দার্জিলিং এবং গ্যাংটক ভ্রমণ
মায়া লুকি লুকি, মায়া লুকি লুকি। আশে পাশেই কোথাও গান বাজছে। নেপালী মিউজিক। গানের মানে আমি জানিনা, কিন্তু সুর এবং তাল বেশ চমৎকার। খুব মিষ্টি। বেশ লাগছে গানটি শুনতে। স্থানীয় একজনকে জিজ্ঞেস করতে বললো এটি প্রেমের গান। বেশ জনপ্রিয় এটি এখানে। পরে ইউটিউব ঘেঁটে দেখলাম, এটি একটি লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেমের গান। গ্যাংটকের প্রানকেন্দ্র এমজি মার্গের রাস্তায় বানিয়ে রাখা পথচারীদের জন্য বসার সুন্দর স্থানে বসে গানটি যখন শুনছিলাম, মনে হচ্ছিলো …… এ গানের নায়িকা, আর আমি… বাকীটা আর না বললেও চলে।
দার্জিলিং এবং গ্যাংটকের সৌন্দর্যের কথা, সেগুলোর রুপের কথা আমি শুনেছি বহু আগেই। তখন থেকেই ঘুরে দেখার ইচ্ছা এসব জায়গা। সময় আর সুযোগ হয়ে উঠছিলো না। অবশেষে সুযোগ হয়েছে এসবের সৌন্দর্য খুব কাছ থেকে দেখার, উপভোগ করার।
হ্যাঁ এ সৌন্দর্যকে আমি দেখেছি, শিলিগুড়ি থেকে হিমালয় দুহিতা দার্জিলিংয়ে যাওয়ার পথে, দার্জিলিংয়ের পরতে পরতে, পাহাড়কে পদানত করে, তার বুক চিরে বানানো রাস্তে দিয়ে দার্জিলিং থেকে গ্যাংটক যাবার পথে, গ্যাংটকের পাহাড়ি রাস্তায়, টাইগার হিল থেকে কাঞ্চনজংঘার শিখরে দেখা সুর্যের আলোকছটায়, ইস্ট সিকিমের পাহাড়ি রাস্তায়। পাহাড়ের চুড়ায়, সমতল থেকে প্রায় তের হাজার ফিট উঁচুতে, সমগু বা সাংগু লেকের পথে পথে।
আপনি কি বাড়ির ছাদে কখনো গাড়ী পার্কিং করতে দেখেছেন? আমি দেখেছি। দার্জিলিংয়ে! পাহাড়ের গা বেয়ে বানানো বাড়িগুলো বিভিন্ন তলার। চার, পাঁচ, ছয় বা আট তলারও বাড়ি আছে এখানে। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে তৈরী সেসব বাড়ি। নীচের দিকের বাড়িগুলো সিঁড়ি দিয়ে উপরে রাস্তার সাথে সংযুক্ত। বড় রাস্তার পাশে বাড়িগুলো রাস্তার লেভেল পর্যন্ত উঠেছে। কিছু বাড়ী আরো উপরে উঠেছে। কয়েকটা বাড়ির ছাদে গাড়ি পার্কিংরত দেখলাম। পর্যটকে ঠাসা দার্জিলিং। হোটেল মোটেল, রাস্তাঘাট, টুরিস্ট স্পট সব জায়গায় মানুষ আর মানুষে গিজগিজ করছে যেন।
হিমালয় দুহিতার সৌন্দর্যকে দুচোখ ভরে কাছ থেকে দেখবো বলে গত দশ জুন রাতেই আমরা তিনজন পঞ্চগড় যাবার ট্রেন ‘দ্রুতযান এক্সপ্রেসে’ উঠি। টিকেট আগেই করা ছিলো। ট্রেন পঞ্চগড় পৌঁছার কথা ছিলো সকাল ছয়টা নাগাদ কিন্তু পৌঁছে বেশ দেরিতে, সকাল প্রায় সাড়ে দশটার দিকে। পরিকল্পনার চেয়ে ঘন্টা চারেক পিছিয়ে পড়ি। যাহোক, এরপর নাস্তা সেরে ভ্যান যোগে বাসস্ট্যান্ড এবং সেখান থেকে বাসযোগে বাংলাবান্ধা পৌঁছলাম দুপুর একটা নাগাদ । দুই দেশের সীমান্তে ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমস ফরমালিটিজ সেরে, ফুলবাড়ি পার হয়ে একটি রিজার্ভ অটো নিয়ে শিলিগুড়ি পৌঁছাতে প্রায় বিকেল তিনটা বেজে যায়। শিলিগুড়িতে যথারীতি ট্যাক্সি নিয়ে হ্যাসাল। অবশেষে শেয়ারড কারে প্রায় পৌনে চারটা নাগাদ দার্জিলিংয়ের পথে কার ষ্টার্ট নিলো। সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টার পথ দার্জিলিং। শিলিগুড়িতে বেশ গরম পড়ছিলো তখন। একটু দৌড়ঝাপ করতে গিয়ে ঘেমে গিয়েছিলাম আমরা।
