টিমটিম করে জ্বলতে থাকা লোকালয়ের আলোগুলি যেনও রাতের তারা

প্রথমে ভেবেছিলাম আকাশের গায়ে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা আলোগুলি রাতের তারা। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে আমাদের গাড়িটি যতই উপরে উঠছিল ততোই আলোর উজ্বলতা বাড়ছিল। কাছাকাছি আসতেই টের পেলাম মাথার ঠিক খাড়া উপরে জ্বলতে থাকা আলোগুলি আসলে লোকালয়ের। অন্ধকার দুইপাশে যত দূর চোখ যায় পাহাড় ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়েনা। গাছপালার ফাঁক ফোঁকড় গলে মাঝে মাঝেই তারার আলোর মত বিদ্যুতের আলো চোখে ধরা দেয়। মনে হয় হাজার হাজার তারা জ্বলছে পাহাড়ের মাথায়।

সিকিমের শত শত পাহাড়ের মাথায় শহর গড়ে উঠেছে। আর পাহাড়ের মাঝ দিয়ে পাথর কেটে বানানো হয়েছে রাস্তা। রাস্তার দুইপাশে পাইন বন কখনো’বা পাথুরে নদী। পাইন গাছগুলি এতোটাই সারিবদ্ধভাবে জন্মেছে যে মাঝে মাঝে মানুষের হাতে কৃত্রিমভাবে রোপন করা ভেবে ভূল হতে পারে। খাড়া পাহাড় যেন আকাশ ছুঁয়ে গেছে। মাঝে মাঝেই আবার জল-প্রপাতের শব্দ। অনেকটা স্বপ্ন রাজ্যের মত। আমরা চলেছি পাহাড় ও বরফের দেশ গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে।

সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ফুট উপরে। পাহাড়ি রাস্তা এতটাই উঁচুনিচু যে মাঝে মাঝে ভয় হয় শক্তিশালী গাড়ির ইঞ্জিনও এই বুঝি হার মানলো। জানালা খোলা থাকায় হীমশীতল বাতাস এসে বুকে ধাক্কা দিচ্ছে। কিন্তু বাইরের রাতের সৌন্দর্য এতোটাই মনোরম যে জানালা লাগাতে মন চাইছেনা। এর মাঝেই ড্রাইভারের কাছে জানতে পারলাম সবচেয়ে উচূ পাহাড়ের মাথায় টিপ টিপ করে জ্বলতে থাকা আলোই আমাদের মুল গন্তব্য। ক্লান্তিহীন প্রায় ২৪ ঘন্টার জার্নি শেষে পৌঁছুলাম হোটেলে। রাত কাটলো আবছা আলোয় দূরের উপত্যকা দেখে।

পরদিন বরফ আর স্নোফল দেখার আশায় রওয়ানা দিলাম সাংগু লেকের উদ্দেশ্যে, সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৩ হাজার ফুট উচ্চতায়। এই প্রথম, দিনের আলোয় শহর দেখার সুযোগ হল। ছিমছাম গুছানো শহর। রাস্তার দুইপাশে কালারফুল ফেস্টুন টানানো দেখলেই উৎসব উৎসব একটা ভাব আসে। চীনের সীমান্তবর্তী হওয়ায় বিল্ডিং এবং অধিবাসীদের চেহারায় চাইনিজ ভাবটা স্পষ্ট।
শহর পেরিয়ে খাড়া আকাশের পানে ওঠা শুরু করতেই মেঘের দেখা মিললো। যেন গা ছুঁয়ে যাচ্ছিল তুষার কণা। আরো কিছুটা উপরে উঠতেই রাস্তার দুই পাশে বরফের স্তুপ নজরে পড়লো। ট্যুরিস্টদের গাড়ির নিরবিচ্ছিন যাতায়াত বজায় রাখতে মাঝ রাস্তার বরফ সরিয়ে দুইপাশে জমা করে রাখা হয়েছে। পাহাড়ের গা ছুঁয়ে যাওয়া রাস্তা থেকে উল্টোপাশে তাকালেই নজরে পড়ে অনেক নিচে গাছপালার মাঝে জনপদের চিহ্ন আর বরফে ঢাকা দূরের পাহাড়। কোন কোন জায়গায় রাস্তার ঠিক উপরে পাহাড় কেটে বানানো বাড়ি নজরে পড়ছিল। কখনো’বা জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছিল উচ্ছুক কোন চোখ। মনে হচ্ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষগুলি ওখানে বাস করে।

টুইলাইটের নেকড়ের মত কিছু কুকুরের দেখা মিললো। রাজকীয় ভংগীতে বরফ ঢাকা রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল।

এরই মাঝে আমরা বরফে ঘেরা পাহাড়ের কিনারায় পৌছে গেলাম। আমরা আর যেতে পারবোনা। বরফ জমে রাস্তা পুরোপুরি ঢেকে গেছে। গাড়ি নিয়ে সামনে আগানো মানে নিশ্চিত বিপদ। একবার পাহাড়ের কিনারায় ভারসাম্য হারালে কয়েক হাজার ফুট নিচের জংগলে পড়তে হবে। নেমে পড়লাম পাশেই জলপ্রপাতের কাছে। পাহাড়ের মাথা থেকে নেমে আসছে জলধারা। পাথুরে লেকের মধ্যে দিয়ে নেমে যাচ্ছে দৃষ্টি যত নিচে যায় তারচেয়েও গভীরে। যেদিকে চোখ যায় শুধু সাদা বরফ আর পাহাড়ের সারি। এই দৃশ্য বর্ননার অতীত।
কিছু সৌন্দর্য থাকে যা ভাষায় প্রকাশের জন্য নয় শুধুই অনুভবের জন্যে।

যারা সিকিম যেতে চান তাদের জন্যে অসংখ্য পোস্ট রয়েছে এই গরূপে, তবু সংক্ষেপে দেখে নিতে পারেন।
সিকিম যাবার আগে নিম্নলিখিত কাগজপত্রগুলো নিয়ে নিন।
১.বেশ কিছু পাসপোর্ট এবং ভিসার কপি
২.পাসপোর্ট সাইজ ফটো
৩.চাকুরীজীবি হলে NOC আর স্টুডেন্ট হলে স্টুডেন্ট আইডি কার্ডের ফটোকপি
৪. ট্রাভেল ট্যাক্স ফি (৫০০টাকা) দেবার রশিদ। ঢাকা থেকেই দিয়ে যাবেন। সোনালী ব্যাংকের নিউমার্কেট ব্রাঞ্চ থেকে দিতে পারবেন।

থেকে চ্যাংড়াবান্ধা অথবা বাংলাবান্ধা সীমান্ত হয়ে শিলিগুড়ি পর্যন্ত যাবার বাস পেয়ে যাবেন। ভাড়া পড়বে প্রায় ১৬০০টাকা। অথবা কাটা গাড়িতেও চলে যেতে পারবেন ইমিগ্রেশন পয়েন্ট। আমার বাজে এক্সপেরিয়েন্স বলে ডিরেক্ট গাড়িতে গেলে ইমিগ্রেশনের ঝামেলা কম পোহাতে হবে আপনাকে।
শিলিগুড়িজংশনে পৌঁছে সিকিমের টিকেট কেটে উঠে পড়বেন বাসে। ভাড়া পড়বে প্রায় ১৮০টাকা। যাত্রাবিরতি দিবে রাংপো চেকপোস্টে। ওখানে ফরেন রেজিস্ট্রি অফিস থেকে সিকিম যাবার পারমিশন নিতে হবে। কতদিন, কোথায় থাকতে চান ইত্যাদি প্রশ্ন শেষে পাসপোর্টে সিল নিয়ে ফিরে আসুন বাসে। ব্যাক করার দিনেও একই কাজ করবেন।নামিয়ে দিবে গ্যাংটকের প্রাণকেন্দ্র এমজি মার্গের পাশেই। অসংখ্য হোটেল পাবেন কাছাকাছি। যেকোনোটাই উঠে পড়ুন।প্রকৃতির মাঝে থাকতে এমজি মার্গ থেকে দূরে কোন হোটেলে থাকুন। সেক্ষেত্রে এপের মাধ্যমে বুক করতে পারবেন হোটেল|
>সিকিমের ট্যুরিস্ট স্পটগুলিতে যেতে হোটেল ম্যানেজারের সাথে কথা বলুন উনি যোগাযোগ করিয়ে দেবে ট্যুর অপারেটরের সাথে।

গবেষণা করে ঠিক করুন কোথায় কোথায় যেতে চান? কিছু পপুলার ট্যুরিস্ট প্লেস: Changu lake, Baba Harbhajan Singh Temple, Lachung, Yumthang Valley

বিঃদ্রঃ: হোটেল বুক করতে গিয়ে আমরা অদ্ভুত অবজ্ঞার শিকার হয়েছিলাম বাঙালি বলে। বুকিং.কম থেকে বুক করা হোটেল ক্যান্সেল করে আমাকে তারা মেইল দিয়েছিল বাঙালিদের তারা হোটেল দিবেনা। এই সুযোগ আমাদের মতোই কিছু কিছু বাঙালি তাদের দিয়েছিল| এরপর আমরা ছোট একটা উদ্যোগ নিয়েছিলাম।
যে হোটেলেই থেকেছি সেখানেই চেকাউট করার সময় সুন্দর করে রুম, বাথ্রুম গুছিয়ে একটা চিরকুট রেখেছিলাম প্রতিটা রুমে ।

source: Motiur Rahman‎ <Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment