গোয়া ভ্রমণ বিতান্ত

ভ্রমণ পিপাসু মানুষের কাছে অবকাশের অন্যতম এক প্রধান ঠিকানা হচ্ছে সমুদ্র, অর্থাৎ সমুদ্র সৈকত। অার সমুদ্রের সাথে সাথে যদি পাহাড়, ইতিহাস অার ঐতিহ্যের মেলবন্ধন একত্রে পাওয়া যায় কোথাও, তাহলে তো সেটা হয় সোনায় সোহাগা, অভাবনীয়! ভ্রমণের জন্য তেমনি এক অসাধারণ যায়গা হচ্ছে গোয়া। গোয়া উপমহাদেশের মানুষের ভ্রমণ তালিকায় সবচেয়ে পচন্দের অার অাকাঙ্ক্ষিত স্থান গুলোর অন্যতম। অাপনি যদি গোয়া ভ্রমণে অাগ্রহী থাকেন কিংবা গোয়া সম্পর্কে জানতে অাগ্রহী, তাহলে জেনে নিতে পারেন গোয়া সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্যাদি।

গোয়া উমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ইউরোপীয় উপনিবেশ। সেটিও অাবার ছিল পর্তুগিজ উপনিবেশ! ইউরোপীয়দের মধ্যে পর্তুগিজরাই ১ম উপমহাদেশে বানিজ্য করার উদ্দেশ্যে অাগমন করেছিলেন। সুদূর পশ্চিম ইউরোপের পর্তুগাল থেকে সাগর-মহাসাগর পেড়িয়ে অারব সাগরের পূর্ব উপকূলের এই গোয়াতেই তারা ১ম অবতরণ করেছিলেন বানিজ্য করার উদ্দেশ্যে। তারপর ১৫১০ সালে স্থানীয় মিত্রদের সহায়তায় বাহমানী সুলতানের বাহিনীকে পরাজিত করার মাধ্যমে পর্তুগিজরা গোয়ায় ইউরোপীয় উপনিবেশের গোড়া পত্তন করেন। তখন থেকে দীর্ঘ ৪৫০ বছর ধরে গোয়া পর্তুগিজ উপনিবেশ হিসেবেই শাসিত হয়েছে। ভারত ভাগের অনেক পরও গোয়া পর্তুগিজদের অধীনেই ছিল। তারপর ১৯৬১ সালে ভারত সরকার গোয়াকে তাদের অংশ করে নেয়।

গোয়া অায়তনের দিক থেকে বর্তমান ভারতের সবচেয়ে ছোট প্রদেশ। এর রাজধানীর নাম পণজী। আর এর বৃহত্তম শহরটি হচ্ছে বিখ্যাত পর্তুগিজ নাবিকের নামে, ভাস্কো-দা-গামা। গোয়া শহরটি হচ্ছে খ্রিষ্টান অধ্যুষিত এলাকা। সু-দীর্ঘ কাল ধরে এখানে পর্তুগিজ উপনিবেশ থাকায় পর্তুগিজদের প্রভাবেই এই এলাকায় খ্রিস্ট ধর্মের প্রসার ঘটেছে। আর তাই গোয়ার শহরগুলোর নানা যায়গায় আজও পর্তুগিজ সংস্কৃতির প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়।

গোয়ার সমুদ্র সৈকতের জন্য সমগ্র ভারত ও ইউরোপীয়দের কাছে অাকর্ষণীয় হলেও, এই শহরে রয়েছে বেশ কিছু ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। এছাড়াও রয়েছে অনেকগুলো পুরোনো ও চমৎকার স্থাপত্য শৈলীর দৃষ্টিনন্দন গির্জা ও মন্দির। যার মধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান এবং স্থাপত্যও রয়েছে। এই শহরে রাস্তায় রাস্তায় ছোখে পড়ে অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন গির্জা। তন্মধ্যে দক্ষিন গোয়ায় অবস্থিত ১৫৯৪ সালে নির্মিত চমৎকার বাসিলিকা অফ বম জিসাস গির্জাটি অন্যতম। দেখতে চমৎকার ও বিশালাকার গির্জাটি উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীনতম গির্জাগুলোর অন্যতম। এটি ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী তালিকাভুক্ত স্থান। এই গির্জার একটি অাকর্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, এর অভ্যন্তরে বিখ্যাত খ্রিস্টীয় ধর্মযাজক সেন্ট ফ্রান্সিস জাভিয়ার-এর মরদেহ মমী করে সংরক্ষিত অাছে। সেন্ট ফ্রান্সিস জাভিয়ার এশিয়া ও অাফ্রিকার বিভিন্ন দেশে খ্রিস্ট ধর্মের প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন। গোয়ায় খ্রিস্ট ধর্মের প্রসারেও তার অগ্রণী ভূমিকা ছিল। তিনি ১৫৫২ সালে তিনি চীনে ধর্ম প্রচারকালীন সময়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।