গাড়ীতে দুজন যাত্রী ছিলেন যারা দার্জিলিংয়েই থাকেন। তারা জানালেন একটু পরেই ঠান্ডা বাতাস পাওয়া যাবে। ঠিক তাই, কিছুক্ষণ গাড়ী চলার পরেই কিছুটা স্বস্তিদায়ক ঠান্ডা বাতাস পেতে শুরু করলাম। গাড়ি যত দার্জিলিংয়ের কাছাকাছি যাচ্ছে বাতাস ততই ঠান্ডা। একটু পরই পাহাড়ের দেখা পেতে শুরু করলাম। পাহাড়ের কোলে মেঘেদের মনের আনন্দে ভেসে বেড়ানোর অপরুপ দৃশ্য দেখতে পেলাম। আমার মনে পড়লো মেয়ের আব্দারের কথা ।
– বাবা, তুমি দার্জিলিং থেকে আমার জন্য কি নিয়ে আসবে?
– – তুমি কি নিতে চাও বলো মা।
– আমি মেঘ নিতে চাই বাবা।
– – কি! মেঘ!
– হ্যাঁ বাবা। আমার জন্য মেঘ নিয়ে এসো, বরফ নিয়ে এসো আর হচ্ছে এই যে, চাঁদ নিয়ে এসো। ঠিক আছে বাবা?
– – ঠিক আছে মা, আমি মেঘেদের দেশে গিয়ে মেঘকে কানে কানে বলে দেবো, তুমি উড়ে উড়ে আমার ছোট্ট নোরামনির কাছে চলে যাও, ওকে।
– হা হা হা, আচ্ছা বাবা, তাই বলো।
দার্জিলিংয়ের পাহাড়ে মেঘমালাদের দেখতে দেখতে মেয়ের আব্দারের কথা ভাবছিলাম। এক সময় আমরা সত্যি সত্যিই মেঘেদের দেশে পৌঁছে গেলাম। কিছুটা শীত লাগতে শুরু করেছে তখন। পাহাড়ের গা বেয়ে এগিয়ে চলা রাস্তা দিয়ে উপরে উঠে চলেছি আমরা। হিমালয়ের অষ্টাদশী দুহিতার শরীরে, থরে থরে সাজানো সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরা আরও উপরে উঠে গেলাম। গাড়ী গরম হয়ে যাওয়ায় রাস্তায় এক জায়গায় আমাদের থামতে হয়েছিলো । সেখানে দার্জিলিংয়ের চায়ের ধোঁয়া উঠানো পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে চারিদিকটা দেখছিলাম। খুবই ভালো লাগছিলো। মন এক ধরনের সৌন্দর্যের আবেশে হারিয়ে যাচ্ছিলো পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে। দার্জিলিং সম্পর্কে অনেক দিন ধরে অনেক কথা শুনতে শুনতে আমার মনে হয়েছিলো ও বোধহয় বুড়িয়ে গেছে ! কিন্তু না। টের পেলাম দার্জিলিং চির সবুজ, চির যৌবনা । এক সময়, বিখ্যাত ঘুম রেলষ্টেশন পার হয়ে, দার্জিলিংয়ের একেবারে প্রাণকেন্দ্র ম্যালরোডের কাছে যখন পৌঁছলাম আমরা তখন রাত প্রায় সাড়ে আটটা। পাহাড়ে রাত তাড়াতাড়ি নামে। কিন্তু তাতে কি? দার্জিলিং তখন তার অতিথিদের বরণ করতে ব্যাস্ত।
খুঁজে পেতে একটি হোটেলে উঠে, খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি তাড়াতাড়ি । পরদিন ভোর চারটায় ঘুম থেকে উঠে পড়ি। উদ্দেশ্য, টাইগার হিল থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার চুড়ায় সুর্যকে তার আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে জেগে উঠতে দেখা, পৃথিবীকে তার আলোয় আলোকিত করতে দেখা। অনেক জ্যাম ঠেলে টাইগার হিলে যখন পৌঁছলাম, সুর্যিমামা তখনো হালকা মেঘের আড়ালে আবেশে ঘুমাচ্ছে। মেঘের কি হলো হঠাৎ করে কে জানে! কাঞ্চনজঙ্ঘার চুড়ায় সুর্যের সোনালী আভার যে নান্দনিক সৌন্দর্য, তা সে আমাদের কাছ থেকে আড়াল করে রাখলো আজ। কি আর করা! এরপর আমরা বাতাসিয়া লুপ এবং ঘুম মনাস্ট্রি দেখে, নাস্তা সেরে, হোটেল রুমে ফিরলাম সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ। বাতাসিয়া লুপ জায়গাটাও বেশ সুন্দর। চারিদিকে সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি। সৌন্দর্যের হাতছানিতে মন তখন কবি হয়ে যেতে চাই। যদি লিখে ফেলতে পারতাম সুন্দর একখানি কবিতা!
দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি সৌন্দর্য অসাধারণ ঠিকই, কিন্তু তার কিছু ত্রুটিও ধরা পড়েছে আমার কাছে। অতিরিক্ত টুরিস্টের চাপ সামলাতে সে হিমসিম খাচ্ছে মনে হয়। রাস্তায় বেশ জ্যম থাকে, রাস্তার আশপাশে বেশ ময়লা জমেছে, হোটেল মালিক কিংবা রেস্টুরেন্ট মালিক অথবা ট্যাক্সি ড্রাইভার কারো ব্যাবহারই আমার খুব একটা পছন্দ হয়নি। বাংলায় কথা বললেই ভাবে কোলকাতা থেকে এসেছি এবং দিদির (মমতা দি, সিএম) উপর দুটি কটু কথা শুনিয়ে দেয়। কারণটা আমি বুঝে উঠতে পারিনি।
গ্যাংটকের কথাঃ
টুরিস্টদের ভিড়ে হিমালয় দুহিতা দার্জিলিং বেশ ক্লান্ত মনে হলো । সে তুলনায় গ্যাংটক তথা সিকিমের পরিবেশ, আতিথেয়তা, পরিচ্ছন্নতা কিংবা সেখানকার মানুষজনের চলাফেরা, আচার আচরণ সবকিছুই অনেক ভালো লেগেছে আমার । হিমালয়ের অন্য দুহিতা গ্যাংটক নিয়ে আগ্রহ ছিলো অনেক। বহুদিনের ইচ্ছা ছিলো, গ্যাংটক যাবো। এসেছি। সাথে দীর্ঘ দিনের অফিস সহযাত্রী ইকবাল ভাই আর সারোয়ার ভাই। বারই জুন দুপুরেই আমরা গাড়ি নিয়ে দার্জিলিং থেকে গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিই। দার্জিলিং টু গ্যাংটকের পাহাড়ি পথের দুইধারে অসাধারণ সব দৃশ্য। শুধু চোখ মেলে দেখা যায়, এর সাহিত্যরূপ প্রায় অসম্ভব। মাঝে মাঝে ক্যামেরায় ক্লিক করে কিছু দৃশ্য ধরে রাখার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা ছিলো মাত্র । কিছুদুর পরপরই রাস্তার আশেপাশে, উপরে কিংবা নীচে ঘরবাড়ি, ছোট বাজার, টাটকা সবজির দোকান। নীচ বা উপরের বাড়িগুলো মেইন রাস্তার সাথে সিঁড়ি দিয়ে সংযুক্ত। পথিমধ্যে আমরা এক জায়গায় গাড়ী থামিয়ে তৃপ্তি সহকারে দুপুরের লাঞ্চ সেরে নিলাম। হঠাৎ একটা বিষয় খেয়াল হলো, এই পুরো এলাকায় পানির কোন অভাব নেই। আমি আমাদের নীলগিরি, নীলাচল কিংবা সাজেকের পাহাড়ে গিয়েছি, সাংগু নদীর পাহাড়ী পথ ধরে, বড় পাথর পেরিয়ে রেমাক্রি গিয়েছি, আরও দূরে দুর্গম নাফাখুম ঝর্নায় গিয়েছি। প্রায় সব জায়গায় ব্যাবহার যোগ্য পানির বেশ সংকট দেখেছি। আর এখানে এসে দেখলাম উল্টো। পানির অভাবতো নেই, উল্টো মনে হলো পানির উপচে পড়া ব্যাবহার। পাহাড়ি ঝর্ণা থেকে প্রবাহিত সুপেয় পানিকে পাইপের সাহায্যে পুরো এলাকায় বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে । পানি তুলতে কোন ডিপ টিউবওয়েল, মটর কিংবা ট্যাংকি লাগছেনা। বুদ্ধির তারিফ করতে হয়।
