কলোসিয়াম

গ্ল্যাডিয়েটর’ – রোমের নাম শুনলেই প্রথমেই এই শব্দটাই আমার মাথায় আসে । আর গ্ল্যাটিয়েটদের মল্লযুদ্ধের সবচেয়ে অভিজাত স্থান হচ্ছে ‘কলোসিয়াম’, যাকে প্রাচীন রোমের অন্যতম সেরা আইকন বলা যায় । মজার ব্যপার হলো এর আসল নাম কিন্তু কলোসিয়াম না, এই নামটি এসেছে কলোসিয়াম তৈরীর প্রায় এক হাজার বছর পরে, এর সামনে রোমের অন্যতম কুখ্যাত সম্রাট ‘নীরো’র বিশাল এক মুর্তি স্থাপন করার পর । Collosseum তৈরীর সময় একে বলা হতো এম্ফিথিয়েটার, যার মানে হচ্ছে অর্ধবৃত্ত । ওভাল আকৃতির গোলাকার পুরো কলোসিয়ামটি আদতে দুটি অর্ধবৃত্তের সংযোগ বলে একে এ নামে ডাকা হতো । আরোও মজার ব্যপার হলো বিশাল এই এম্ফিথিয়েটার কিন্তু কোন রাজা কিন্তু সম্রাট তৈরী করেন নি । এটি আদতে তৈরী করা হয়েছিল প্রাইভেট প্রোপার্টি হিসেবে । তখনকার রোমার সমাজে রাজনীতিতে আসার এবং উপরে ওঠার জন্য সাধারণ রোমান জনগনের (Public) জন্য কাজ করাটা জরুরী ছিল, কারণ রোম তখন ছিল Republic । সুতরাং, রাজনৈতিক উচ্চাকাংখার অংশ হিসেবে রোমের ফ্লাভিয়ান পরিবারের পক্ষ থেকে আজ থেকে প্রায় একুশ শ বছর আগে তৈরী করা হয় বিশাল আকারের এই ‘এম্ফিথিয়েটার’, যেন রোমানরা আরাম করে গ্ল্যাডিয়েটর যুদ্ধ দেখতে পারে । তবে এতে শুধু যে গ্ল্যাডিয়েটর ফাইটই হতো তাই নয়, রাজসিক এই এরিনায় আরোও হত বাঘ-সিংঘ সহ আরোও নানান বুনো প্রাণীর যুদ্ধ, রাজকীয় প্রাণদন্ড সহ এমনকি তৈরীর পর প্রথম কিছু বছর বিশাল এই এম্ফিথিয়েটারে বিশেষ প্রক্রিয়ায় পানি দিয়ে ভর্তি করে এখানে যুদ্ধ জাহাজ দিয়ে ন্যাভাল ব্যাটলেরও আয়োজন করা হয়েছিল ! বিশাল এই স্থাপনা তৈরীর সুফলও অবশ্য ফ্লাভিয়ান পরিবার হাতে হাতেই পেয়েছিল । ব্যপক জনসমর্থন নিয়ে সিনেটর থেকে এই পরিবারের সদস্য হিসেবে ‘ভেসপসিয়ান’ রোমের সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হন, যিনি শুরু করেন ‘ফ্লাভিয়ান ডাইনেস্টি’ যেখান থেকে পরবর্তিতে এই পরিবার থেকেই রোমের চার চারজন সম্রাট আসেন ।
.
সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, প্রকৌশল বিদ্যা আর নিখুঁত ব্যবস্থাপনার এই এম্ফিথিয়েটারে এক সাথে প্রায় ৮০ হাজার লোক বসে প্রদর্শনী উপভোগ করতে পারত । বিশাল সংখ্যক এই দর্শক এম্ফিথিয়েটারে ঢুকতে লাগত মাত্র ২০ মিনিট – এতটাই নিখুঁত ছিল এর নির্মান ও ব্যবস্থাপনা ! চিন্তা করলে অবাক লাগে এযুগেও আমরা যেখানে স্টেডিয়ামে মাত্র বিশ-পঁচিশ হাজার লোকের ব্যবস্থাপনা করতে ঘেমে যাই, সেখানে দু-হাজার বছর আগে রোমানরা কিভাবে এত লোকের নিখুঁত ব্যবস্থপনা করত !
.
এম্ফিথিয়েটারের প্রতিটি দর্শকের জন্য ছিল টিকেটের ব্যবস্থা । পশুর হাড়, চামড়া ইত্যাদির উপর গেট আর সিট নম্বর লিখা থাকত । প্রতিটি সারির লোকেরা যেন অন্যদের কোন অসুবিধা ছাড়াই নিজ নিজ সারির সিটে যেতে পারে, তার জন্য গ্যালারীর নীচের অংশে সুড়ংগ ধরণের চলাচলের ব্যবস্থা ছিল । সুড়ংগ দিয়ে লোকেরা গ্যালারী নিচ দিয়ে হেটে গিয়ে যার যায় সিটের সারিতে উঠে যেতে পারত । এই সুড়ংগগুলোকে বলা হত ‘ভমিতারিয়েত’, অর্থাৎ নীচ থেকে উপরে উঠে আসা । এখান থেকেই ইংলিশে ‘ভমিট’ (অর্থাৎ বাংলায় ‘বমি’) কথাটা এসেছে, যার মানে হচ্ছে নীচ থেকে উপরে উঠে আসা !
