ঘুরে আসুন মানিকগঞ্জের তেওতা জমিদার বাড়ী
একদিনে ঢাকা শহর থেকে ঘুরে আসা যায় এমন অনেক যায়গা আছে। তারমধ্যে তেওতা ভ্রমন নিয়ে তেমন পোস্ট এই গ্রুপে দেখা যায়না, কিংবা অনেকেই এই সুন্দর এলাকাটি সম্পর্কে জানেন না। আজ আপনাদের বলবো তেওতা জমিদার বাড়ী ভ্রমণ ও আরিচা থেকে পদ্মার টাটকা ইলিশ খাওয়ার গল্প। হ্যা আরিচা যমুনা নদীর তীরে। আর আরিচা থেকে ৫-৭ কিমি দূরে পদ্মা ও যমুনা নদীর মিলনস্থল।
দেশের পুরাকীর্তি স্থাপনার মধ্যে মানিকগঞ্জের তেওতা জমিদার বাড়ী ইতিহাস অন্যতম। মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার যমুনা নদীর কূলঘেঁষা সবুজ-শ্যামল গাছপালায় ঢাকা তেওতা গ্রামটিকে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে দিয়েছে জমিদার শ্যামশংকর রায়ের প্রতিষ্ঠিত নবরত্ন মঠটি।
মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার এই তেওতা গ্রামটি আরও বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী প্রমীলার স্মৃতি জড়িয়ে থাকায়। তেওতা গ্রামের মেয়ে প্রমীলা।
কীভাবে যাবেন?
প্রথমে গাবতলী চলে আসুন। গাবতলী থেকে আরিচা ঘাটে যায় এমন বাসে উঠে পড়ুন। ভাড়া ৯০-১০০ টাকা চাইবে, দরদাম করে নিলে ৭০-৮০ তেও রাজী হয়ে যাবে।
সরাসরি আরিচা ঘাটে যায় বি.আর.টি.সি, পদ্মা লাইন বাস। সময় লাগবে আড়াই থেকে তিন ঘন্টা মত।
কিছু কিছু বাস পাটুরিয়া যায়। যারা পাটুরিয়া কিংবা দুর পাল্লার বাসে উঠবেন তারা তারা উথুলি বাজার নেমে সেখান থেকে অটো/সিএনজি ধরে আরিচা ঘাটে চলে যাবেন। অটো ভাড়া ১০ টাকা প্রতিজন। সময় লাগবে ১০ মিনিট মত।
আবার ঢাকার নিউমার্কেট কলাবাগান, শ্যামলী হয়ে পাটুরিয়া পর্যন্ত নীলাচল বাস চলাচল করে। তারা উথুলি বাজার নেমে অটো/সিএনজি ধরে আরিচা ঘাটে চলে যাবেন।
আরিচা ঘাটে নেমে বিস্তৃত যমুনা নদী দেখতে পাবেন। সেখানে পানির শব্দ, পানির আছড়ে পড়া বিস্তৃত জলরাশি আপনাকে মুগ্ধ করবে। সেখানেই কাটিয়ে দিতে পারবেন অনেকটা সময়। চাইলে স্পিড বোটে করে নদীর ওপার কিংবা নদীর মাঝে জেগে উঠা চরে গিয়ে ঘুরে আসতে পারবেন। আপনার মন ভালো হতে বাধ্য।
এখানে ঘোরা হয়ে গেলে দুপুরের খাবার আরিচা ঘাটেই খেয়ে নেবেন, এবং অবশ্যই ইলিশ মাছ দিয়ে। খাবার আগে দামদর করে নিয়ে টাটকা ইলিশ ভেজে দিতে বলবেন। দাম হাতের নাগালেই। আর হ্যা এখানের পানি তেমন একটা ভালো লাগেনি, তাই সম্ভব হলে বোতলের পানি কিনে খাবেন।
তারপর আরিচা ঘাট/বাজার/বাসস্ট্যান্ড থেকে অটো বা সিএনজি করে তেওতা জমিদার বাড়ী যাবেন। ভাড়া ১০ টাকা জনপ্রতি। সময় ১০-১৫ মিনিট মত। এই ভ্রমণের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য যাবার পথেই পাবেন। যে রাস্তা দিয়ে যাবেন সেই রাস্তার বাম পাশ থেকে শুরু হয়ে যমুনা নদীর বিস্তীর্ণ জলরাশি, যতদুর চোখ যায় ততদুর শুধু পানি আর পানি। আর রাস্তার ডানপাশে রাস্তার সাথে লাগোয়া সব টিনের বাড়ী। এ যেন আমাদের কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভের কথা মনে করিয়ে দেয়। আমাদের বন্ধুরা কেউ কেউ মজা করে বলছিলো গরীবের মেরিন ড্রাইভ। (এটার একটা ভিডিও দিলাম)