বারই জুন সন্ধ্যা নাগাদ আমাদের গাড়ি সিকিমের বর্ডারে পৌঁছলো। এখানে আলাদা পাশ নিতে হয়, সিকিমে ঢোকার জন্য। অফিসে মাত্র একজন মহিলা এবং একজন পুরুষ অফিসার দায়িত্বে ছিলেন। ভিড় ছিলোনা তেমন। কোন টাকা পয়সা লাগেনি এবং মাত্র প্রায় মিনিট দশেকের মাথায় আমরা পারমিশনসহ পাসপোর্ট ফিরে পেলাম। খুব দ্রুত সার্ভিস পেয়ে বেশ অবাক হলাম। গ্যাংটকের ওল্ড প্রাইভেট ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে নেমে, হোটেল পেতেও দেরি হয়নি। পাশেই ম্যাগনোলিয়া নামক হোটেলে দুই হাজার পাঁচশত রুপি ভাড়ায় একটা সুন্দর রুম পেয়ে গেলাম। একটু সামনেই মসজিদ আছে, কাছাকাছি ঘরোয়া পরিবেশে খাবার একটি হোটেল আছে, ভালো লাগলো। রুমে উঠে ফ্রেস হয়ে একটু পরেই চলে গিয়েছিলাম পিছনের দিকে এমজি মার্গে। সিড়ি দিয়ে প্রায় সাত/আট তলা মতো উপরে উঠতে হয়েছিলো। পাহাড়ি পথে উঠতে হাপিয়ে গিয়েছিলাম আমরা।
পরদিন লোকাল সাইট সিইং। গ্যাংটকের আশেপাশেই বিভিন্ন স্পট ঘুরে ঘুরে দেখা। পাহাড়ি ঝর্ণা, তাসি ভিউ পয়েন্ট, প্ল্যান্ট কনজারভেটরী, গনেশ টক, গ্যাংটক রোপওয়ে ইত্যাদি। তাসি ভিউ পয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখা যায়। পরিষ্কার আকাশে গ্যাংটকের তাসি ভিউ পয়েন্ট থেকে চারিদিকের দৃশ্যটা অসাধারণ। কাঞ্চনজঙ্ঘার চুড়ায় তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করবে আপনার অনেকক্ষন। এখানে বলে রাখি, কাঞ্চনজঙ্ঘা হচ্ছে বিশ্বে তৃতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। প্রায় আটাশ হাজার ফিট উঁচুতে অবস্থিত। তিস্তা নদীর উৎপত্তি সেখানেই। কাঞ্চনজঙ্ঘার কিছু অংশ নেপালে আর কিছু অংশ সিকিমের মধ্যে পড়েছে।
গ্যাংটকের টেম্পারেচার চমৎকার। খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটি শহর। আমার খুব পছন্দ হয়েছে। কোলাহল নেই, ময়লা আবর্জনা চোখে পড়লো না, দুর্গন্ধ নেই, সবাই নিয়ম মেনে চলছে। কোনো ঝগড়া বিবাদ চোখে পড়লো না, ভিক্ষুক দেখলাম না, নেই হকার, যেখানে সেখানে কেউ থুথু বা কফ ফেলছেনা । একটু পরপর ট্রাফিক পুলিশ। খুবই দায়িত্ব সচেতন এবং বেশ মানবিক মনে হলো তাঁদের। অযথা গাড়ি আটকিয়ে কেউ পয়সা চাচ্ছে না। খাবার দোকানে অন্যদের মতো খেয়ে দেয়ে বিলও দিচ্ছেন তাঁরা। কোন দেমাগ নেই। পাহাড়ি রাস্তায় মাত্র দুটি লেন, কোন এক্সিডেন্ট চোখে পড়েনি আমার। অভ্যস্ত ড্রাইভার শক্ত হাতে বেশ জোর গতিতেই গাড়ি চালাচ্ছেন। ড্রাইভারদের আয় রোজগার অবাক করার মতো। মাসে প্রায় দেড় লাখ রুপির উপর। তাদের হাতে দামী ঘড়ি, জামা কাপড়, জুতা। পোশাক আশাকে নারী বা পুরুষে বাংগালীআনা নেই বটে, কিন্তু তাতেও এক ধরনের সৌন্দর্য আছে। কোন নোংরামি চোখে পড়েনি আমার।
