Bled, Slovenia
বসনিয়ার রাজধানী Sarajevo (সারায়েভো) থেকে যখন ফ্লেক্সি বাসে উঠি ঘড়িতে সময় তখন বিকাল ৪ টা।।। বিকাল না বলে দুপুর বলাই ভালো কারন জুলাই আগস্ট মাসে সূর্য ডোবে সাড়ে নয়টায়।।। সামনে লম্বা ১৫ ঘন্টার বাস জার্নি, গন্তব্য স্লোভেনিয়ার রাজধানী Ljubljana (লুবিয়ানা)।। স্লোভেনিয়া ইউরোপে আমার ষোলতম দেশ।। লম্বা বাস জার্নি হলেও ভাবলাম যে কিনা নন এসি বাসে চট্টগ্রাম-বরিশাল, বগুড়া বরিশাল, সিলেট বরিশাল কিনবা রংপুর বরিশাল এর মত লম্বা জার্নিতে অভ্যস্ত তার জন্য এইটা কিছুই না।।। বাসে পাশে বসলো এক মধ্যবয়সী মহিলা, ইংলিশ কিছুই বুঝে না।।৷ সারা পথ তাই কানে হেডফোন লাগিয়েই কাটাতে হলো।।।
বসনিয়া-স্লোভেনিয়া বর্ডার ক্রসের সময় পরলাম বিপদে।।। বসনিয়া সেনজেনভুক্ত দেশ না।। ক্রোয়েশিয়া থেকে বসনিয়া ঢোকার সময় ভুলে বসনিয়ান ইমিগ্রেশন পাসপোর্টে সিল মারে নাই।।। এখন বসনিয়া থেকে বের হওয়ার সময় সিল না দেখে ইমিগ্রেশন পুলিশ গেলো কনফিউজড হয়ে।৷ আরো চার পাচ জন পুলিশ ডেকে নিয়ে আসলো৷। মিনিট পনের নিজেরা গবেষণার পর ছাড়লো আমাকে।। একা একা থাকায় একটু ভয় ভয় করছিলো, শেষেমেশ ছেড়ে দেয়ায় মনে হলো হাফ ছেড়ে বাচলাম।।
রাত এগারোটার দিকে ড্রাইভারকে বললাম ডিনারের জন্য থামাতে।। হাইওয়ের পাশে একটা রেস্টুরেন্টে চিকেন স্টেক খেলাম।।। অনেক ক্ষুধার কারনেই কিনা জানি না, অমৃত মনে হলো।। ইউরোপের বেশিরভাগ লংরুটের বাসস্ট্যান্ড গুলো অসাধারণ৷।বাসস্ট্যান্ডগুলোতে টিকিট স্ক্যান না করে ঢোকা যাবে না।। অর্থাৎ ফ্রড কিংবা আজাইরা লোকজনের আনাগোনা নাই।।।
দেশে থাকতে নন এসি বাসেই আমি বাস ছাড়ার দশ মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পরতাম।। আর এর আরামদায়ক বাসে তো কথাই নাই, সারা রাত ঘুমিয়েই পার হলো।। ভোর সাড়ে পাচটায় লুবিয়ানা বাস স্টেশনে নেমে গেলাম।। বাস স্টেশনের সাথেই ট্রেন স্টেশন।। ভেবেছিলাম ট্রেন স্টেশনে আর্লি ব্রেকফাস্ট করে নিবো কিন্তু স্টেশনমার্কেট ছয়টার আগে খুলবেই না।।। শহর কখনোই টানে না আমাকে, লুবিয়ানায় তাই স্টে করবো না বলে ঠিক করলাম।।। স্লোভেনিয়ার উইশ লিস্টে ছিল সোল্কান ব্রীজ আর লেক ব্লেড।।। লেক ব্লেডেই যাবো ঠিক করে সকালের প্রথম ট্রেনে উঠে পড়লাম।।
লেকের কাছেই আমার হোস্টেল।। লুবিয়ানা থেকে ট্রেন যায় Jesenice স্টেশন পর্যন্ত।। পথে Lesce Bled স্টেশনে নামলে বাসে করে সরাসরি আমার হোস্টেলের কাছাকাছি যাওয়া যায়, কিন্তু ভুলে আমি Jesenice চলে যাই।। Jesenice থেকে অন্য ট্রেনে Bled Jezero. যাওয়াতে অবশ্য ভালোই হয়েছে।। সকালে একেবারে নিস্তব্ধ পরিবেশে Bled Jezeroস্টেশন থেকে হোস্টেল পর্যন্ত সাড়ে তিন কিলোমিটার গ্রামের রাস্তায় মর্নিং ওয়াক করতে করতে এসেছি।।। পুরো এক মাসের ট্রিপে আমার লাগেজ একটা ব্যাগপ্যাক৷।। নয় কেজি ওজন।।। এই ওজন নিয়ে হাটার অভ্যাস আছে।।।