সেখান থেকে সেন্ট ফ্রান্সিস জাভিয়ারের অনুসারী গণ তার মৃত দেহ গোয়ায় নিয়ে অাসেন এবং মমী করে এই গির্জায় সংরক্ষণ করে রাখেন। গোয়াতে গির্জার পাশাপাশি রয়েছে বেশ কিছু সংখ্যক চমৎকার অাধুনিক স্থাপত্য শৈলীর দৃষ্টিনন্দন মন্দির। যার মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত ভারতীয় কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী লতা মঙ্গাস্কারের গ্রামের বাড়ির অসাধারণ একটি মন্দির, সাদ্দা দূর্গা মন্দির ইত্যাদি।

এদিকে গোয়ায় সবচেয়ে ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি হচ্ছে, ১৬১২ সালে পর্তুগিজদের তৈরী অাগুয়াডা দূর্গ। পর্তুগিজরা এই দূর্গটি নির্মাণ করেছিলেন ডাচ এবং স্থানীয় মারাঠাদের অাক্রমন থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্য। এই দূর্গটি মান্ডবী নদীর এবং অারব সাগরের মিলনস্থল অর্থাৎ উত্তর গোয়ার সর্বকোনে অবস্থিত। এখান থেকে দাড়িয়ে অারব সাগর, মান্ডবী নদী অার গোয়া শহরের চমৎকার মেলবন্ধন একত্রে অবলোকন করা যায়। এখানে জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমা দিল চাহতা হে ছবির কিছু শুটিং হয়েছে।

গোয়ার প্রধান পর্যটন এলাকা গুলো মুলত উত্তর গোয়া জেলা ও দক্ষিন গোয়া জেলায় অবস্থিত। যা সু-প্রশস্থ মান্ডবি নদী দ্বারা বিভক্ত। এই মান্ডবী নদীর উপড় চমৎকার একটি দুলন্ত ব্রীজ সহ পাশাপাশি রয়েছে মোট ৩টি সেতু। গোয়ার দুই অংশেই রয়েছে ভারত বিখ্যাত বেশ কিছু অতি চমৎকার সমুদ্র সৈকত। যেগুলো গোয়ার প্রধান অাকর্ষণ। গোয়ায় একটি জিনিস বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করা যায়, সেটি হল সেখানে খুব বেশি সু-উচ্চ ইমারত নেই। উচু ভবন বলতে যা চোখে পড়ে তা হল ৩-৫ তলা ভবন। সেটাও পরিমানে খুবই নেহায়েত। সেখানকার বেশির ভাগ ভবনই ইউরোপীয় ধাচের কিংবা উপরে টালি দ্বারা তৈরী ১ তলা বা ২ তলা। অার অাবাসিক হোটেলের সিংহভাগই হল বাংলো প্যাটার্ণের। যার অনেক গুলোতেই রাত্রিকালীন সময়ে সরাসরি গান-বাজনা, নাইটক্লাব পার্টি সহ বিদ্যমান থাকে বিনোদনের সকল আয়োজন। সেখানে রাস্তার দু-ধারে কেনাকাটার জন্য রয়েছে অসংখ্য দোকানপাট। যার মধ্যে বিশেষ ভাবে চোখে পড়ে অসংখ্য কাজু বাদামের দোকান।

অসমতল পাহাড়ের গাঁ বেয়ে বয়ে চলা রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করতে হয় কয়েকটি দর্শণীয় স্থানে। এই শহরে বলতে গেলে কোন ট্রাফিক জ্যাম নেই। তাই নেই তেমন কোন গাড়ির হর্ণের শব্দও। মনে হয় যেন কোলাহলমুক্ত একটি শান্ত, নিরিবিলি শহর। তাই তো পুরো ভারত সহ বহিঃ বিশ্ব থেকে অসংখ্য মানুষ এখানে ছুটে অাসেন সৌন্দর্য লীলা প্রাণ ভরে উপভোগ করতে, সাময়িকের জন্য চিত্ত ডুবিয়ে নিজেকে প্রাণবন্ত করতে। তাই চাইলে অাপনিও পারেন সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য হলেও গোয়া ভ্রমণ করে অাসতে।