গ্যাংটকের রাস্তায় বেড়াতে গিয়ে আমার চোখে গেঁথে যাওয়া দু’একটা ছোট ঘটনা আপনাদের সাথে শেয়ার করি।
সেদিন লোকাল সাইটসিইংয়ে তাসি ভিউ পয়েন্ট থেকে আমরা কাঞ্চনজংঘার ছবি তোলার চেষ্টা করছি। এক বৃদ্ধ দম্পতিকে দেখলাম। ছবি তুলে দেয়ার অনুরোধ জানালেন । আমার খুব ভালো লাগলো বিষয়টা । আমি বিভিন্ন এংগেলে উনাদের কিছু ছবি ক্যামেরাবন্দী করে দিলাম। হাসি মাখা ধন্যবাদ জানাতে ভুলেননি তাঁরা । আমিও মাথা নাড়িয়ে প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলাম। উনাদের আর কে আছে জানিনা, কথা হয়নি। কিন্তু যে বিষয়টা আমরা ভালো লেগেছে তাহলো এই যে, এই বয়সেও ভ্রমণের নেশায় বেরিয়ে পড়া। পৃথিবীকে জানবেন বলে, দুচোখ ভরে স্রষ্টার সৃষ্টির রুপ দেখবেন বলে, হয়তো দুজনেই বেরিয়ে পড়েছেন। বয়সের বাধা মানেননি তাঁরা।
গ্যাংটকের এমজি মার্গের রাস্তায়, এক সন্ধ্যায় এরকম আরও এক পরিবারকে পেয়েছিলাম। আমি ট্যুরিস্টদের চলাফেরা দেখছিলাম। অনেকেই মাহাত্না গান্ধীজীর ভাস্কর্যকে সাথে নিয়ে ছবি ক্যামেরা বন্দী করছিলেন। হঠাৎ করেই এক ক্যামেরাম্যান ছবির জন্য রিকুয়েস্ট করলেন আমাকে । এরকম ট্যুরিস্ট স্পটে অনেক প্রফেশনাল ক্যামেরাম্যান থাকেন, ছবি তুলে সংগে সংগেই প্রিন্ট করেও দিয়ে থাকেন। আমি ভাবলাম সেরকম কিছু। আমি না করে দিয়েছিলাম। পরে হঠাৎ মনে হলো, না ইনি সেরকম কেউ না। আমি আবার উনার দিকে ফিরে ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়ে, তাঁর ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে তাঁদের কটা পারিবারিক ছবি বিভিন্ন এংগেলে ক্যামেরাবন্দী করে দিলাম। পরিবারের সবাই ধন্যবাদ জানালেন। আমিও ধন্যবাদ জানালাম, ভালো লাগলো।
গ্যাংটকের পাহাড়ি রাস্তায় চলাফেরা সমতলের মতো অত সহজ নয়। কিন্তু জীবন তাতে থেমে থাকে না। সবাই পরিশ্রম করতে অভ্যাস্ত। পাহাড়ি রাস্তায়, হাঁটা চলা কষ্টকর হলেও স্থানীয়রা তাতে অভ্যস্ত। কি নারী কি পুরুষ, কারো মধ্যেই তেমন অলসতা নেই বোধহয়। সেদিন দেখলাম এক নারী পিঠে বাচ্চা নিয়ে, দুই হাতে দুটো ব্যাগ নিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় উঠছেন। কষ্ট হলেও জীবন তাতে থেমে থাকেনি। এখানে বেশীরভাগ দোকান, বিশেষত মুদি দোকান কিংবা ফলমুল বা কাঁচা বাজারে শাক সবজীর দোকান চালাচ্ছেন মহিলারাই। অনেকেই সিম্পল জিন্সের একটি প্যান্ট এবং একটি টিশার্ট পরে যে যার কাজে ব্যস্ত। হাঁটা চলায় কোন আড়ষ্টতা নেই।
