অনিন্দ সৌন্দর্যের অধিকারীনী সাজেক
গত ২ টা দিন সাজেক তার সৌন্দর্যের কি দেখায়নি আমাদের?
সাজেকের নয়ানাভিরাম রাস্তা,কংলাক পাহাড় থেকে সন্ধ্যার সূর্যাস্ত,নিচের বিশাল পাহাড়,রাতের আকাশে লক্ষ লক্ষ তারা,মাঝরাতে আলোকোজ্জ্বল জোসনা,নিস্তব্ধ পাহাড়ের আড়াল থেকে হাজারো পোকামাকড়ের অজানা সব শব্দ,
সকালের সূর্যোদয় আর ভোর থেকে নিচের পাহাড়ে মেঘের সমুদ্র,
ভুল নয়,
আসলেই মেঘের সমুদ্র,
এ এক অসাধারন দৃশ্য।
ওই সব সৌন্দর্য আর মেঘের সমুদ্রের দিকে সারাজীবন তাকিয়ে থাকা যাবে।
সেটা তো আর সম্ভব না,
তাই ফিরে এসেছি নিজের ডেরায়,
ফিরে এসেই লিখতে বসেছি সাজেক এবং সাজেক ভ্রমন নিয়ে।
আমরা গত ৭ তারিখ দুপুরে সিলেট থেকে বাসে করে রওনা হই ঢাকার উদ্দ্যেশ্যে,কারন সিলেট থেকে খাগাড়াছড়ি যাওয়ার সরাসরি কোনো বাস পাইনি।
ঢাকা রাতে পৌছে আবার রাত ১১ টার শান্তি পরিবহনের বাসে করে রওনা হই খাগাড়াছড়ির দিঘীনালার পথে।
ভাড়া নেয় ঢাকা টু দিঘীনালা ৫৮০ টাকা।
শান্তি পরিবহন এই পথের একক রাজা তবে চেষ্টা করবেন শান্তি পরিবহনের এসি বাস টা তে করে যাওয়ার জন্য।
নন-এসি গুলো এত হাইক্লাস না।
তবে এত দুরুত্ব যাওয়ার জন্য মোটামোটি বলা যায়।
ভোর ৭ টায় আমরা পৌছে যাই দিঘীনালায়,
সেখান থেকে ১ রাত ২ দিনের জন্য চান্দের গাড়ী ভাড়া করে রওনা হই হাজাছড়া ঝর্না দেখার উদ্দ্যেশ্যে,
১৫ মিনিট গাড়ী করে যেয়ে নেমে যাই,শুরু হয় হাজাছড়া যাওয়ার জন্য হাটা,
১৫ মিনিট উঁচুনিচু পাহাড় আর পাহাড়ী ছড়া পাড় হয়ে হঠাৎ শোনি সেই হাজাছড়ার ঝিরিঝিরি শব্দ,
কিছুক্ষন পরে সামনে এসে হাজির হয় প্রানবন্ত হাজাছড়া ঝর্ণা।
এককথায় অসাধারন।
কিছুক্ষন হাজাছড়ার সৌন্দর্য দেখে আমাদের তাড়াতাড়ি আবার রওনা হতে হয় কারন ১০:৩০ বেজে যাচ্ছিলো,
এই স্কট টা মিস হয়ে গেলে আবার ৩ টার টা ধরতে হতো।
চান্দের গাড়ী তে করে চলে আসি বাঘাইহাট,
ওখানে সকালের নাস্তা সেরে নেই এবং এইখান থেকেই দুপুরের খাবার ও কিনে নেই,যদিও খাবার এতটা ভালো লাগেনাই।
তাই হোটেলের নাম বললাম না।
সাথে করে নিয়ে নেই শোকনা খাবার এবং পর্যাপ্ত পরিমান পানি কারন সাজেকে পানির মূল্য চড়া খুব।
সবকিছু নিয়ে রওনা হই সেই সাজেকের উদ্দ্যেশ্যে।
কিছু জায়গা যাওয়ার পর এন্ট্রি করে নেই সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে,
তারপরেই শুরু হয় মূলত আমাদের সাজেকের যাওয়ার পথ।
সাজেকে যাবেন আর চান্দের গাড়ীর বাইরে অথবা ছাদে বসে যাবোনা,সেটা কি হয়?
