ঘুরে এলাম জয়পুর- দ্যা পিংক সিটি অব ইন্ডিয়া
গতবছর কাশ্মীর ভ্রমণের পর এবার যখন ইন্ডিয়া ট্যুরের প্ল্যান হচ্ছিলো তখন মনে হলো নতুন কোথাও যাওয়া যাক। ভ্রমণ সঙ্গীরা সকলেই রাজস্থানের রাজধানী জয়পুরের ব্যাপারে একমত হলাম কারণ এর আগে যারা জয়পুর ঘুরে এসেছে তাঁদের কাছে গল্প শুনে শুনে সত্যিই জয়পুরের ব্যাপারে অন্যরকম একটা মোহ তৈরি হয়েছিলো। আর এখন জয়পুর ঘুরে এসে মনে হচ্ছে এতদিন যতটুকু শুনেছি আসলে অনেক কমই শুনেছি। জয়পুর ভ্রমণের জন্য কি যে অসাধারণ একটা স্থান আর ঘুরে দেখার মতো এতো কিছু যে আছে যারা কখনও যায়নি তাঁরা সেটা কল্পনাও করতে পারবেনা। তাই বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি যে, তাজমহল না দেখলে যেমন ইন্ডিয়া ট্যুর ষোল আনাই মিছে তেমনি একটিবার পিংক সিটি-জয়পুর না ঘুরে আসলে ভারত ভ্রমণ অনেকটাই অসম্পূর্ণ!!!
যাই হোক, আমাদের ৪ জনের গ্রুপের ট্যুরটা ছিল কোলকাতা, দিল্লি, জয়পুর, আগ্রা মিলিয়ে মোট ১০ দিনের যার মধ্যে জয়পুরের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩ দিন। এখানে শুধু জয়পুরের কথাই বলছি। ঢাকা থেকে ১৩ জানুয়ারি কোলকাতা পৌঁছে সেখানে ২ দিন থেকে ১৫ জানুয়ারি সকালের ফ্লাইটে দিল্লি চলে আসি। আগে থেকেই বুকিং করে রাখা গাড়ি ইন্দিরা গান্ধী এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের পিক করে সকাল ১১ টায়। গাড়ি নিয়ে ইন্ডিয়া গেট, রাষ্ট্রপতি ভবন, দিল্লি জামে মসজিদ, লাল কেল্লা ইত্যাদি জায়গা ঘুরে বিকেল ৫টার দিকে আমরা রওয়ানা হই জয়পুরের উদ্দেশ্যে। রাত ১১টায় Booking.com এর মাধ্যমে বুকিং দেয়া জয়পুরের হোটেল Vaishnavi তে চেক-ইন করি। হোটেলটা সিটি সেন্টার থেকে ২.৮ কিমি দূরে অবস্থিত। হোটেলে আসার পথেই আমরা হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে খেয়ে নিয়েছিলাম।
দর্শনীয় স্থানঃ জয়পুর সিটির মধ্যে দর্শনীয় স্থান হচ্ছে পিংক সিটি, সিটি প্যালেস, হাওয়া মহল, যন্তর-মন্তর, আলবার্ট হল মিউজিয়াম। আর সিটির বাইরে দর্শনীয় স্থান হচ্ছে জলমহল এবং বিখ্যাত তিনটি ফোর্ট বা দুর্গ যেগুলো হচ্ছে জয়গড় ফোর্ট, নাহারগড় ফোর্ট এবং আমের বা অ্যাম্বার ফোর্ট। এগুলোর মধ্যে আবার সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে আমের ফোর্ট। এছাড়াও জয়পুর গিয়ে আজমির শরিফ দর্শন না করে আসলে ট্যুরটা কিন্তু অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। আমরা প্রথম দিন আলবার্ট হল মিউজিয়াম, জয়গড় ফোর্ট, নাহারগড় ফোর্ট আর হাওয়া মহল; ২য় দিন আজমির শরিফ এবং ৩য় দিন সিটি প্যালেস, যন্তর-মন্তর, জলমহল এবং আমের ফোর্ট গিয়েছি। আর পিংক সিটি যেহেতু শহরের মধ্যেই সেকারনে প্রতিদিনই যাতায়াতের সময় পিংক সিটি অতিক্রম করেছি। এবার জায়গাগুলোর কিছুটা বর্ণনা দেয়া যাক-
• পিংক সিটি হচ্ছে শহরের মধ্যেই কয়েক বর্গ কিলোমিটার জুড়ে একটা জায়গা যেখানকার ঘরবাড়ি, অফিস-আদালত, দোকানপাট সবকিছুই পিংক বা গোলাপি রঙের। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করা যাবেনা যে জায়গাটা কত সুন্দর।
• আলবার্ট হল মিউজিয়ামের বড় আকর্ষণ হচ্ছে এখানে মিশর থেকে উপহার পাওয়া একটা মমি আছে, এছাড়াও আছে রাজস্থানের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন নিদর্শন। আর মিউজিয়ামের বাইরে অসংখ্য কবুতর খেলা করছে যা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কষ্ট।
এন্ট্রি ফিঃ ইন্ডিয়ান-৫০ রুপি, নন ইন্ডিয়ান-২০০ রুপি।
• সিটি প্যালেস জয়পুরের বর্তমান মহারাজার শহরের প্রাসাদ। বিশাল জায়গা জুড়ে প্রাসাদটা অবস্থিত যেখানে দরবার হল, যুদ্ধাস্ত্র মিউজিয়াম এবং আরও কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে।এন্ট্রি ফিঃ ইন্ডিয়ান-২০০ রুপি, নন ইন্ডিয়ান-৫০০ রুপি।
• হাওয়া মহল অসংখ্য জানালা দিয়ে তৈরি ৬/৭ তলা উঁচু একটি মহল। এটা তৈরি করা হয়েছিল রাজপুত রমণীরা যেন এই জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে পান কারণ তাঁদের বাইরে যাবার অনুমতি ছিলোনা। হাওয়া মহলের নির্মাণশৈলী অসাধারণ।
এন্ট্রি ফিঃ ইন্ডিয়ান-৫০ রুপি, নন ইন্ডিয়ান-২০০ রুপি।
• যন্তর-মন্তর হচ্ছে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান, জটিল গানিতিক সমস্যা সমাধান আর মহাকাশ গবেষণার উপযোগী বিভিন্ন উপকরন দিয়ে তৈরি অষ্টাদশ শতকের একটি অসাধারণ স্থাপনা।
এন্ট্রি ফিঃ ইন্ডিয়ান-৫০ রুপি, নন ইন্ডিয়ান-২০০ রুপি।
• জলমহল শহরের একটু বাইরে বিশাল লেকের মধ্যে অবস্থিত একটা মহল বা প্রাসাদ, এখানে মহারাজারা অবকাশ যাপন করতেন। জলমহলের সামনেই রাজস্থানের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ভাড়ায় পাওয়া যায় যেগুলো পড়ে সবাই ছবি তুলে থাকে।
• আজমির শরিফ নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। এটি জয়পুর থেকে ১৪০ কিমি দূরে অবস্থিত। যেতে আসতে মোটামুটি ৭/৮ ঘণ্টা লেগে যায়। দরগাহ শরীফের বাইরে নানা রকম ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন ও স্যুভেনির কিনতে পাওয়া যায়।
• জয়গড় ফোর্ট শহর থেকে ১২-১৪ কিমি দূরে অবস্থিত। এই দুর্গে উটের পিঠে চড়ে ঘোরার সুযোগ রয়েছে। এখানে আছে ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় কামান। দুর্গটা অনেকটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত।
এন্ট্রি ফিঃ ইন্ডিয়ান-৭০ রুপি, নন ইন্ডিয়ান-৩০০ রুপি।
• নাহারগড় ফোর্ট জয়গড় ফোর্ট থেকে ৫/৬ কিমি দূরে অবস্থিত। খাড়া পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে গাড়ি নিয়ে এখানে উঠতে হয়। এটি ছিল মহারাজাদের অবকাশযাপনকালীন প্রাসাদ। এখানে রয়েছে বিখ্যাত শীশমহল যেখানে নাচগানের আসর বসতো। এই ফোর্টে বিশাল একটি জলাধার আছে যেখানে “রং দে বাসান্তি” সহ আর অনেক হিন্দি মুভির শুটিং হয়েছে। নাহারগড় ফোর্টের শেষ মাথায় রয়েছে অসাধারণ সানসেট পয়েন্ট যার সৌন্দর্য বলে বোঝানো যাবেনা। এই ফোর্ট থেকে জয়পুর শহরের খুব ভালো ভিউ পাওয়া যায়।
এন্ট্রি ফিঃ ইন্ডিয়ান-৫০ রুপি, নন ইন্ডিয়ান-২০০ রুপি।
• জয়পুরের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সুবিশাল ফোর্ট হচ্ছে আমের বা অ্যাম্বার ফোর্ট। খাড়া পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এই বিশাল ফোর্টে যেতে হলে হেঁটে হেঁটে খাড়া ঢাল বেয়ে প্রায় ৩০০ মিটার উঁচুতে উঠতে হবে। পাহাড়ের চূড়ায় কীভাবে যে এরকম বিশাল দুর্গ সেই আমলে বানানো হয়েছিলো সেটা চিন্তা করলেই দম আটকে আসে। ২ দিন ধরে টানা ঘুরলেও এই ফোর্ট পুরোপুরি দেখা সম্ভব হবেনা। ভিতরে আছে সম্পূর্ণ শ্বেতপাথরে তৈরি দিওয়ান-ই-আম, দিওয়ান-ই-খাস, শীশমহল, চমৎকার বাগান, ফোয়ারা, মহারাজা মানসিংসহ অন্যান্য রাজা-মহারাজাদের আলাদা আলাদা প্রাসাদ। এছাড়া পুরো দুর্গ ঘিরে রাখা বিশাল প্রতিরক্ষা দেয়াল। বিশাল দুর্গটাকে মনে হয় একটা গোলকধাঁধার মতন, বারবার পথ হারিয়ে ফেলার উপক্রম হয়। ভালো কথা, পুরো দুর্গটা হাতির পিঠে চড়েও ঘোরা যায়, তবে খরচ হবে ২০০০ রুপি। এই দুর্গটা দেখার পরেই আমি একটু কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলাম যে, এটা কি আমার দেখা তাজমহলের চেয়েও অসাধারণ স্থাপনা কিনা!!!
