কুমায়ুনের রাণী ‘মুন্সিয়ারি’

উচ্চতায় মাত্র ৭৫০০ ফিট! কুমায়ুনি সাম্রাজ্যের উচ্চতম স্থান। হেলাফেলা করবেন না, মুন্সিয়ারি থেকে হিমালয়ের শৃঙ্গের যা দৃশ্য – আচ্ছা-আচ্ছা, বাঘা-বাঘা ট্রেক রুটেও তা মেলে না। আর “মুন্সিয়ারি” মানে হলো বরফের দেশ, বছরের মধ্যে ৬ মাস এখানে থাকে পুরু বরফের আস্তরণ। এখানে এসে টের পেলাম পঞ্চ-চুল্লির নাম কেন পঞ্চ-চুল্লি। শেষ বিকেলের আলোয় পাঁচটা চুড়োয় যখন চোখের সামনে দাউ দাউ করে আগুন লাগে তখন অপার বিস্ময় আর মুখে কেয়া বাত ছাড়া কিছু বলার থাকে না।

চৌখরি থেকে সক্কাল সক্কাল রওনা দিল সুন্দর ভায়ার গাড়ি, ১০০ কি.মি. খাড়া চড়াই পাহাড়ি রাস্তা, পাশ দিয়ে অনেকটা সময় সঙ্গে চলল গোড়িগঙ্গা নদী। যাবে সেই মিলাম হিমবাহ অবধি। মুন্সিয়ারি পৌছনোর ৩০ কি.মি. আগে পড়ল বিরথি জলপ্রপাত, প্রায় ৫০০ সিঁড়ি ভেঙে পৌছনো যায় ঝর্নার এক্কেবারে সামনে, ২০০ ফিট ওপর থেকে নেমে আসা বিশাল জলপ্রপাতের সে কি অনাবিল সৌন্দর্য। তার নীচেই নদীর ছোট্ট মাছ আর ভাত সহযোগে ছোট্ট ধাবায় সেরে নেওয়া গেল খাওয়াদাওয়ার পর্ব। এখান থেকে গাড়ি ছাড়তেই বুঝলাম ঠান্ডার গুঁতো, আর কালামুনি টপ, এই রাস্তার উচ্চতম পয়েন্ট সেখানে পৌঁছে তো প্রায় হি-হি করছে সবাই, ব্যাগ খালি করে সব শীতবস্ত্র চাপিয়ে নেওয়া গেল। সুন্দর আমাদের পক্ষী-প্রেমী সহযাত্রী কে কথা দিয়েছিল মুন্সিয়ারি তে কালিজ ফেজান্ট দেখাবেই, কিন্তু গাড়ি একটা বাঁক নিতেই দেখা মিলল বিলুপ্ত-প্রায় পাহাড়ি শকুনের, গত রাত্রের লেপার্ডের মেরে যাওয়া মড়ির ওপরে নিশ্চিন্ত ডিনার সারছে। মুন্সিয়ারি পৌছতে প্রায় বিকেল গড়িয়ে গেল, তবে হোটেলে ঢুকেই সামনে দৃশ্য দেখে ভিরমি যাবার জোগাড়। যদিও মেঘের আস্তরণ, কিন্তু তার ফাঁক দিয়ে যা উঁকি দিচ্ছে তা যদি রেঞ্জ হয় তাহলে পরদিন সকালে রুদ্ধশ্বাস অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে!

মুন্সিয়ারি থেকেই শুরু হয়েছে অনেক ছোট বড় ট্রেক রুটের রাস্তা… বড়গুলির মধ্যে বিখ্যাত মিলাম গ্লেসিয়ার – যা তিব্বতের সাথে আদি লবণ পথের রাস্তা “জোহার” গ্রামের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে; কথিত আছে এই রাস্তা দিয়েই পাণ্ডবরা মহাপ্রস্থানের পথে শেষ যাত্রা করেছিলেন! এছাড়াও এখান থেকে যাওয়া যায় রালাম, নামিক গ্লেসিয়ার! আর আমাদের মতো কম সময় নিয়ে যারা এসেছেন, তাদের জন্য রয়েছে খালিয়া টপের ৫ কি.মি. ট্রেক অথবা মাহেশ্বরী কুন্ডের মতো ২ কি.মি.-এর ট্রেক। জঙ্গুলে রাস্তার মধ্যে দিয়ে পঞ্চচুল্লীর রুপ দেখতে দেখতে এগিয়ে চলা এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা! আর খালিয়া টপে রাত্রিবাসের জন্য রয়েছে কে এম ভি এনের অ্যাল্পাইন রিসোর্ট। মাহেশ্বরী কুন্ডে দেখা হলো মুন্সিয়ারির গ্রামবাসী-দের নিয়ে অনেকদিন কাজ করা মল্লিকা ভির্দির সাথে… মুন্সিয়ারি থেকে ১ কি.মি. এগিয়ে সারমোলী গ্রামে এনারা হোমস্টে তৈরি করে পর্যটকদের থাকার ব্যাবস্থা করেছেন।