হয়না,তাই ভিতর থেকে চলে আসলাম চান্দের গাড়ীর বাইরে,
২ ঘন্টার পথ পুরোটাই দেখলাম বাইরে থেকে,
যারা ভিতরে বসেছিলেন তাদের ভ্রমনটাই মাটি।
সাজেক যাওয়ার রাস্তা টা এতটাই সুন্দর যে আমাদের সব কষ্ট ওই রাস্তাটাই পুষিয়ে দিয়েছিলো,বাকি যা পেতাম সবই হতো আমাদের জন্য বোনাস কিন্তু চিন্তা ও করিনি সাজেক তার আমাদের এত সুন্দর রুপ দেখাবে আর এত এত বোনাস দিবে।
প্রতিটা মুহূর্তে সাজেক আমাদের তার সৌন্দর্য এর বোনাস দিয়েছে।
আকাবাকা,উঁচুনিচু রাস্তা আর পাহাড় দেখতে দেখতে পৌছে যাই সাজেক,
অসম্ভব সুন্দর রুইলুই পাড়া।
২০ টাকা করে এন্ট্রি ফি এবং চান্দের গাড়ীর ১০০ টাকা পার্কিং খরচ দিয়ে ঢুকে পড়ি রুইলুই পাড়াই,
গিয়ে উঠি আগে থেকে বুক করে রাখা সাজেকের অন্যতম বেস্ট রিসোর্ট এবং কটেজ জুমঘরে।
দিপু শিকদার ভাই,যিনি জুমঘর কটেজের মালিক,ভাইয়ের জন্যই মূলত আমাদের জুমঘর কটেজ টা পাওয়া,ভাই নিজে আমাদের জন্য রুম ম্যানেজ করেছেন,
ভাই,আমরা কৃতজ্ঞ আপনার কাছে।
যারা যাবেন তারা পারলে ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করে যাবেন।
জুমঘরের ম্যানেজার অসম্ভব অতিথিপরায়ন।
জুমঘরের বারান্দাটা হচ্ছে তার সবচেয়ে বেস্ট পার্ট।
যেখান থেকে দাড়িয়ে শুধু সাজেক না,ভারতের মিজুরামের বিশাল পাহাড় পর্যন্ত অবলোকন করা যায়,
এ এক হৃদয়ছোয়া দৃশ্য।
ফ্রেশ হয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি সূর্যাস্ত দেখার উদ্দ্যেশ্যে,গন্তব্য সাজেকের সবচেয়ে উচু পাহাড় কংলাক পাড়া।
প্রায় ৩০-৪০ মিনিট সাজেকের অনিন্দ সুন্দর চারপাশ দেখতে দেখতে পাহাড় বেয়ে বেয়ে উঠে যাই কংলাক পাড়ার চুড়ায়।
সেখান থেকে সূর্যাস্ত টা যে দেখতে কেমন লাগে সেটা বলে বুঝানো সম্ভব না।
সূর্যি মাম পুরোপুরি ডুবার আগেই রওনা হয়ে যাই আবার রুইলুই পাড়ার উদ্দ্যেশ্যে,
সন্ধ্যা হয়ে গেলে আসাটা কষ্টদায়ক হয়ে যেত।
রুইলুই পাড়ায় পৌছেই চলে যাই রাতের খাবারের অর্ডার করার জন্য।
সাজেকে খাবার দাবারের অর্ডার আগে করতে হয়,নয়তো পরে পাওয়া যায়না।
রাতের খাবারর অর্ডার করি অমেগা রেস্টুরেন্টে,
সেটা রুইলুই পাড়ায় ঢোকার শুরুতেই সাজেক রিসোর্ট এর কাছেই।
রেস্টুরেন্টের মালিক দিদির ব্যবহার যেমন অতিথিপরায়ন ঠিক তেমনি উনার রুচিবোধ ও চমৎকার।
সেটা উনার রেস্টুরেন্টে ঢুকলেই বুঝবেন।
আমার কাছে মনে হয়েছে সাজেকে সুন্দর করে সাজানো,রুচিশীল মাএ ২-৩ টা রেস্টুরেন্ট রয়েছে,
দিদির অমেগা তার মধ্যে একটি।
আর দিদির হাতের রান্না করা জুমভাত,ডিমবাজি,মিষ্টি কুমড়ার একটা অন্যরকম সবজি আর ডাল,
আহ,সেতো অমৃত সমতুল্য।
আসলেই অমৃততুল্য,
মিথ্যে বলছিনা।
রাতের খাবার পর্ব সেরে চলে যাই প্রায় হেলীপ্যাড এর কাছাকাছি,
ওইখানের রাস্তায় ই শোয়ে পড়ে দেখতে থাকি রাতের আকাশের লক্ষ লক্ষ তারা,
মনে শুধু আফসোস ছিলো,জোসনা দেখা হলোনা,
আল্লাহ হয়তো আমাদের সাজেকের জোসনা না দেখিয়ে ফিরতে দিবেন না বলেই হঠাৎ রাত ১০ তার দিকে পূর্ব দিক থেকে আকাশে ভেসে উঠে সেই জোসনা,
আর দেরী নয়,জোসনা উপভোগ করবো জুমঘরের বারান্দা থেকে,তাই সবার ভো দৌড় কটেজে।
গিয়ে সবাই বসে পড়ি কটেজের বারান্দায়,
সামনে বিশাল পাহাড়,খোলা আকাশর সমুদ্র,তার সাথে আকাশের লক্ষ লক্ষ তারার সাথে একটা ইয়া বড় চাদ,
আপনারাই বলেন জীবনটা কে উপভোগ করতে আর কি বেশী কিছু লাগে?
