গ্যাংটকে গণ্ডগোল ভ্রমন
হঠাৎ একদিন এক বন্ধু বলল সিকিম যাবি? আমি বললাম এইটা আবার কোথায়। বলল ভুটান আর নেপাল এর মাঝামাঝি, তিব্বত এর নিচে। কিছু ছবিও দেখাল বরফ, পাহাড় আর লেকের। বাজেট টুর হবে। আমার রোড জার্নি অপছন্দ । এর আগে একবার ভুটান প্লানে বাই এযার, বাই এযার করতে করে প্লানই বাদ হয়ে যায়। তাই এবার বন্ধু যা বলল সব রাজি রাজি বলে গেলাম। ইন্ডিয়া আমার কখনোই বিদেশ মনেহয়নি, কখনো ইন্ডিয়া যাবার ইচ্ছাও হয়নি। আমাদের মত দেখতে খয়েরি রঙের মানুষ আমাদের মত দেখতে ঘরবাড়ি, একসময় আবার একই দেশ ছিল, বিদেশ কিভাবে হয় ! আমার কাছে বিদেশ মানে সাদা সাদা মানুষ ছোট ছোট কাপড় পরে ঘুরে বেড়াবে। যাইহোক, বন্ধুর সব কিছুতে রাজি হয়ে গেলাম। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদার গ্যাংটকে গণ্ডগোল এর গ্যাংটক বলে কথা।
প্লান হল এজেন্সি দিয়ে প্যাকেজে যাব, পারমিশন এর ঝামেলা নাই, কিছুই প্লান করতে হবেনা। বাফে খাবার। ঝামেলা বিহীন টুর। সব বন্ধুদের যাবে কিনা জিজ্ঞেস করতে করতে আর কাওকে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত দুই বন্ধুই যাব বলে ঠিক করলাম। এজেন্সিতে টাকা দিয়ে বুক ও করে ফেললাম। ভিসা টিসা সব রেডি করলাম।কিন্তু, এই এজেন্সি বেপারটা মনে কেমন খটকা লাগছিল।সবসময় এজেন্সি ছাড়া ঘুরতে যেতে চেষ্টা করবেন। পরে এজেন্সি বাদ দিয়ে নিজেরাই রওনা দিলাম। সিকিম যাবার জন্য সবচে ভাল হল চেংরাবান্ধা বর্ডার।এসি, নন এসি আর বিজনেস ক্লাস বাস চলে এই রুটে।সব বাস এর টিকেট কল্যাণপুরে পাওয়া যায়। ঢাকা থেকে বাসে সরাসরি শিলিগুড়ি পৌঁছে গেলাম মাঝের বর্ডার এর কাজ শেষে । বাসের অন্যদের সাথে মিলে গ্রুপ করে গ্যাংটক এর গাড়ি ঠিক করলাম। শিলিগুড়ি থেকে বাসে অথবা জীপে করে যাওয়া যায়।আপনি চাইলে ট্যাক্সি নিয়েও যেতে পারবেন, তাতে খরচ বেশি হবে। বাসে আপ ৭০ রুপি ডাউন ৮০ রুপি, লোকাল মানুষ থেকে জানা ভাড়া।
আর জীপে ২৫০ রুপি প্রতি জন। একজিপে ১০ জন যেতে পারে। সিট ২-৪-৪। আপনার গ্রুপ বড় না হলেও গাড়ির স্ট্যান্ড আছে সেখান থেকে শেয়ার যেতে পারবেন। গ্যাংটক এর আগে রংপো বর্ডার আছে সেখান থেকে অনুমতি নিয়ে ঢুকতে হবে। সিকিম ইন্ডিয়ার দ্বিতীয় ক্ষুদ্র অঙ্গ রাজ্য। আশেপাশে ৩ দেশের সীমানা। তাই আপনার সিকিম ঢুকতে এবং বেরতে ইন, আউট সিল নিতে হবে। বের হবার সময় ওই রংপো তেই না গেলেও হবে, আরও এসএনটি গেট আছে, যেকোনোটা দিয়ে আপনি বের হতে পারবেন সিল নিয়ে। রংপো তে খুব ভিড় থাকায় আমাদের অনেক সময় চলে যায়। এক বাংলাদেশি লোকের সাথে এক নেপালি মেয়ের ঝগড়া হাতা হাতির কারণে বাংলাদেশিদের অপেক্ষায় রেখে সব নেপালিদের আর অন্য দেশিদের আগে অনুমতি দিতে থাকে। আমাদের সামনে এক এক জন নেপালি ২০-৪০-৯০ টা পর্যন্ত পাসপোর্ট নিয়ে লাইন এ ছিল।অনেকজন বাংলাদেশির রাত ১০ টা বাজায় সেদিন অনুমতি না পাওয়ায় সেখানেই হোটেলে থেকে যেতে হয়। নেপালিরা পাসপোর্ট ছাড়া শুধু ওদের সরকারি কার্ড নিয়ে সিকিম ঢুকতে পারে।