গোয়া ভ্রমণ সংক্রান্ত খরচাদি অন্যান্য বিষয়ঃ
গোয়ার ভ্রমণ করার জন্য অাপনাকে অবশ্যই টেক্সি ভাড়া করতে হবে। কেননা এখানকার পর্যটন স্থান গুলো দুই জেলায় অর্থাৎ উত্তর গোয়া ও দক্ষিন গোয়ায় অবস্থিত। তাই টেক্সিই সেখানে সবচেয়ে উত্তম ও কার্যকরী বাহন। তবে টেক্সি ভাড়া একটু বেশি। সেখানে তিন ভাবে সাধারণত টেক্সি ভাড়া করতে হয়। এক হচ্ছে উত্তর গোয়ার বিভিন্ন দর্শণীয় স্থান ভ্রমন প্যাকেজ, ২ হচ্ছে দক্ষিন গোয়ার বিভিন্ন দর্শণীয় স্থান ভ্রমন প্যাকেজ, এবং ৩ হচ্ছে উত্তর ও দক্ষিন গোয়ার সকল দর্শণীয় স্থান একত্রে ভ্রমন প্যাকেজ। যেকোন এক সাইডের জন্য ৩৫০০ রুপি, অার অার উত্তর-দক্ষিন দুই গোয়ার জন্য ৪৮ রুপি সরকার নির্ধারিত ভাড়া দাবি করবে টেক্সি ড্রাইভার। তবে অাপনি দর-দাম করে ভাড়া কমিয়ে নিতে পারেন। অামরা দুটি এলাকা একত্রে ৩৮০০ রুপিতে ভাড়া করেছিলাম। অার সেটি অাপনি করে নিতে পারেন বিমান বন্দর কিংবা রেলওয়ে স্টেশন থেকেই।

গোয়া ভ্রমণের জন্য ২-৩ দিনই যতেষ্ট। তবে চাইলে অাপনি একদিনেও পুরো গোয়া ভ্রমণ করতে পারবেন। তবে সেক্ষেত্রে দূরবর্তী দু-তিনটে স্থান বাদ দিতে হবে। তাই সবচেয়ে ভাল হয় ১ম দিনে উত্তর-দক্ষিন গোয়ার বিগফুর্ট মিউজিয়াম, সাদ্দা দূর্গা মন্দির, কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী লতা মঙ্গাস্কারের গ্রামের বাড়ির মন্দির, সেন্ট বাসিলিয়া গির্জা (বাসিলিকা অফ বম জিসাস), অাগুয়াডা ফোর্ট, সিনকুয়েরিম বিচ, বাগা বিচ, কালানগাট বিচ, পরিদর্শণ করতে পারেন। ২য় দিনে বাটারফ্লাই বিচ, কোলভা বিচ, ভাস্কো দ্যা গামা সিটি, ন্যাশনাল জিউলজিক্যাল পার্ক, সেন্ট জাভিয়ার গার্ডেন সহ অন্যান্য অারো দুয়েকটি গার্ডেন পরিদর্শণ করতে পারেন। অার সময়-সুযোগ থাকলে এবং চাইলে অার ১দিন যোগ করে গোয়ার রাজধানী পঞ্জি ভ্রমণ করে অাসতে পারেন।

গোয়াতে ভ্রমণের সময় একটা বিষয় খেয়াল রাখা জরুরী, সেটা হল গোয়ায় সব কিছুর দামই তুলনামূলক একটু বেশি। বিশেষত খাবারের দাম বীচ এলাকায় মারাত্বক পরিমানে বেশি। তাই খাবার খাওয়ার ক্ষেত্র অবশ্যই বীচ এলাকা থেকে পারলে কিছুটা দূরে গিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করবেন। অার থাকার জন্য সবচেয়ে ভাল হয় কোলভা বিচ এলাকা। এখানকার পরিবেশ অনেকটা নিরিবিলি। এখানে ভাড়াও তুলনামুলক কম। ১২-১৫ শত টাকায় বেশ ভাল মানের হোটেল পাওয়া যায়। যেখানে ৩ জনও থাকা যাবে স্বাচ্ছন্দ্যে।

Source: Mohammad Al-amin <Travelers Of Bangladesh (TOB)

Share:

Leave a Comment