ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা নারায়নগঞ্জ রূপগঞ্জ
ঈসা খাঁর রাজধানী সহ নারায়নগঞ্জের প্রত্যেকটি উপজেলায় রয়েছে অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শনসহ জানা অজানা অনেক সৌন্দর্যময় স্থান।
নিজের বাড়ি নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জে হওয়ার সুবাদে ২২২ টি গ্রাম ঘুরা না হলেও এর ১৫০+ গ্রাম কখনো না কখনো ঘুরা হয়েছে। সময় পেলে এখনো কোথায় না কোথায় ঘুরে আসি।
রূপগঞ্জ নামকরণের সঠিক ইতিহাস এখনো কারো কাছ থেকে জানতে পারিনি তবে কঠিত আছে রুপবানু নামে একজন প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন যার নামানুসারে রূপগঞ্জ নামকরণ।
রূপগঞ্জ নামটা যেমন সুন্দর এর প্রতিটি গ্রাম ও কোন অংশে কম সুন্দর না।
এই উপজেলার প্রধান ও মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে প্রবাহিত শীতলক্ষ্যা নদী এছাড়া দক্ষিণ পশ্চিমাংশে বালুনদী ও দক্ষিণ পূর্বাংশে ব্রহ্মপুত্র নদ রূপগঞ্জ উপজেলাকে বিভাজিত করেছে।
রূপগঞ্জ উপজেলার ঐতিহাসিক নিদর্শন ও সৌন্দর্যময় স্থান সমূহ:-
#সরকারি_মুড়াপাড়া_কলেজ #জমিদার_বাড়ি:-
মুড়াপাড়া রাজবাড়িটি ৬২ বিঘা জমির ওপর অবস্থিত। এই জমিদার বাড়িটি তৈরি করেন বাবু রাম রতন ব্যানার্জী যিনি এ অঞ্চলে মুড়াপাড়া জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এরপর তার কয়েকজন বংশধর কর্তৃক প্রাসাদটি সংস্কার ও সম্প্রসারণ করা হয়। ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে জমিদার প্রতাপচন্দ্র ব্যানার্জী এই ভবনের পিছনের অংশ সম্প্রসারণ করেন ও পরিবার নিয়ে এখানেই বসাবাস শুরু করেন।
তার পুত্র বিজয় চন্দ্র ব্যানার্জী ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রাসাদের সামনের অংশে একটি ভবন নির্মাণ ও ২টি পুকুর খনন করেন। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে তার দুই পুত্র জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জী ও আশুতোষ চন্দ্র ব্যানার্জী কর্তৃক প্রাসাদের দোতলার কাজ সম্পন্ন হয়।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার পর জগদীশ চন্দ্র তার পরিবার নিয়ে কলকাতা গমন করেন। এরপর থেকে বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাড়িটি দখল নেয় এবং এখানে হাসপাতাল ও কিশোরী সংশোধন কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে এখানে স্কুল ও কলেজের কার্যক্রম পরিচালনা করা হত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বাড়িটির দায়িত্ব গ্রহণ করে সেটিকে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। বর্তমানে এটি সরকারি মুড়াপাড়া কলেজ নামে পরিচিত।
#জামদানি_শাড়ি:-
জামদানি কার্পাস তুলা দিয়ে প্রস্তুত একধরনের পরিধেয় বস্ত্র যার বয়ন পদ্ধতি অনন্য। জামদানী বুননকালে তৃতীয় একটি সূতা দিয়ে নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়। মসলিন বয়নে যেমন ন্যূনপক্ষে ৩০০ কাউন্টের সূতা ব্যবহার করা হয়, জামদানি বয়নে সাধারণত ৭০-৮০ কাউন্টের সূতা ব্যবহৃত হয়। হালে জামদানী নানা স্থানে তৈরী করা হয় বটে কিন্তু ঢাকাকেই জামদানির আদি জন্মস্থান বলে গণ্য করা হয়। জামদানী বয়নের অতুলনীয় পদ্ধতি ইউনেস্কো কর্তৃক একটি অনন্যসাধারণ ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেইজ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে।
প্রাচীনকালের মিহি মসলিন কাপড়ের উত্তরাধিকারী হিসেবে জামদানি শাড়ি বাঙ্গালী নারীদের অতি পরিচিত। মসলিনের উপর নকশা করে জামদানি কাপড় তৈরি করা হয়। জামদানি বলতে সাধারণতঃ শাড়িকেই বোঝান হয়। তবে জামদানি দিয়ে নকশী ওড়না, কুর্তা, পাগড়ি, রুমাল, পর্দা প্রভৃতিও তৈরি করা হত। ১৭০০ শতাব্দীতে জামদানি দিয়ে নকশাওয়ালা শেরওয়ানির প্রচলন ছিল। এছাড়া, মুঘল নেপালের আঞ্চলিক পোশাক রাঙ্গার জন্যও জামদানি কাপড় ব্যবহৃত হত।
রূপগঞ্জের অধিকাংশ গ্রামে বিশেষ করে তারাব পৌরসভায় জামদানি তৈরি হয়। এছাড়াও জামদানি তৈরির জন্য বিসিক শিল্প নগরী গড়ে উঠেছে এই পৌরসভার নোয়াপাড়া এলাকায়
#৪০০_বছরের_পুরনো_বটগাছ
কালীগঞ্জের মল্লিকপুরের এশিয়ার বৃহত্তম প্রাচীন বটগাছের পর হয়তো দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রূপগঞ্জের হিরনালের এই বটগাছ। বটগাছটি এক একর জমি জুড়ে বিদ্যমান। গাছটির বয়স কারও মতে ৪০০ বছর, কারও কারও মতে ৫০০ বছরের উপড়ে। কুলাদি মৌজায় অবস্থিত এ গাছটি হিরনাল বাগবাড়ি বটগাছ নামে বিশেষভাবে পরিচিত।
স্থানীয়দের মতে, গাছটি ৪০০ বছরের পুরনো। রাস্তার ধারে ডাল-পাতায় পরিপূর্ণ গাছটি জনবিরল স্থানে পথিকের বিশ্রামের আশ্রয়স্থল। বটগাছটি একের পর এক ঝুরি নামিয়ে বিরাট আকার ধারণ করেছে। এ স্থানটির মালিক ৩৬০ আউলিয়াদের একজন আল-হাদী (র.)। তিনি ছিলেন মিরপুরের শাহ আলী (র.) বড় ভাই। জনশ্রুতি রয়েছে, প্রায় ৫০০ বছর আগে আল-হাদী (র.) এ এলাকায় বসবাস করেছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পর এটা খাস হয়ে যায়। পূর্বে তিথি অনুযায়ী এখানে পাঁঠাবলি হতো। এ গাছের নিচে একটি স্থায়ী কালীপূজার আসন স্থাপিত হয়েছে। এখনও মানুষ এখানে মানত করে। তবে এখনও পর্যন্ত কারও নজরে আসেনি। কথিত আছে, তৎকালীন জমিদার রামরতন ব্যানার্জি হাতির শূর দিয়ে বটগাছটি টেনে নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু পারেনি। বটগাছটির নিয়ে কথা হয় জসিম সরকারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাপ-দাদাগো মুখে হুনতাম এই বটগাছের কথা’। তার মতে, গাছটির বয়স ৫০০ বছরের ওপরে। তবে গায়ের সবচেয়ে বয়োবৃদ্ধ পঁচানব্বই বছর বয়সের নাসির ফকিরের মতে, গাছটির বয়স সাড়ে ৩০০ বছরের ওপরে। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা মজিবুর রহমান ওরফে ঠান্ডু ফকিরই বেঁচে গেছেন ১০০ বছর। আমার বাবায় কই তো দাদাও এই গাছটা এমন দেখছে। হিরনাল বাগবাড়ি এলাকার পঞ্চাশোর্ধ রাবিয়া বেগম বলেন, ‘বাজান আমরা ছোটবেলা থেইক্যা এই বটগাছটা দেইহ্যা আইতাছি। অনেক মানুষ এহানে আয়ে। মানত করে। একবার গাছটার মধ্যে আগুন লাগছিল। অনেকখানি পুইড়াও যায়। পরে গ্রামের লোহে আগুন নিভায়।’
তবে বটগাছটির কোন সচেতন পরিচর্যা হয় না। এই বিস্তৃত বটগাছের দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাখির কল-কাকলি মুখরিত শীতল পরিবেশ বিমুগ্ধ চিত্তকে বিস্ময় ও আনন্দে অভিভূত করে।
বটগাছটি দেখতে হলে কুড়িল বিশ্বরোড থেকে বাসে কাঞ্চন ব্রিজ যেতে হবে। সেখান থেকে বাসে কিংবা সিএনজি যোগে জিন্দা পার্কের আগে কালনি রোড দিয়ে হিরনালের নয়নাভিরাম এই বটগাছ দেখা যাবে।
#জিন্দা_পার্ক:-
জিন্দা পার্ক বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত বিনোদন ও অবকাশ যাপন কেন্দ্র। সাধারণ মানুষের উদ্যোগে এই পার্কটি তৈরী করা হয়েছে। প্রতিদিন প্রচুর পর্যটক এখানে ভ্রমণ করতে আসেন।
প্রায় ৫০০০ সদস্যবিশিষ্ট “অগ্রপথিক পল্লী সমিতি” ১৯৮০ সালে যাত্রা শুরু করে। মূলত এই সংগঠনের অকৃত্রিম প্রচেষ্টার ফলে পার্কটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
জিন্দা পার্ক প্রায় ১৫০ একর জায়গাজুড়ে বিস্তত। এখানে রয়েছে প্রায় ২৫০ প্রজাতির ১০,০০০ এর বেশী গাছ। সুদৃশ্য ভবনগুলো জিন্দা পার্কের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করেছে। এতে রয়েছে ৫টি বিশালাকার জলাধার। যেখানে পর্যটকরা নৌকায় ঘুরতে পারেন। প্রায় ৪০০০ লোকের আয়ের উৎস এই পার্ক। অপস ক্যাবিনেট, অপস সংসদ এবং অপস কমিশন নামে পার্কটিতে ৩টি পরিচালনা পর্ষদ রয়েছে। তবে রাজউক কর্তৃপক্ষ পার্কের উন্নয়নে সহায়তা প্রদান করার ঘোষণা দিয়েছিলো। পার্কটি প্রতিদিন সকাল ৯টার সময় পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
#আন্তর্জাতিক_বানিজ্য_মেলার_প্যাভিলিয়ন:-
বর্তমানে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা রাজধানীর আগারগাঁওয়ে হলেও জায়গা সংকট ও যানযটের কারণে তা ছড়িয়ে রূপগঞ্জ পূর্বাচলে করার ঘোষণা দেওয়া হয়। ২০১৯ সালে বানিজ্য মেলা পূর্বাচলে হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলেও কাজ অসমাপ্ত ও বিদ্যুৎ না পৌছানোর কারণে তা পিছিয়ে ২০২২ সালে করার সম্ভাব সাল নির্ধারিত হয়।
