কাঞ্চনজঙ্ঘা ভ্রমণ ট্রান্সপোর্ট

সকাল ৮.১৫ তে চিলাহাটি নেমে লোকাল ট্রান্সপোর্ট নিয়ে পঞ্চগড় পৌঁছাই। তারপর পূর্ব নির্ধারিত পাগলুতে ( cng এর লোকাল নাম) করে বাংলাবান্দা (ওপারে ফুলবাড়ি) বর্ডারে গিয়ে নামি বেলা ১২ টার দিকে। বর্ডারের ঝামেলা শেষ করে ওপাস থেকে জিপে করে শিলিগুড়িতে পৌছুতে বেজে গেল বেলা ২ টার কিছু বেশি। সেখান থেকে জিপ নিয়ে রওনা দেই ইয়ুকসামের উদ্দেশ্যে।

আবহাওয়া খুব একটা সুবিধার ছিল না। আকাশে মেঘ, ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি মুডটাই খারাপ করে দিচ্ছিল। ট্রেক লিডার সৈকত দার সাথে আড্ডা দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম ইয়ুকসামের দিকে। শিলিগুড়ি ছাড়তেই শুরু হল পাহাড়ি রাস্তা। এঁকে বেঁকে চলে গেছে পাহাড়ের মাঝ দিয়ে। প্রথমে বান্দরবানের রাস্তা ভেবে ভুল হতে পারে কারও কারও। কিন্তু সে ভুল ভাংতে সময় লাগবে না বেশী। সুন্দর রাস্তা। পাশ দিয়ে দুর্দান্ত গতিতে বয়ে চলেছে তিস্তা নদীর আপার স্ট্রিম। রাস্তার অন্য পাশে সবুজ পাহাড়। থেকে থেকে পাহাড়ের বুক চিরে বেরিয়ে এসেছে সুন্দর কিছু ঝর্ণা। শেষ বিকেলের ম্লান রোদে ঝর্ণা গুলো আছড়ে পড়ছে তিস্তার প্রবল প্রবাহতে।

সবুজ পাহাড় আর তিস্তা ছাড়াও আরেকটি বস্তু কারও চোখ এড়াবে না। বস্তু নয়, আসলে সেটি একটি প্রাণী। “বানর”। প্রচুর পরিমাণে। রাস্তার এপাশ ওপাশ জুড়ে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রচুর বানর। ছবি তোলার কন্টেট পেয়ে যাবেন অনেকে আশা করি। মাঝে কোথাও যদি গাড়ি থামিয়ে বিকেলটা উপভোগ করতে চান তবে বানর, তিস্তা আর ওপাশের সবুজ পাহাড় আপনাকে হতাশ করবে না। আর তিস্তা বাঁধ টি বেশ সুন্দর। তবে কাছে যেতে পারবেন না।

সন্ধার আগ দিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম সিক্কিমে ঢোকার চেকপোস্ট মেলি তে। সেখানে কামকাজ শেষ করে আবার চড়ে বসি জিপে। ( বিঃদ্রঃ শিলিগুড়ি থেকে জিপে উঠার আগে অবশ্যই পাসপোর্ট, ভিসা পাসপোর্ট এর ফটোকপি আর নিজের পাসপোর্ট সাইজের ছবি নিজের কাছে রেখে গাড়িতে উঠবেন। যদি সেগুলো ব্যাগে থাকে আর ব্যাগ যদি গাড়ির উপরে বেধে দেন, তাহলে অজানা ভাষায় ড্রাইভারের গালাগাল শুনতে হবে।)

সন্ধ্যে উতরে গেছে ততক্ষণে। লম্বা জার্নিতে ঝিমুনী চলে এসেছে। গাড়ির ভেতরে বসে বসে কানে হেডফোন গুঁজে ঝিমুচ্ছি। হঠাৎ ব্রেক। সামনেও একটি দুটি গাড়ি থেমেছে। কি হয়েছে এই নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছি। সৈকত দা বলল, ” ল্যান্ড স্লাইড”। বলে সামনে গাড়ির হেড লাইটের আলোয় রাস্তায় পড়ে থাকা কিছু আলগা পাথর দেখিয়ে দিলো। ড্রাইভার আগেই ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে নেমে গেছে গাড়ি থেকে। আমাদের মধ্যে সাহসী দুজন আসিফ আর মিশুও এগিয়ে গেল ব্যাপারটা দেখতে। মনে মনে ভাগ্যকে দুষছি, “কি কুক্ষণে এই ডেট টা বেছেছিলাম। প্রথমে ট্রেন লেট, তারপর বর্ডারে দেরি, এরপর মেল্লি চেকপোস্টে ড্রাইভারের ঝাড়ি, শেষে এই পাহাড় ধ্বস। আজকে রাতে ইয়ুকসাম পৌঁছাতে পারব কিনা কে জানে।” এর মধ্যে হুড়মুড় করে দৌড়ে গাড়িতে এসে ঢুকল আমাদের সাহসী বন্ধু দুজন। সাথে ড্রাইভারও। এবার বেশ বড়সড় পাথর পড়তে শুরু করেছে। গাড়ি স্টার্ট করেই সাথে সাথে রিভার্স গিয়ারে। আরো ২০-৩০ হাত পিছিয়ে ড্রাইভার গাড়িকে নিরাপদ দুরত্বে নিয়ে আসলো। কিছুক্ষণ পরে যখন পাথড় পড়া একটু থামল, আমাদের ড্রাইভার বাবু টিউবর্গের ক্যান খুলে ২-৪ ঢোক গিলে, বাতাসে ক্রুস এঁকে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ওই পাথরের মাঝ দিয়েই ভো-দৌড়।

সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচলাম আরকি। মনে হল বিপদ কেটে গেছে। এবার সোজা ইয়ুকসাম। কিন্তু ভাগ্যের পেটের ভিতরে কি আছে কে জানে বলুন। কিছুদুর এগোতেই আরো একটি ল্যান্ড স্লাইড। এবং আগের চেয়ে বড়। যাইহোক। আল্লাহর ইচ্ছায় সে যাত্রাতেও বেঁচে বেরুলাম। এর পর জোরেথাং পেরুতেই প্রবল বৃষ্টি। ড্রাইভারো কম যায় না। সেই পা্হাড়ী রাস্তাতেই গাড়ির স্পিড তুলে দিয়েছে ৬০-৭০। আমরা বলছি, “এই সেরেছে রে, ড্রাইভারকে বোধ হয় টিউবর্গে ধরেছে।” পরে সৈকত দা অবশ্যি বলেছিল যে, বৃষ্টিতে পাহাড় ধ্বস বেশি হয়। তাই সে জোরে চালিয়ে বিপদজনক জায়গা গুলো দ্রুত পার হচ্ছিল।

রাস্তায় দুটো ল্যান্ড স্লাইড আর ড্রাইভারের রেকলেসলি গাড়ি চালানো তে ততক্ষণে আমাদের বিচি কাঁধে উঠে গেছে। কিন্তু প্রথমবারের মত চোখের সামনে পাহাড় ধ্বস দেখাও একটা নতুন অভিজ্ঞতা। কি বলেন?

অবশেষে রাত আনুমানিক ৯.৩০ এ ইয়ুকসামে ঢুকি আমরা। সেখানে আমাদের টিমের বাকি মেম্বার দের সাথে এবং আরেক ট্রেক লিডার জয় দার সাথে দেখা হয়। কাউকেই চিনি না। আমরা রুমে ঢুকতেই সবাই নিজ নিজ রুমে চলে যায়। কেমন যেন একটা অপ্রস্তুত ভাব সবার মধ্যে।

এরপর ডিনার শেষে সানচা হান লিম্বো এবং আমাদের ট্রেক লিডার দুজন আমাদের কিছু পরামর্শ দেন। এরপর আমরা যে যার রুমে গিয়ে শেষ বারের মত নরম বিছানায় ঘুম দেই।

পরিবেশ সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন রাখুন।

Source:  Sadman Sakib‎<Travelers of Bangladesh (ToB)

 

Share:

Leave a Comment