এই অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে আপনি পৌছে যাবেন তেওতা জমিদার বাড়ী। এই জমিদার বাড়ীর সামনে একটা বড় দিঘি আছে। দিঘিটা এখন বাধাই করা। এই দীঘিতে গোসল করতে আসতো প্রমীলা দেবী। কবি নজরুল ইসলামকে তিনি কবিদা বলে ডাকতেন। একদা প্রমীলা যখন বাড়ির পুকুরে গোসল করাতে যেত, তখন তার রূপে মুগ্ধ হয়ে কবি বলে উঠেন-
“তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়,
সেকি মোর অপরাধ”
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, তেওতা জমিদার বাড়িটির বয়স ৩০০ বছর ছাড়িয়েছে। জেলার ইতিহাস থেকে জানা গেছে, সপ্তদশ শতকের শুরুতে পাচুসেন নামের পিতৃহীন দরিদ্র এক কিশোর তার সততা আর চেষ্টায় তামাকের ব্যবসা করে বিপুল ধন সম্পদ অর্জন করেন। দরিদ্র পাচুসেন দিনাজপুরের জয়গঞ্জে জমিদারী কিনে হয়ে যান পঞ্চানন সেন। তারপর শিবালয়ের তেওতায় তিনি এই জমিদার বাড়িটি তৈরি করেন।
জমিদার বাড়ির মূল ভবনের উত্তর দিকের ভবনগুলো নিয়ে হেমশংকর এস্টেট এবং দক্ষিন দিকের ভবনগুলো নিয়েছিল জয়শংকর এস্টেট। প্রতিটি এস্টেটের সামনে বর্গাকৃতির অট্টালিকার মাঝখানে আছে নাটমন্দির। পুবদিকের লালদিঘী বাড়িটি ছিল জমিদারদের অন্দর মহল। অন্দর মহলের সামনে দুটি শানবাঁধানো ঘাটলা, এর দক্ষিন পাশের ভবনের নীচে রয়েছে চোরা কুঠুরী যাকে এলাকার মানুষেরা বলে অন্ধকুপ। উত্তর ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ৪ তলা বিশিষ্ট ৭৫ ফুট উচ্চতার নবরত্ন মঠ। এর ১ম ও ২য় তলার চারদিকে আছে ৪টি মঠ। তেওতা জমিদার বাড়িটি ৭.৩৮ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত এই জমিদার বাড়ি।
সম্পুর্ন বাড়ী ও তার আশেপাশের আনুসাঙ্গিক জিনিস দেখতে দেখতে অনেকটা সময় অজান্তে কেটে যাবে।
বাড়ীটি দেখাশোনার কেউ আছে বলে তেমন মনে হলোনা, জরাজীর্ণ দেওয়াল, স্থানে স্থানে ভেঙ্গে যাওয়া, রঙ চটে যাওয়া, দেওয়ালে নানা রকম শ্যাওলা ও দেওয়াল ফেরে গাছ বেড়িয়ে গেছে। তাছাড়া যে যেমন পারছে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেখানে সেখানে চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল, বিরিয়ানির প্যাকেট কিংবা সিগারেট এর প্যাকেট ফেলে দিচ্ছে।
আমরা যারা ভ্রমণে যাচ্ছি সেখানে যদি একটু সাবধানতা অবলম্বন করি ও নোংরা না করি তাহলে এই ঐতিহাসিক স্থানটি আরো সৌন্দর্যময় হয়ে উঠতে পারে। তেওতা এলাকা ও জমিদার বাড়িটি নজরুল-প্রমীলার স্মৃতিধন্য একটি স্থান। এখানে নজরুলের বেশ কিছু স্মৃতি খুঁজে পাওয়া গেছে। তাই বাড়িটিকে কিছুটা সংস্করন ও সংরক্ষণ করে এর হারানো সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনা দরকার। তাহলে খুব দ্রুতই এটা হতে পারে অন্যতম এক দর্শনীয় এক স্থান।