.
এম্ফিথিয়েটারের মধ্যখানের মূল অংশটা, যেখানে ফাইট হতো, থাকত বালু দিয়ে ঢাকা । কয়েকদিন পর পর প্রদর্শনী-যুদ্ধে হেরে যাওয়া পশু আর মানুষের রক্তে ভেজা বালুগুলোকে বদলে নিয়ে আসা হতো ফ্রেশ বালু । ল্যাটিন ভাষায় ‘বালু’কে বলা হয় ‘এরিনা’ । মধ্যখানের প্রদর্শনের স্থানটা বালু দিয়ে ঢাকা থাকত বলে আস্তে আস্তে সেখান থেকেই যে কোন প্রদর্শনীর জায়গাকে ‘এরিনা’ বলে ডাকা শুরু হয় ।
.
অফিসের কাজে গিয়েছিলাম ডেনমার্কে । সেখান থেকে সপ্তাহখানেকের ছুটি কাটাতে ইতালী । কোপেন হেগেন থেকে মিলানে দু-ঘন্টার ফ্লাইট মাত্র । মিলানে কয়েকদিন ঘুরাঘুরি শেষ করে ৩ ঘন্টার হাইস্পীড ট্রেনে রোম । রোমে বেড়াতে যাবার প্ল্যান করার সাথে সাথে আমার লিস্টের এক নম্বরে ছিল এই ‘কলোসিয়াম’ খানা । রোমে পৌঁছার তৃতীয় দিন দুপুরে যখন কলোসিয়ামের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম তখন রোমান শরৎ-এর মিষ্টি পরিষ্কার রোদে একুশ শ’ বছরের পুরোনো এই কলোসিয়াম খানা যেন রাজসীক ভংগীতে তাঁর আভিজাত্য আর গাম্ভীর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । আগে টিভিতে, ছবিতে শত বার কলোসিয়াম দেখলেও সামনা সামনি দেখে আমি যেন আক্ষরিক অর্থে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম কয়েক মিনিটের জন্য ! কেন ? সেটি নিজের চোখে না দেখলে ঠিক বলে বোঝানো সম্ভব নয় । সে এক অদ্ভুত অনুভূতি ! নীচ তলা থেকে হেঁটে হেঁটে যখন কলোসিয়ামের পেটের ভেতর ঢুকছিলাম, তখন যেন হাজার বছরে পুরানো বাতাস ভর করে নাকে ভেসে আসছিল শত শত গ্ল্যাটিয়েটরের রক্ত আর ঘামের গন্ধ, রক্তোন্মাদ হাজার হাজার দর্শকের উন্মোত্ত চিৎকারের শব্দ, মল্ল যুদ্ধে হেরে মাটিতে পরে থাকা কোন এক গ্ল্যাডিয়েটরের জীবন-মৃত্যু নির্ধারণী কন্ঠ ভোটের গর্জন – Vivet (Live) কিংবা Occidere (Kill), আহত পশুর গোংগানী, আর বিজয়ীর বিজয়াল্লাস !
.
সেখান থেকে ‘ভমিতারিয়েত’ পারি দিয়ে গ্যালারী, আর ‘এরিনার’ ঠিক সামনে । সাথে থাকা গাইড চরম নাটুকে বর্ণনায় বলে যাচ্ছে রক্ত-ঘাম-মৃত্যু চিৎকারে ভেজা রাজকীয় এই বিস্ময়কর স্থাপনার উত্থান-পতনের গল্প । আমি ভীড় ছেড়ে একা একা চলে এলাম এক পাশে, বেলে পাথরের দেয়াল ধরে দাঁড়ালাম গ্যালারীর এক আলাদা অংশে যেখানে কেউ নেই । উপরে নীল আকাশ, দু একটা ঈগল উড়ছে, গায়ে লাগছে রোমান শরতের বিকেলের হিম হিম বাতাস, পায়ের নীচে দু-হাজার বছরের পুরানো পাথরের স্পর্শ ! কলোসিয়ামের এরিনায় আমার চোখ আর যেন কানে যেন ভেসে আসছিল ইথারে ভেসে বেড়ানো সহস্র বছর আগের এই এরিনায় দাঁড়ানো শত শত অকুতভয় গ্ল্যাটিয়েটরদের জীবনপন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরার আগ মুহুর্তে দর্শকদের উদ্দেশ্যে জানানো সেই হৃদয়-কাঁপানো অভিবাদন “Those who are about to die, salute you!

Post Copied From:Galib Bin Mohammad‎>Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment