জীব বৈচিত্র্যের দ্বীপ সোনাদিয়া ভ্রমন

অনেক দিন থেকেই সোনাদিয়া ভ্রমনের চিন্তা করছিলাম। কিন্তু কেন যেন ব্যাটে বলে হচ্ছিলনা। কারন ট্যুর প্লান করতে গেলে কেন যেন পাহাড়ই চোখে ভাসে, সেটা দেশেই হোক কিংবা দেশের বাহিরে। অনেক প্রতিক্ষার পর এবার হঠাৎ করেই বান্দরবনের আমিয়াখুম, সাতভাইখুম ভ্রমনের সাথে সোনাদিয়াকে ট্যাগ করে ফেললাম। যেই ভাবা, সেই কাজ। সঙ্গে সঙ্গে সোনাদিয়ার গিয়াসকে ফোন দিলাম। গিয়াসের এই নাম্বার সংগ্রহ করেছি তাও প্রায় বছর চারেক আগে। তাই একটু ভয়ও হচ্ছিল নাম্বারটা এখনও সচল আছে কিনা? তবে সব সংশয় দূর করে রিং হলো এবং ফোনটা গিয়াসই ধরলো।

অনেকটা হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। গিয়াসের সাথে প্রয়োজনীয় কথা সেরে প্লান করতে বসলাম। আর সিদ্ধান্ত নিলাম সোনাদিয়াতে এবার ক্যাম্পিং করবো। জীবনে অনেক ট্যুর করলেও কখনও ক্যাম্পিং করা হয় নাই। যদিও ভারতের থর মরুভুমিতে তাঁবুতে একরাত ছিলাম। তবে সেটা ক্যাম্পিং এর পর্যায়ে পড়েনা। যা হোক অনেক কথা হল, এবার একটু সোনাদিয়া সম্পর্কে ছোট্ট করে জেনে নেই। সোনাদিয়া কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার অন্তর্গত ৯ বঃকিঃ আয়তনের ছোট্ট একটি দ্বীপ। এর তিন দিকে সাগর এবং অন্যদিকটা একটা চ্যানেল দ্বারা মহেশখালী থেকে পৃথক হয়েছে। দ্বীপটি সৌন্দর্যের পাশাপাশি জীব বৈচিত্র্যের জন্য খুব পরিচিত।

এখানকার সমুদ্র সৈকতে স্বচ্ছ নীল পানি, লাল কাঁকড়া, অতিথি পাখি, সামদ্রিক কচ্ছপের ডিমপাড়ার স্থান হিসাবে বিখ্যাত। এছাড়া অাছে প্যারাবন, ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। যাহোক পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী থানচি থেকে ডিমপাহাড়ের সেই চোখ জুড়ানো রাস্তা দিয়ে আলীকদম ও চকোরিয়া হয়ে চলে আসলাম কক্সবাজার। যদিও চকোরিয়া দিয়ে সরাসরি সোনাদিয়া যাওয়া যায়। কিন্তু কক্সবাজার দিয়ে যাওয়াটায় অনেক সহজ মনে হল। আর পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সমুদ্র সৈকত দেখার হাতছানিতো আছেই। সেই রাতটা কক্সবাজার কাটিয়ে দিয়ে পরদিন সকাল বেলা রওনা দিলাম ৬নং জেটির উদ্দেশ্যে। ওখানে সোনাদিয়ার গিয়াস ভাই ট্রলার নিয়ে অপেক্ষা করছে। এরপর ট্রলারে করে যাচ্ছি আর গিয়াসের কাছ থেকে সোনাদিয়ার গল্প গিলছি। সকাল সাড়ে দশটায় রওনা দিয়ে সোনাদিয়ায় পৌঁছালাম দুপুরের কিছু আগে।

প্রথমে গিয়াসের বাসায় গিয়ে লাগেজপত্র রেখে এবং সোনাদিয়ার কচি ডাবের পানি খেয়ে গেলাম সাগড়পাড়ে গোসল করতে। গোসল সেরে এবং লাল কাঁকড়ার সাথে ছুটোছুটি করে দুপুরের খাবার সাগরের মাছ দিয়ে একেবারে চেটেপুটে খেলাম। এরপর ট্রলারে করে ছুটলাম পার্শ্ববর্তী একটা চরে, উদ্দেশ্য অতিথি পাখী দর্শন। এই নৌপথটাও অসাধারণ। দুই দিকে প্যারাবন। মাঝদিয়ে ছুটে চলেছি আমরা। মাছ ধরা নৌকাগুলো আপন গতিতে ছুটে চলেছে। তখন জোয়ার চলছিল। পাখীগুলো গাছে অপেক্ষা করছে ভাটার অপেক্ষায়। কারন ভাটার সময় পানি নেমে গেলে কাদায় পোকা ও ছোট ছোট মাছ আটকে গেলে ওগুলো ওরা খাবে। চরে যখন পৌঁছালাম তখন ভাটা শুরু হয়েছে এবং যথারীতি হাজার হাজার পাখি চরে আশ্রয় নিলে চরের রং ই পরিবর্তন হয়ে গেল। সে এক অদ্ভূত দৃশ্য।

চারিদিকে সাগর মাঝখানে আমরা। সাগরের ঢেউ বালির মধ্যে যেন আল্পনা আঁকিয়ে দিয়েছে। অার এখানে লালকাঁকড়া এত বেশী যে সাদা বালি লাল হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে সাগরের মাঝ এক টুকরো লাল গালিচা। আমি কয়েকটা কাঁকড়ার সংগে দৌড় প্রাকটিচ করলাম। আর সুমন তো ধুমধাম কাঁকড়া ধরছে আর ছেড়ে দিচ্ছে। এখানকার দৃশ্য যতই দেখছি, ততই অবাক হচ্ছি। আর ভাবছি এত সুন্দর একটা দ্বীপে আগে আসিনি কেন? সোনাদিয়া ভ্রমনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল একের ভিতর তিন দর্শন, অর্থাৎ এখানে এক সংগে তিনটি পৃথক স্বাদ পাওয়া যায়। যেমন সমুদ্র সৈকত, ম্যানগ্রোভ বন ও মরুভুমি। এখানকার সৈকতে বালিয়াড়ী অসাধারণ। কোন কোনটির উচ্চতা ৭০ ফুট পর্যন্ত।

এই বালিয়াড়ীগুলো সোনাদিয়াকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে। এখানে একটা বিষয় খুব ভাল লাগলো। আর সেটা হলো সেন্টমার্টিনের মত এখানে কোনো কোলাহল নেই। একেবারে নীরব নিস্তব্ধ। আর তাই সোনাদিয়া এখন পর্যন্ত আপন বৈশিষ্টে অটুট আছে। যাহোক পাখি দেখে, কাঁকড়ার সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করে এবং সর্বশেষে সুয্যিমামার সাথে ছবি তুলে যখন ফিরছি, তখন পানি অনেক নেমে গেছে। পড়লাম মহা সমস্যায়। পনি এত কমে গেছে যে নৌকা চলবে কি না সন্দেহ? কিছুদূর যাওয়ার পর সন্দেহটা সত্যি হলো। আর রাতের বেলা নৌকা থেকে নেমে মোবাইলেের আলো দিয়ে কাঁদার মধ্যে ট্রেকিং শুরু হল।

এখানে কাদার মধ্যে প্রচুর শামুক ও ঝিনুক থাকার কারনে খুব সাবধানে ও ভয়ে ভয়ে পা ফেলতে হচ্ছে। এর মধ্যে আবার একটা সাপের সাথে দেখাও হয়ে গেল। যাহোক শেষ পর্যন্ত কোনো ঝামেলা ছাড়ায় গিয়াসের বাসায় পৌঁছে গেলাম। রাতের খাবার খেয়েই রওনা দিলাম বীচে। তাঁবু খাটানো হলো। সাগরের গর্জন এবং রায়হানের গান দুটোই চলছে একই সাথে। খুব সুন্দর একটা রাত কাটালাম। আর এর সাথে সাথে ক্যাম্পিংয়ের অভিজ্ঞতাও অর্জন করলাম। তখনও কচ্ছপ ডিমপাড়া শুরু করে নাই। তাই এত ভাল লাগার মাঝেও একটা অতৃপ্তি থেকেই গেল।

বিঃদ্রঃ সোনাদিয়া আমাদের একটি অমূল্য সম্পদ। সোনাদিয়াকে আই,বি,এ বা ইম্পোর্টান্ট বার্ড এরিয়া হিসাবে ঘোষনা করা হয়েছে। এখানে প্রতিবছর অসংখ্য পরিযায়ী পাখি আসে। এদের মধ্যে বিরল প্রজাতির চামুচ ঠুটো বাটন অন্যতম। এছাড়া সামদ্রিক কচ্ছপের ডিম পাড়ার আদর্শ জায়গা এই সোনাদিয়া। আরও আছে জীবন্ত জীবাশ্ম অশ্বখুরাকুতির কাছিম। রয়েছে নানা প্রজাতির উদ্ভিদ। আমাদের মনে রাখতে হবে। আমাদের হাজার হাজার সোনাদিয়া নেই। তাই এই সোনাদিয়াকে রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই।

source:  ডাঃ মোঃ মিজানুর রহমান

Share:

Leave a Comment