#পদ্ম_ও_লাল_শাপলার_বিল:-
রূপগঞ্জের অধিকাংশ গ্রামে বর্ষা ও এর পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পুকুর ও বিলে শাপলা দেখা গেলেও একমাত্র দাউদপুরের গ্রামগুলোতে (জিন্দা পার্ক সংলগ্ন) পদ্ম ও লাল শাপলা দেখা যায়। বিস্তৃত বিলজুড়ে পদ্ম ও শাপলা দেখা গেলেও আস্তে আস্তে তা বালির নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে। এলাকার অধিকাংশ মানুষ শাপলা সবজি হিসেবে খায়।
#শীতের_সরিষাক্ষেত:-
প্রাচীন কাল থেকেই এই এলাকার অধিকাংশ মানুষ সরিষা চাষ করে আসছে। বর্তমানে সরষা চাষ লাভজনক না হওয়ায় কৃষকরা ধীরে ধীরে সরিষা চাষ থেকে সরে আসছে
#সংরক্ষিত_বনাঞ্চল:-
বর্তমানে পূর্বাচলের অধিকাংশ এলাকাই একসময় ছিল ছোট ছোট টিলা ও গহিন অরণ্য। এছাড়া বানর, বাঘডাস, শিয়াল সহ অসংখ্য প্রাণীর বাস। পূর্বাচলের আদলে গাছপালা কেটে টিলা সমতল করে এবং বিলে বালি ভরাট করে গড়ে তোলা হচ্ছে আধুনিক শহর পূর্বাচল। বর্তমানে ৩০০ একর বনভূমির জন্য সংরক্ষিত রাখা হলেও অধিকাংশই ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।
#খেজুরের_রস:-
যেহেতু রূপগঞ্জ উপজেলা প্রত্যেকটি গ্রামেই অনেক গাছপালা রয়েছে সেই তুলনায় খেজুর গাছের পরিমাণ অতি নগন্য হলেও শীতকালে অনেক মানুষের সমাগম দেখা যায় শুধুমাত্র খেজুরের রস খাওয়ার জন্য
#শরতের_কাশফুল:-
রূপগঞ্জ থানার পশ্চিমাংশ থেকে প্রায় পূর্বাচল ৩০০ ফিট বিস্তৃত এলাকা জুড়ে অবস্থিত জলসিড়ি আবাসন প্রকল্প। শরত কালে এই আবাসনের পুরোটাই কাশফুলে ভরে উঠে। যতদূর চোখ যাবে শুধু কাশফুলই দেখা যাবে।
ইচ্ছে হলে সারাদিন ঘুরে শীতলক্ষা নদীতে ঝাঁপাঝাঁপি করে একটু প্রশান্তি নিয়ে যেতে পারেন।
এছাড়াও সড়ক পথে যানযট নিরসনের জন্য উপজেলার ভূলতায় নির্মিত হয়েছে ফ্লাইওভার ও শীতলক্ষা সেতুর উপর নির্মিত উদ্ধোধনের অপেক্ষায় নতুন সেতু।
ঢাকার পার্শ্ববর্তী হলেও সমগ্র রূপগঞ্জ উপজেলা ২/১ দিনে ঘুরা সম্ভব না। থাকার জন্য তেমন কোন ব্যবস্থা না থাকায় আপনাকে ঢাকা থেকেই ভোরে রওনা হয়েছি সারাদিন ঘুরে আবার রাতের মধ্যে বাসায় ফিরতে হবে।
যেভাবে যাবেন:- রাজধানী ঢাকা থেকে সড়কপথে দুইভাবে যাওয়া যায়।
১. কুড়িল থেকে বি আর টি সি বাসে
২. কলাবাগান/গুলিস্তান থেকে মেঘলা/গ্লোরি পরিবহনে
এছাড়া নৌপথে ও যেতে হলে খিলগাঁওয়ের ত্রিমোহনী থেকে ট্রলারে করে কায়েতপাড়া ।
ঢাকা থেকে পুরো রূপগঞ্জ উপজেলা ঘুরতে হলে ২/৩ দিনে সর্বোচ্চ ১৫০০-২০০০ টাকার মতো খরচ হবে।
Source: Shohel Pervez <Travelers of Bangladesh (ToB)