হোস্টেলের চেক ইন দুপুর এগারোটায়।। এই চার পাচ ঘন্টা কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না।। একটা সুপারশপ খোলা পেয়ে প্রথমেই এককাপ কফি খেয়ে চাংগা হয়ে নিলাম।। হোস্টেলে ঢুকে দেখি ঘুম থেকেই উঠে নাই কেউ।। মোবাইল, পাওয়ার ব্যাংক, ড্রোনের ব্যাটারী চার্জে দিয়ে গোসল সহ ফ্রেশ হয়ে নিলাম।।। ডে প্যাকে মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে আর ব্যাকপ্যাকটা রেখেই লেকের পাড়ে চলে এলাম, উদ্দেশ্য ব্রেকফাস্ট করে লেকের চারিপাশ চক্কর মারা।।। বিধি বাম, এগারোটার আগে কোন দোকানই খুলবে না, অগত্যা সুপারশপ থেকে কলা ব্রেড দিয়েই ব্রেকফাস্ট করে নিলাম।।
লেকের চারিপাশ একচক্কর পাচ/ ছয় কিলোমিটারের কম হবে না।।। যারা বরিশালের দূর্গাসাগর গিয়েছেন তারা বুঝতে পারবেন।।। লেকের মাঝে একটা ছোট্ট দ্বীপ, দ্বীপে একটা চার্চ।। তবে দূর্গাসাগরের মত এত অপরিস্কার এবং রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে পচে যাওয়া যায়গা না।।। টলটলে স্বচ্ছ পানি দেখলেই ঝাপ দিতে ইচ্ছা করে।। লেকের চারপাশে এন্টিক্লোকওয়াইজ তিন ভাগের এক ভাগ চক্কর দিলেই Ojstrica পাহাড়ে ওঠার পথ পাওয়া যায়।।। ওইখান থেকে মাঝের দ্বীপ সহ সুন্দর একটা ভিউ পাওয়া যায়।।। কিছু না ভেবেই ওঠা শুরু করলাম।।। দুইটা ভিউ পয়েন্ট আছে।। প্রথমেই দূরেরটা দিয়ে শুরু করলাম।।।
কোন একদিন এক টিভির দোকানের ডিসপ্লেতে রাখা টিভির ওয়ালপেপারে চোখ আটকে গিয়েছিলো।। একটা লেক আর লেকের মাঝে ছোট একটা দ্বীপের ছবি উপর থেকে তোলা।। বাসায় এসে ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি করে জানলাম জায়গার নাম লেক ব্লেদ।। সেইদিনই ঠিক করেছিল এই ভিউ আমাকে বাস্তবে দেখতে হবে।। পাহাড়ে উঠতে একটু কষ্ট হলেও লেক ব্লেদে গেলে এই ভিউ দেখা মাস্ট।।।
সলো ট্রাভেলিং এর সবচেয়ে বড় সমস্যা ছবি তোলা।। অন্যান্য ট্রাভেলারদের অনুরোধ করে ছবি তুলতে হয়।। আর বেশিরভাগ লোকেরই ফ্রেমিং সেন্স কিংবা ফটোগ্রাফি সেন্স বিলো স্ট্যান্ডার্ড।। পাহাড় থেকে নিচে নেমে এক বেলজিক মহিলাকে বললাম ছবি তুলে দিতে।৷ তিনিও আবার আমাকে অনুরোধ করলেন তার ছবি তুলে দিতে৷।। মহিলার নাম মারি, স্কুল টিচার।। অনেকক্ষণ গল্প করলো।। উপরের পাহাড়ে উঠাতে পারবে না বলে বন্ধুদের দেখানোর জন্য উপর থেকে তোলা আমার ছবি গুলো নিলো।।৷ ওনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লেকের বাকি দুই ভাগ চক্কর শুরু করলাম।। কিছুদুর যেতেই এক ক্যাফেতে পেলাম ব্লেদের বিখ্যাত ক্রীমকেক।।
নিচে নামতে নামতে টায়ার্ড হয়ে গেলাম।। সারাদিন পেটেও দানাপানি পরেনি।।। কোন কিছু না ভেবে বড় এক বার্গার অর্ডার দিলাম।। বার্গার খেয়ে দেয়ে দিনের আলো নেভার আগেই হোস্টেলে চেক ইন শেষ করে ঘুম।। সারাদিন হাটা, পাহাড়ে ওঠা, আগের সারাদিন সারায়েভোতে হাটা আর সারা রাত জার্নির টায়ার্ডনেসে এক বারের জন্যও ঘুম ভাংলো না রাতে।।।
