জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম এবং মৃত্যু এই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে, এছাড়াও ঠাকুরবাড়ির প্রত্যেক অংশে কবিগুরুর ছোটো থেকে বড়ো হয়ে ওঠার স্মৃতি জড়িয়ে আছে।

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৈত্রিক বাড়ি, এটি উত্তর কলকাতার চিৎপুর রোড ও বিবেকানন্দ রোডের সংযোগস্থলে ৬/৪ দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনে অবস্থিত। ১৭৮৪ খ্রীস্টাব্দে নীলমণি ঠাকুরের আটঁচালার স্থলে ১৮২৩-এ প্রাসাদসম অট্টালিকা গড়েন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর।বর্তমানে এই ঠাকুরবাড়িতে নোবেলজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন ও কাজের জন্য উৎসর্গকৃৎ একটি সংগ্রহশালা রয়েছে। এই ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি বহু বুদ্ধিজীবি মানুষের গড়ে ওঠার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। ঠাকুর বাড়ির প্রতিটি ঘরের নিজ্বস্ব একটি ইতিহাস আছে। এই ভবনে রয়েছে কবির পিতা মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামাঙ্কিত “মহর্ষি ভবন” নামে একটি সংগ্রহশালা, যার মধ্যে রয়ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর পরিবারবর্গ এবং বঙ্গীয় নবজাগরণকে উৎসর্গকৃৎ গ্যালারী। এখানে অবস্থিত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাসগৃহে আজও গেলে স্নিগ্ধতা অনুভব করা যায়।
ঠাকুরবাড়ির মূল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম কক্ষ বা ঠাকুর পরিবারের আতুঁর ঘর, যেখানে ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ শে বৈশাখ তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

পারিবারিক আতুঁর ঘরকে পিছনে ফেলে এগলেই দেখা মেলে রাজকীয় বৈঠকখানা, সুসজ্জিত বাগান ও বিস্ময়কর আঙ্গিনা যা ঠাকুর পরিবারের ঐশ্বহ্য ও ঐতিহ্যের মেল বন্ধনকে তুলে ধরে। ঠাকুরবাড়ির একটি কক্ষ সজ্জিত রয়েছে কবিগুরুর নিজ্বস্ব অঙ্কিত চিত্রের দ্বারা।
ঠাকুর বাড়ির অন্দরমহল বিভিন্ন পারিবারিক চিত্র, তৈল চিত্র, আলোকচিত্র ও ঠাকুর বাড়ির পত্রাদি দ্বারা সজ্জিত। ঠাকুর বাড়ীর ইতিহাস জীবন্ত হয়ে ওঠে যখন দেখা মেলে কবিগুরুর ব্যবহৃত কেদারার, যা কবির বহু অমূল্য রচনার সৃষ্টিস্থল। ঠাকুর বাড়ি আজও যত্নে আগলে রখেছে কবিপত্নী মৃনালিনী দেবীর বাসগৃহ ও তাঁর ব্যবহৃত দ্রবাদি । এর পাশাপাশি সংরক্ষিত রয়েছে মৃণালিনী দেবীর পাঁকশাল ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রকর্মের জন্য ব্যবহৃত তুলি এবং তাঁর ব্যবহৃত দ্রবাদি।
ঠাকুর বাড়ির সবচেয়ে বড় আঙ্গিনা ‘বিচিত্রা’-য় রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি নাটক এবং ডাকঘর নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ করা হয়েছিল। এখানেই রাজশাহী নাটকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নিজেই রঘুপতি – র ভূমিকা পালন করেছিলেন।

জোড়াসাঁকো তার সকল সন্তানদের জন্য গর্বিত, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্য এই স্থানের বিশেষ গর্ব রয়েছে, কারণ ১৯১৩ সালে প্রথম ভারতীয় হয়ে তিনি তাঁর নিজের গীতাঞ্জলি নামক ইংরেজি গ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
কবির সবচেয়ে প্রিয় দক্ষিণের বারান্দার (দক্ষিণ মুখোমুখি জানালা) ঘরটি যেখানে তাঁর বহুকাল জয়ী রচনার সৃষ্টি হয়েছে যা আজও ঠাকুর বাড়িতে কবির স্মৃতি বহন করে চলেছে। রবীন্দ্রনাথের বৌঠান কাদম্বরী দেবী তাঁর অনুপ্রেরণা ছিলেন।কাদম্বরী দেবীর কক্ষটিতে তাঁর একটি চিত্র রয়েছে এবং এই ঘরটিতে কাদম্বরী দেবী তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।
বাংলার বুকে সম্ভবত ঠাকুর বাড়ি-ই ছিল একমাত্র পীঠস্থান যেখানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্যের চর্চা করা হত, যা আমরা বহু রবীন্দ্র সঙ্গীতে পরিলক্ষিত করতে পারি।

এই স্থানটি কেবল ভারতীয় সাহিত্যেই অবদান রাখেনি বরং ব্রিটিশ সিংহাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য ভারতীয় সংগ্রামেও অবদান রেখেছে। ঠাকুরবাড়ি “রাখী বন্ধন” উৎসবের জন্মস্থান যা “বঙ্গো ভঙ্গো আন্দোলন” (১৯০৫ সালে বাংলার বিভাজন) -এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল। তিনি এই আন্দোলনের জন্য “আমার সোনার বাংলা” গানটি রচনা করেছিলেন, যা পরে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসাবে অভিযোজিত হয়েছিল। এই বাড়িটি সর্বোচ্চ স্তরে নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করে, যার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশ শাসন কর্তৃক প্রদত্ত নাইটহুডের শিরোনামটি ত্যাগ করেন। কবি গুরুর মৃত্যুর পরেও দীর্ঘকাল ধরে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে রয়েছে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি।
যদিও ঠাকুরবাড়ি সাক্ষী রয়েছে তার সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান বিয়োগেরও, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২শে শ্রাবণ পরলোক গমণ করেন আমাদের প্রাণের ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ।

Souerce:

Share:

Leave a Comment