উত্তরে তাকাতে ভারতে প্রবেশের বিশাল গেট নজরে পড়ল

বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন শেষ করে উত্তরে তাকাতে ভারতে প্রবেশের বিশাল গেট নজরে পড়ল। আমার শরীর জুড়ে তখন শিহরণ। শিহরণের কারণ অবশ্য বিদেশ ভ্রমণ নয়, শিহরণের কারণ বর্ডার পার হলেই যে জেলাটায় পা রাখব তার নাম দার্জিলিং। সত্যজিৎ রায়ের দার্জিলিং। অবশ্য দার্জিলিং জমজমাট গল্পের প্রেক্ষাপট যে দার্জিলিং শহরকে ঘিরে সে শহর এখান থেকে বেশ দূরে।

ভারতের ইমিগ্রেশন শেষ করতে খুব বেশী সময় লাগল না। সকাল সকাল চলে এসেছি বলে ভীড় বেশ কম। বাংলাবান্ধা পেছনে ফেলে ততোক্ষনে আমরা ফুলবাড়িতে। শুধু জায়গা নয়, সাথে পরিবর্তন এসেছে সময়েও। বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন অফিসে ঘড়িতে দেখেছিলাম সাড়ে নয়টা বাজে। এখন সাড়ে নয়টা বাজতে আরও আড়াই মিনিট বাকি। বিদেশ ভ্রমণের সাথে টাইম ট্রাভেলও হয়ে যাচ্ছে।

ফুলবাড়ি থেকে শিলিগুড়ি যেতে সময় লাগে বিশ মিনিটের মতো, আর শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটক চার ঘন্টার পথ। পুরো পথে সঙ্গী হিসেবে থাকে তিস্তার সবুজ পানি। টাটা সুমো জিপের নেপালি ড্রাইভার তখন হিন্দী ক্লাসিক গান বাজাচ্ছে। আমি মুগ্ধ চোখে তিস্তার দিকে চেয়ে আছি। কতোক্ষণ সেভাবে পেরিয়ে গিয়েছে জানি না, হঠাৎ করেই তিস্তার বুকে বিশাল এক কনক্রিটের স্থাপনা আমার ফুড়ফুড়ে মনটাকে বিষন্ব করে তুলল।

হায় তিস্তা ব্যারেজ! ড্রাইভার হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবু, কী হয়েছে? হঠাৎ করে বিষিয়ে গেলেন যে?’ জবাব দিলাম বাংলায়, ‘তোমার দেশে তিস্তার পানি মাতলামো করে আর আমার দেশে তিস্তা ধূ ধূ করে।’

সিকিম রাজ্যে প্রবেশের জন্য বিদেশীদের আলাদা পারমিশন নিতে হয়। সেটা দেশ থেকেই নেয়া যায় কিন্তু সময় বেশী লাগে। ঝামেলা করতে চাইনি, সিকিম বর্ডারে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটা চেকপোস্ট আছে, নাম রংপো চেকপোস্ট। সেখানকার ফরেন রেজিস্টার অফিসে যাওয়ার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে একজন অফিসার নিজেই ফর্ম পূরণ করে পাসপোর্টে সিকিমের অ্যারাইভাল সিল লাগিয়ে দিল।

সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকে যখন পা রাখলাম তখন শেষ বিকেল পেরিয়ে গিয়েছে। শিলিগুড়িতে দেরী না করলে আরও অনেক আগেই চলে আসতে পারতাম অবশ্য। ভারতে পা রাখার সময় যে শিহরণটা শরীরে বয়ে গিয়েছিল সেটা আরও একবার বয়ে গেল পুরো শরীর জুড়ে।

এই গ্যাংটকেই তো ফেলুবাবু গন্ডোগলের সমাধান করে গিয়েছিলেন। সত্যজিত রায়ের লেখা গ্যাংটকে গন্ডগোল গল্পটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমাদের হোটেল এমজি মার্গে, স্থানীয়রা বলে ম্যাল রোড। গুগল ম্যাপ বের করে সেদিকে হাঁটতে শুরু করে দিলাম, ইচ্ছে করেই টেক্সি নিইনি। পুরো শহরটা পাহাড়ের ওপর, কাঠের বাড়ি বেশীরভাগ কিন্তু পাঁচছয়তলা বিল্ডিংয়ের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। রাস্তাগুলো হয় উপরে উঠেছে নয়তো সোজা নিচে নেমে গিয়েছে, সবগুলো দোকানের সাইনবোর্ড ইংরেজিতে। যাবার পথে বেশ কয়েকটা রেস্তোরাঁ চোখে পড়ল। সবগুলোই রেস্টুরেন্ট এন্ড বার। আমাদের দেশী ভাইরা কেন এদেশে এসে অ্যালকোহলের প্রতি এতো ভালবাসা দেখান সেটাও বেশ বুঝতে পারলাম বেশ ভালোমতোই, সহজলভ্যতা।

গ্যাংটকে তাপমাত্রা তখন ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। একজন বাংলাদেশীর জন্য সেটা একদম হাড় কাঁপানো। সেই হাড় কাঁপানো শীতের মাঝেই ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠেছি। উদ্দেশ্য একটাই, কাঞ্চনজঙ্গা।

কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার জন্য অবশ্য বেশীদূর যাবার প্রয়োজন নেই। হোটেলের বারান্দায় দাঁড়ালেই চোখের সামনে ধরা দেয় সোনালী দেবতা, কাঞ্চনজঙ্ঘা। কাঞ্চনজঙ্ঘা কেন কাঞ্চনজঙ্ঘা সেটা একদম প্রথম দেখাতেই বুঝে গেলাম, ভোরের আলো পুরো পর্বতটাকে যেন সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দিয়েছে। কাঞ্চন শব্দের অর্থ সোনা। দার্জিলিং আর গ্যাংটকের আদিবাসিরা তো সাধে এই কাঞ্চনদেবের পূজো করতো না আগে, ভোরের আলোয় যখন পুরো পর্বত সোনায় মুড়িয়ে যায় তখন যে কেউ তাকে দেবতা ভেবে ভুল করবে। এই সৌন্দর্য স্বর্গীয়।

সেই সৌন্দর্য দেখে মনের অজান্তেই আবৃত্তি করতে শুরু করে দিয়েছি,

অভিহিতকরণের সঠিক ভাষা, সঙ্গা
আজও অজ্ঞেয়; তুমি একমেবঅদ্বিতীয়ম,
কেবল কাঞ্চনজঙ্ঘা।

সিকিম রাজ্যে মোট জেলা চারটি। নর্থ সিকিম, সাউথ সিকিম, ইস্ট সিকিম, ওয়েস্ট সিকিম। আমি যাব নর্থ সিকিমের লাচুংয়ে। এখানে যাবার জন্য আবার আলাদা করে পারমিশন নিতে হয় গ্যাংটক থেকে।

গত সন্ধ্যায় হোটেলে এসে রিসিপশনে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়েছিলাম, ওরাই পারমিশনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সকালে তখনো কাঞ্চনজঙ্ঘার রেশ কাটিয়ে উঠতে পারিনি, এরমাঝেই জিপ নিয়ে গেদে হাজির হলো। গেদে আমাদের গাইড। শরীরে গোর্খা আর তিব্বতীদের মিশ্র রক্ত বইছে। হ্যাংলা পাতলা শরীরের সাথে দিলখোশ হাসিটায় বেশ লাগে লোকটাকে।

গ্যাংটক থেকে লাচুং একশো ষোল কিলোমিটার দূরে। পাহাড়ি রাস্তায় যেতে হয় বলে সময় লাগে প্রায় আটঘন্টা। লাচুং কোন শহর নয়, একটা গ্রাম। আমাদের গন্তব্য লাচুং থেকে আরও দূরে, ইয়ামথাং ভ্যালিতে। সেখানে যাবার জন্য লাচুংয়ে একরাত কাটানো আবশ্যক।

কারণ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গ্যাংটক প্রায় ৫৫০০ ফুট, আর ইয়ামথাং ভ্যালি ১৬৮০০ ফুট। সেখানে সুস্থভাবে পৌঁছাতে হলে আগে শরীরকে উচ্চতার সাথে মানিয়ে নেবার সময় তো দিতে হবে। গ্যাংটক ছাড়ানোর একটু পর থেকেই কানে তালা লাগতে শুরু করে দিয়েছে। গেদে আমাকে অস্বস্তিতে দেখে বলল, “সাহাব, ঢোক গিলেন, ঠিক হয়ে যাবে।“ আমার চট করে আরও একবার গ্যাংটকে গন্ডগোলের কথা মনে পড়ে গেল। এভাবেই তো ফেলুদা তোপসেকে কানে তালা লাগার সমাধান দিয়েছিলেন।

ওয়েদার রিপোর্টে আগেরদিন দেখেছিলাম আজ আকাশ মেঘলা থাকবে। দুপুরের দিকে মেঘলা আকাশ তার আসল রূপ দেখাল, বর্ষা। পানির সাথে পড়ছে কুচি কুচি বরফ, শুভ্র বৃষ্টি। আমার প্রথম তুষারপাত দর্শন। গেদে বৃষ্টির কারণে বেশ বিরক্ত, বরফকুচি মেশা পানিতে গাড়ির উইন্ডশিল্ড ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে বারবার। আমি গেদের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। গেদেকে বাংলাদেশের বৃষ্টির গল্প শোনালাম। বললাম, আমার দেশে বৃষ্টি মানে প্রেম, বৃষ্টি মানে স্মৃতিবিলাস।

ছোটবেলায় কীভাবে বৃষ্টিতে গোসল করতাম সে গল্প শোনালাম ওকে। গোসলের কথা শুনে গেদে শিউরে উঠল। এখন তাপমাত্রা শূণ্যের চেয়েও দশ ডিগ্রি নিচে। এদেশের মানুষ বৃষ্টিতে গোসল করার কথা শুনে শিউরে না উঠলে কে শিউরে উঠবে? ওর শিউরে ওঠা মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে গান ধরলাম,

ভিজে হাওয়ায় থেকে থেকে
কোন সাথী মোর যায় যে ডেকে
একলা দিনের বুকের ভেতর
ব্যাথার তুফান তোলে, তোলে . . .

বিকেল নাগাদ কালো মেঘ সরে গেল। রোদ আর উঠেনি অবশ্য। এরমাঝে ল্যান্ড রোভারের জানালা দিয়ে থেকে থেকে দূরে ইয়ামথাং ভ্যালির সাদা পর্বতচূড়োগুলো দেখা যাচ্ছে। লাচুং পৌঁছতে আর বেশী সময় বাকি নেই। সারাদিনের জার্নিতে শরীর একদম ক্লান্ত, চোখ বুজলেই ঘুম চলে আসবে এমন অবস্থা কিন্তু চোখ বুজতে পারছি না। গেদে হেসে বলল, “ঘুমানোর চেষ্টা করে লাভ নেই, বাবু। সিকিমের সৌন্দর্য আপনাকে ঘুমুতে দেবে না একদম।” জবাবে আমি একটা আত্মতৃপ্তির হাসি হাসলাম। আহা এ বসুন্ধরা!

Share:

Leave a Comment