এন্ট্রি ফিঃ ইন্ডিয়ান-১০০ রুপি, নন ইন্ডিয়ান-৫০০ রুপি।
শপিং: শপিং এর জন্য জয়পুরের সবচেয়ে বিখ্যাত মার্কেট হচ্ছে বাপু বাজার যেখানে জামা-কাপড় থেকে শুরু করে প্রায় সবকিছু খুব কম দামে পাওয়া যায়। আর উটের চামড়ার ব্যাগ, পার্স এবং জয়পুরের বিখ্যাত “রাজাই (পাতলা কাঁথা)” কিনতে পাওয়া যাবে হাওয়া মহলের অপজিটে যে মার্কেটটা আছে সেখানে। তবে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, ওখানে বাংলাদেশের মতই প্রচুর দামাদামি করে জিনিস কিনতে হবে নাহলে ঠকার সমূহ সম্ভাবনা। যা দাম চাইবে তার অর্ধেক দাম বলবেন।
খরচঃ প্লেনে ঢাকা থেকে কোলকাতা এবং কোলকাতা থেকে দিল্লি আসা যাওয়ায় আমাদের খরচ হয়েছিলো প্রতিজন ১৯০০০ টাকা। তবে আপনি যদি সড়কপথে ঢাকা থেকে কোলকাতা এবং কোলকাতা থেকে জয়পুর ট্রেনে যান তাহলে যাওয়া আসা মিলিয়ে (ট্রাভেল ট্যাক্সসহ) ট্রেনের শ্রেণিভেদে আপনার খরচ হবে ৫৩০০-৮০০০ টাকা। চাইলে আপনি দিল্লি হয়েও ট্রেন বা প্লেনে জয়পুর যেতে পারেন। জয়পুরে ৫০০-৮০০০ রুপির মধ্যে হোটেল ডাবল বেড রুম পাওয়া যায় তবে আগে থেকে বুকিং দিয়ে যাওয়া ভালো। আমি যে হোটেলে ছিলাম সেখানে ৪ রাতের জন্য ২টা ডাবল বেড রুমের ভাড়া পড়েছিল ৫৪৬৫ রুপি। যাবার আগেই আমি Booking.com এ বুকিং দিয়েছিলাম। হোটেলে ফ্রি ওয়াইফাই, গিজারসহ সব সুবিধা ছিল তবে রুমটা নন-এসি ছিল। জয়পুরে সব খাবারই পাওয়া যায় তবে ওদের কাবাবটা অসাধারণ, বিরয়ানী খুব একটা ভালো লাগেনি আমার কাছে, কেমন যেন গন্ধ। ৪০০-৫০০ রুপিতেই একেকজনের ৩ বেলা খুব ভালো খাওয়াদাওয়া হয়ে যাবে। জয়পুরে ট্যাক্সি available। শহরে সারাদিনের জন্য ভাড়া করলে ট্যাক্সির মানভেদে ১০০০-১৫০০ রুপি পড়বে। তবে আজমির শরিফে যেতে হলে ৩০০০-৪৫০০ রুপি ভাড়া পড়বে।
আরেকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, যদি আপনি টুকটাক হিন্দি জানেন তাহলে কিন্তু ইন্ডিয়ান রেটেই টিকেট কাটতে পারবেন নাহলে এন্ট্রি ফি দিতে দিতেই ফতুর হয়ে যেতে হবে। কাজ চালানোর মতো সামান্য হিন্দি বলতে পারাটা বিশাল উপকারে আসবে। আমাদের মধ্যে একজন খুব ভালো হিন্দি জানায় কোন জায়গাতেই আমাদের নন ইন্ডিয়ান এন্ট্রি টিকেট কাটতে হয়নি। ভালো কথা, অবশ্যই কোলকাতা থেকে মোবাইল সিম কিনবেন কারণ সেখানে পাসপোর্টের কপি বা ছবি ছাড়াই সিম কেনা যায়, খরচও কম। দিল্লি বা জয়পুর থেকে সিম কিনলে পাসপোর্ট আর ছবিতো লাগবেই, দাম পড়বে ৭০০-৮০০ রুপি এবং সিমও কিন্তু সাথে সাথে একটিভ হবেনা।