আমাদের গ্যাংটক পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত ১২.৩০ বেজে যায়। সব কিছু বন্ধ সব হোটেল সব রেস্টুরেন্ট । নেমে দেখি বৃষ্টি হচ্ছে। এটাই বাকি ছিল। ১২/১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস ঠাণ্ডা। খুধায় পেট চো চো করছে। সেই দুপুর ১২ টায় খেয়েছিলাম। একটু সামনে যেতেই দেখি মানুষের জটলা। এক লোক মোমো বিক্রি করছে। গপাগপ এক প্লেট খেয়ে নিলাম। ৭০ রুপি ৮ টা চিকেন মোমো। আরও ২/৪ প্লেট খাব ভেবে চাইতে চাইতে দেখি শেষ।
পুরো এম জি মর্গ ঘুরে কোন হোটেল কি কথা বলার লোক পর্যন্ত নেই। সব দরজা বন্ধ তালা দেয়া। সাথের বন্ধু বলল চল ক্লাব খুঁজি, ক্লাব এ রাত থেকে সকালে হোটেল নিব। এমন ভাবতে ভাবতে দেখি আরও যারা হোটেল খুঁজছিল তাদের একজন ডাকছে হাত নেড়ে । পরে সেখানকার পুলিশ কল করে আমাদের হোটেল এর বেবস্থা করে দেয়। এমনটা নাকি প্রায়ই হয়।
ভিউ সহ একটা রুম পেয়ে যাই। পেছনে বারান্দা দিয়ে পুরো গ্যাংটকও দেখা যায়।সকালে উঠে জানালা দিয়ে দেখি কাঞ্চনজঙ্ঘা। কি অসাধারণ দৃশ্য ! পরদিন রেস্ট নিয়ে, আশেপাশে ঘুরে তার পর দিন সাঙ্গু লেক ঘুরতে বেরলাম। চমৎকার পাহাড়ি উঁচুনিচু রাস্তা ধরে যেতে হয়।গ্যাংটক শহরটা ৫০০০ ফিট উপড়ে, এখান থেকে আমরা যাব ১৩,৩০০ ফিট পর্যন্ত।
এখানে কোথাও যেতে হলে আবার পারমিশন লাগবে, ট্রাভেল এজেন্সি সাথে যেতে হবে, গাইড আর ট্রাভেল এজেন্সি মাস্ট। আর পারমিশন এরাই করিয়ে দেবে। যেতে যেতে যখন আমরা আস্তে আস্তে উপরদিকে উঠতে শুরু করলাম দুপুর ১২ টা পাড় হয়ে গেছে তখন, আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করল। সকাল থেকে দুপুর ১২ টা পর্যন্ত আকাশ পরিষ্কার থাকে, এর পর থেকে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করে আর এরপর বেশি দূর পর্যন্ত দেখা যায়না। আমরা উপড়ে উঠতে উঠতে মেঘের ভেতর দিয়ে চলা শুরু করলাম, সামনে ২০ ফুট এর বেশি দুরে দেখা যায়না। পৌঁছলাম ২ ঘণ্টা পর সাঙ্গু লেক। ১০ ফিট সামনে কিছু দেখা যায়না ! খুব কম অক্সিজেন। একটু বেশি হাঁটলেই মাথা ঘোরায়। রেস্ট নিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে ঘুরতে থাকলাম, সাথের বন্ধু ইয়াক গরু নিয়ে ঘুরতে গেল। ১২০০ রুপিতে লেক ঘুরিয়ে নিয়েয় আসবে। এর মধ্যে আশপাশ অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেছে আর বরফ ও পড়তে শুরু করেছে, পুরো লেকটা আর আশেপাশের পাহাড় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল, এখানে কেবল কার আছে, লেকের সাথের পাহাড়ে ওঠা যায় এতে করে, উপর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা ভিউ পয়েন্ট।
যেখানে সেখানে ময়লা ফেলবেনা, দয়াকরে নিদ্রিস্ট স্থানে ময়লা ফেলুন।
Source: Rafaat Pronoy <Travelers of Bangladesh (ToB)