্বচ্ছ পানির নদী, ছড়া ও ঝিরিপথ এবং দেশের সবচেয়ে সুন্দর ঝর্ণাগুলো একত্রিত হয় তখন এই জায়গার আর কোন তুলনা কখনো হয় না। তাই যারা টুকটাক ট্রেকিং করে অভ্যস্ত এবং ভ্রমণপিপাসু তাদের জীবনে অন্তত একবার হলেও এখানে আসা উচিত।
সতর্কতা::
নাফাখুম আসার পর অসাবধানতাবসত আমাদের এক ভাই কাঁধে থাকা ব্যাগ নিয়ে পাথরে পিছল খেয়ে পানিতে পড়ে গিয়েছিল, উনি সাতার জানতেন না, ভাগ্য ভাল যে আগে থেকে কিছু পর্যটক সেখানে গোসল করছিল, উনারা এসে ভাইকে বাঁচিয়েছিল।
দেবতাপাহাড় থেকে নামার সময় আমাদের এক ফ্রেন্ড একপ্রকার উল্টিয়ে পড়ে যেতে লাগছিল, হাল্কা ব্যাথা পেয়েছে।
অমিয়াখুম থেকে আসার পথে পানি পার হবার সময় আমি পিছল খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম, আলহামদুলিল্লাহ্ কিছু হয়নি, পানির নিচে পাথরগুলো অত্যন্ত পিছল।
এক ফ্রেন্ড তো পুরো ট্যুরে অন্তত ৪-৫ বার পায়ে ব্যাথা পেয়েছে, একপ্রকার লেংড়াতে লেংড়াতে ট্রেকিং করেছে।
তাই সবাই খুব সাবধানতা অবলম্বন করবেন…
✓ পিচ্ছিল যেকোনো জায়গা পার হবার সময় একজন আরেকজনের হাত ধরে পার হবেন।
✓ ট্রেকিংয়ের শুরুতেই গাইড মামাকে বলে হাতে বাঁশ নিয়ে নিবেন।
✓রাতের জন্য টর্চ লাইট, রোদের জন্য গামছা এবং সানগ্লাস সাথে রাখবেন।
✓ ট্রেকিংয়ের জন্য ভাল গ্রিপওয়ালা জুতা, বিশেষ করে থানচিতে ১২০ টাকার যে জুতাগুলো পাওয়া যায় সেগুলো সেরা। কনভার্স টাইপ জুতা যারাই নিয়েছে, মহাবিপদে পড়েছে।
✓ কাঁধের ব্যাগ যতটা হাল্কা রাখা যায় তত ভাল।
✓ জাতীয় পরিচয়পত্রের ৩টি ফটোকপি সাথে নিবেন ,২টি থানচি যাওয়ার পথে আর ১টি থানচিতে জমা দিতে হবে।
✓ পানি পান করার জন্য ঝিরির পানিই একমাত্র উৎস।
✓ থানচির পর আর বিদ্যুৎ নেই, তাই সাথে পাওয়ারব্যাংক এবং ক্যামেরা-মোবাইল ফুলচার্জ দিয়ে নিবেন।
✓ শুধুমাত্র থুইসাপাড়ায় বাঁশের সামনে মোবাইল রেখে অভিনব পদ্ধতিতে কোনোরকম কথা বলা যায়, এছাড়া আর কোথাও কোনোপ্রকার নেটওয়ার্ক নেই।
✓ সাথে ফার্স্টএইড বক্স+প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখবেন।
✓ সবসময় একসাথে থাকার চেষ্টা করবেন এবং গাইডকে ফলো করবেন।
✓এই ধরণের ট্যুরে সময় মেনে চলা খুবই খুবই গুরুত্বপূর্ণ, ব্যাপারটা মাথায় রাখবেন।
✓যাবার উপযুক্ত সময়::
সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর [পানিও থাকবে, ট্রেকিংও কম কষ্টের হবে]
জানু-মার্চ[পানি কম থাকবে, তবে ট্রেকিং তুলনামূলক সহজ হবে]
বর্ষায় গেলে প্রচুর স্রোত থাকবে, ট্রেকিং খুবই কষ্ট এবং ভয়ংকর হবে, তবে পানি সবচেয়ে বেশী থাকবে।
✓আমাদের গাইড উখিরাম দার নাম্বারঃ 01535035686
খরচ:
চট্টগ্রাম-বান্দরবান-চট্টগ্রাম বাসঃ ১১০+১১০ জনপ্রতি
বান্দরবান-থানচি-বান্দরবান চান্দের গাড়িঃ ১২৫০০/-
বোটঃ ৪০০০/- (আসা-যাওয়া, এক বোটে ৬ জন)
গাইডঃ ৫০০০/- (থাকা খাওয়া আমাদের)
জিনাপাড়ায় থাকাঃ ১৫০/- জনপ্রতি (পার নাইট)
খাওয়াঃ ডিম খিচুরি/ভাত ১২০/-, মুরগী ভাত ১৫০/-, সাথে ডাল, সবজী, আলুভর্তা থাকে।
জনপ্রতি আমাদের ৪০০০ টাকার মত খরচ হয়েছিল।
আমাদের ভ্রমণ ছিল ৩ রাত ৪ দিনের।
বিঃদ্রঃ দয়া করে নদী বা খালের পানিতে কিংবা ঝিরিপথে পলিথিন জাতীয় কিছু ফেলবেন না। এই সৌন্দর্য আমরা যাবার আগে যেমন ছিল, আমরা সেখান থেকে আসার পরে যেন তেমন ই থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন। আর অবশ্যই পাহাড়ের মানুষদের সাথে খারাপ ব্যবহার করবেন না।