সকালে তারাতারি উঠে পরলাম।। ভাবছিলাম এত সকালে কেউ উঠবে না আর সেই সুযোগে ভিউপয়েন্ট থেকে সকালের ভিউ একা একা উপভোগ করব।।। ভিউ পয়েন্টে গিয়ে দেখি আমার মত চালাক আরো অনেকেই আছে।।। তবে একবারে একা একা না হলেও মোটামুটি নির্জনে টাইম কাটানো গেলো।।।
রোদ একটু চড়ে বসলেই নিচে নেমে আসলাম।। বেকফাস্টের জন্য দোকান খোলা না পেয়ে আবার সেই কলা ব্রেড কফি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে লেক চক্করে বের হলাম।।। এবার আর পায়ে হাটার চক্করে না গিয়ে সাইকেল ভাড়া নিলাম।।। লেকে বিভিন্ন জায়গায় নৌকা দেখছি।।। ভাব্লাম একটা ভাড়া নিয়ে লেকের মাঝে দ্বীপটা ঘুরে আসি।। যদিও ৬/৭ ইউরো দিলে যাত্রীবাহি নৌকায় উঠা যায়, কিন্তু এই লেকে নৌকা চালানোর লোভ সামলানো গেলো না।।। একটু পরেই বুঝলাম কি ভুলটাই না করছি আমি।।। বৈঠা বাই এক দিকে নৌকা যায় আর একদিকে।।। বৃত্তাকারে চক্কর খেতে খেতে হাত ব্যাথা হয়ে গেলো কিন্তু দ্বীপে আর পৌছাতে পারলাম না।। মন মেজাজ খারাপ হয়ে পাড়ে ফেরত আসলাম।।
লেকের বিভিন্ন পাশে কাঠের পাটাতনের মত করা।। সুইমিং করতে নামার জন্য আর সুইমিং শেষে রোদ পোহানোর জন্য।। কতক ফ্রী আর কতক ব্যবহার করতে টাকা লাগে।।। ফ্রী এক্টায় গিয়ে জিনিসপত্র রেখে সুইমিং এ নাম্লাম।। কতক্ষণ সুইমিং করি কতক্ষণ কাঠের পাটাতনে স্বল্পবসনা সুন্দ্রীদের মাঝে রৌদ্রস্নান করি।। আইনেস্টাইনের আপেক্ষিকতা সূত্রে কিভাবে যে ঘন্টা তিনেক পার হয়ে গেলো টেরই পেলাম না।।
স্বল্পবসনা সুন্দরীদের মাঝ থেকে যাওয়ার ইচ্ছা না থাক্লেও ক্ষিদা লাগায় উঠতেই হলো।।। লাঞ্চএ কয়েকটা পিজ্জার স্লাইস নিয়ে ভাব্লাম সাইকেল আছে যেহেতু আশেপাশে ঘুরে আসি।।।
জংগলের মাঝে গ্রামের পথ, পাহাড়ের ঢাল, পাহাড়ী ঝর্না পার হয়ে যেতে যতে যে কখন বিকাল হয়ে গেলো টেরও পেলাম না।। পাহাড়ের ডাউনস্লোপে খুব আরামে নাম্লেও ওঠার সময় জিহবা বের হয়ে গেল।।। সাইকেল জমা দিয়ে হোটেলে চলে আসলাম।।
ওয়েদার ফোরকাস্টে দেখলাম আগামীদিন বৃষ্টির সম্ভাবনা শতকরা ৮০ ভাগ।।। চিন্তা করে দেখলাম বৃষ্টির মধ্যে হোস্টেলে বসে এক দিন নষ্ট করার চেয়ে নতুন কোন জায়গায় যাওয়া ভালো।।।
ইউরেইল এ্যাপসএ সার্চ দিয়ে দেখলাম রাত বারোটায় lesce Bled স্টেশন থেকে অস্ট্রিয়ার Innsbruck ট্রেন আছে৷৷ আর ব্লেদ থেকে রাত ১০ টায় Lesce Bled এ লাস্ট বাস।৷। হোস্টেলের পাশের সুপার শপ থেকে সস্তা পিজ্জা দিয়ে ডিনার সারতে সারতেই বৃষ্টি চলে আসল।।।
Lesce Bled স্টেশনে পৌছালাম রাত সাড়ে দশটায়।। ছোট স্টেশন হওয়ায় পুরা স্টেশনে আমি একা যাত্রী আর পাশে একটা বারে তিন জন অর্ধমাতাল।। মনে কিছুটা ভয় নিয়েই দুই ঘন্টা কাটালাম।। এর মধ্যে ঘোষনা শুনলাম ট্রেন আধা ঘন্টা লেইট হবে।। আধা ঘন্টা পর ট্রেন আসলে হাফ ছেড়ে বাচলাম।। সকালে Innsbruck নেমে স্টেশনে লাগেজ লকারে ব্যাকপ্যাক রেখে আরো একবার ট্রেন চেইঞ্জ করে পৌছাতে হবে Hallstatt.
সেই গল্প না হয় আর একদিন হবে।।।
Source: Rafat Limon<Travelers of Bangladesh (ToB)