ভোরবেলা হোটেলের লন থেকেই দেখা গেল কিভাবে সিঁদুর রঙে রাঙা হয়ে উঠল পঞ্চচুল্লীর পাঁচটা চূড়া, তার খানিক পরেই রওনা নন্দা দেবী মন্দিরের দিকে। মন্দিরের খোলা প্রান্তরে আশ মিটিয়ে দেখা গেল পঞ্চচুল্লী রাজরম্ভা নন্দকোট চুড়ার রোশনাই! দুপুর হতে না হতেই মেঘের আনাগোনায় প্রমাদ গুনতে শুরু করলাম সবাই, কিন্তু তার একটু পরেই বইতে শুরু করল কনকনে ঠান্ডা হাওয়া আর মেঘ কাটতে শুরু করল। কে এম ভি এনের পিছন দিয়ে যে রাস্তা নেমে গেছে তা ধরে পৌঁছে যাওয়া যায় সুপ্রাচীন পান্ডে লজের সামনে দিয়ে টিবেটান বর্ডার পুলিসের ক্যাম্পের সামনে খোলা প্রান্তরে! একেবারে ১৮০ ডিগ্রী খোলা ভিউ এখান থেকে! হু হু করে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে, আশপাশ থেকে শুধুই বাংলায় কলতান – “বাবু কানটা ঢাকা দে, ঠাণ্ডা লেগে যাবে”, “তাড়াতাড়ি চল, রুমে গিয়ে সাত ভাই চম্পা দেখতে হবে”; “স্কুল খুললেই অঙ্ক পরীক্ষা, আমারই টেনশন হচ্ছে, তোর কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই” – আর সামনে মহামহিমান্বিত হিমালয়। মনে পড়ছিল একটু আগে সুন্দর বলছিল “আপ বাঙালি লোগ হি তো আতে হে, ইস ভয়ানক ওয়েদার মে, হামলোগ কো ভি রুটি-রোজি মিলতা হ্যায়, বাকি সিজন মে যো সব বাবুলোগ আতে হ্যায়, খালি থানে দিখাতে হ্যায়!”

খানিক পর থেকেই শুরু হল রঙের বাহার পঞ্চচুল্লীর শিখরে, ঠিক যেন কোনও শিল্পীর তুলির নিপুন আঁচড়ে পাল্টাতে থাকল রঙ! শুরুতে হলদেটে থেকে লাল হয়ে শেষে গোলাপি রঙ থেকে আস্তে আস্তে ফ্যাকাসে সাদায় রুপান্তর! এ যেন মানুষের মনের রঙ পরিবর্তনের রূপক মাত্র! আর এই মহাজাগতিক ম্যাজিকের সামনে দাঁড়িয়ে আমি মানব একাকী ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে শুধু একটাই কথা ভাবছিলাম “স্বর্গ তো এখানেই মশাই, স্বর্গ তো এখানেই!”

রাত্রে কে এম ভি এনের অনবদ্য খাবার খেয়ে সাত সকালে শুয়ে পড়া, পরদিন ভোর ভোর যাত্রা বিন্সর-এর দিকে! কে এম ভি এনের আতিথেয়তার ছোট্ট নমুনা, ওই ঠাণ্ডায় ভোর ৬টায় দরজায় চা নিয়ে ম্যানেজার হাজির, আমরা কিন্তু কিন্তু করায় বলছিলেন “হামলোগ তো হ্যায় হি আপলোগো কে লিয়ে, সরকারী নৌকরি করতে হ্যায় না!”

Share:

Leave a Comment