না লাগেনা,
তারপরো মনে হয় সাজেক পণ করেছিলো আমাদের তার সৌন্দর্যের আরও রুপ দেখাবে।
তাই চাদ দেখতে দেখতে ঘুমোতে গেলাম।
খুব টেনশনে ছিলাম ঘুমোনোর সময় কারন একটাই সকালে উঠে নিচের ভেসে থাকা মেঘের সমুদ্রের দেখা পাবো কিনা।
ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলাম,
ঘুম ভাংলো সকাল ৫:১৫ মিনিটে মোবাইলের এলার্মে,
কাছের দরজা দিয়ে দেখলাম আলো ফুটছে আকাশে।
সবাইকে ঘুমে রেখেই চলে গেলাম একা একা কটেজের বারন্দায়,
বারান্দায় এসে যা দেখেছি তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম আমি।
আমি একা বারান্দায় দাড়িয়ে,
আর আমার সামনে ভাসমান সাদা মেঘের সমুদ্র।
মেঘের কারনে নিচের পাহাড়ের কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না।
এত মেঘ।
স্তব্ধ হয়ে শুধু দাড়িয়ে ছিলাম কিছু সময়,নিজের চোখকেই নিজের বিশ্বাস হচ্ছিলো না।
তাড়াতাড়ি করে সবাইকে ডেকে তুলে,ফ্রেশ হয়ে গেলাম হেলীপ্যাডে,
ভোর আর সূর্যোদয় টা কে আরও ভালোভাবে দেখতে,
হেলীপ্যাডে গিয়ে ও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না,কারন চারিদিকে সাদা মেঘের ভেলা আর তার মাঝখানে আমরা গুটিকয়েক নগন্য মানুষ পাহাড়ের উপর দাড়িয়ে।
অনেকটা সময় সেখানে কাটিয়ে সূর্যোদয় দেখে আবার চলে আসি আমাদের কটেজের বারান্দায়।
সেখানে এসে মনে হচ্ছিলো মেঘ আমাদের হাতের মুঠোয় ই চলে আসছে।
এতটা কাছে ছিলো নিচের মেঘমালা,
সাদা মেঘের সমুদ্র আর রৌদ্র,
দুইয়ে মিলে আমাদের চোখ ঝলসিয়ে দিচ্ছিলো।
এমন স্বর্গীয় দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে ফিরে আসার সময় হয়ে গিয়েছলো সেটা বুঝতেও পারিনি।
ফিরতে ইচ্ছে করছিলোনা এমন সৌন্দর্য কে ছেড়ে আসতে।
তারপরো তো আসতে হবে তাই ইচ্ছের বিরুদ্ধে ব্যগ গুছিয়ে সেরে নিলাম সকালের নাস্তা।
তারপর আবার উঠে পড়লাম চান্দের গাড়ীতে।
আবারো সাজেকের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে ফিরে এলাম খাগাড়াছড়ি,
খাগাড়াছড়ি থেকে চট্রগ্রাম আর চট্রগ্রাম থেকে সিলেটে নিজের বাসায়।
এ এক মনভোলানো ভ্রমন ছিলো,
পথের ক্লান্তি একটু ও ক্লান্ত করেনি।।
সাজেক তার সৌন্দর্য দিয়ে সব ক্লান্তি ভুলিয়ে দিয়েছে।
আল্লাহ কত মহান,আমাদের এমন সৌন্দর্য অবলোকন করাচ্ছেন।
আরও দেখতে চাই,আরও ঘুরতে চাই।