এক সন্ধ্যার কিছু আগে আমরা কাছেই এক সুপার মার্কেটে গেলাম, উদ্দেশ্য কিছু কেনাকাটা। ক্রেতার ভিড় নেই বললেই চলে। দোকানীরা কেউ কেউ বসে গল্প করছেন। এর মধ্যে একটি ছেলে বাচ্চার দিকে আমার চোখ পড়লো। সে খেলে বেড়াচ্ছিলো ছোট গাড়ি নিয়ে। তার অন্য একটি গাড়ি সে আরেকটি কিছুটা বয়সে বড় একটি মেয়ে বাচ্চাকে গিফট দেয়ার চেষ্টা করছিলো। অন্য কাউকেই দেবেনা সেটা সে। অন্য কেউ নেয়ার চেষ্টা করলেই সে কান্না করছে। খেলতে খেলতে সে কিছুটা সামনে এগিয়ে গেছে। এর মধ্যে এক লেডি পুলিশ অফিসারের আগমণ। বাচ্চাটি তাঁকে কিছু বলার চেষ্টা করছিলো। হয়ত সে পুলিশ অফিসারের সাথে বাইরে যেতে চেয়েছিলো। ছোটো গাড়িটি একজনের জিম্মায় রেখে পুলিশ অফিসার বাচ্চাটিকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে বেশ কিচ্ছুক্ষণ পরে ফিরে আসলেন। এর মধ্যে বাচ্চাটির মা বাচ্চার খোঁজ নিলেন, অন্য একজন তাঁকে জানালেন, ও পুলিশ অফিসার লে যায়ে। বাচ্চার মা নিশ্চিন্তই থাকলেন। সেই লেডি পুলিশ অফিসার যখন বাচ্চাটিকে নিয়ে ফিরে আসছিলেন, আমি তাঁর বাহ্যিক সৌন্দর্যের সাথে পুলিশি দায়িত্ব এবং সংগে মানবিক দিকটি মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছিলাম। আমার কাছে বিষয়টি বেশ আকর্ষনীয় এবং সৌন্দর্যমন্ডিত মনে হয়েছিলো। আমি অবাক হয়ে বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে ছিলাম তাঁর দিকে । এক দৃষ্টিতে আমার তাকিয়ে থাকায় পুলিশ অফিসার কিছুটা লজ্জা পেলেন কিনা বুঝতে পারিনি! আমার মনে হয়েছিলো তিনি মাথা নিচু করে নিয়েছিলেন, লজ্জাবনত হয়েছিলেন । সত্যি বলতে কি, বাহ্যিক সৌন্দর্যের সাথে তাঁর এই মানবিক দিকটির মিশেল আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
পরদিন আমরা সাংগু লেক ঘুরে আসলাম। লেকটা মোটামুটি বেশ সুন্দর, কিন্তু পথের সৌন্দর্য এক কথায় অসাধারণ। একে ক্যামেরায় ধারণ করা স্রেফ অসম্ভব। স্রস্টার এ এক অপরুপ সৃষ্টি। গ্যাংটক থেকে বেরিয়ে আমরা আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে উপরে উঠতে শুরু করলাম। পাহাড়ের পরতে পরতে সৌন্দর্যের হাতছানি। মেঘেদের উড়াউড়ি । দু’এক জায়গায় ভিজিট পারমিশন এবং চেকিং শেষে প্রায় তিন ঘন্টার বিরতিহীন যাত্রা শেষে পাহাড়ের শিখরে সাংগু লেকের কাছে গিয়ে পৌঁছলাম আমরা । সেখানে লেকের চারপাশ ঘোরার জন্য ইয়াক আছে, পাহাড়ের সৌন্দর্য আরও ভালো ভাবে দেখার জন্য আছে রোপওয়ে। লেক থেকে পানির প্রবাহ নেমে ঝর্ণা হয়ে পাহাড়ি নদীর সৃষ্টি হয়েছে। সেসব দৃশ্য এক কথায় অসাধারণ। সাংগু লেক যাবার আগে গুগলে সার্চ দিয়ে দেখলাম, টেম্পারেচার ৭/৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস। ঝুঁকি নিই নাই আমি। জ্যাকেটটা সাথে নিয়েছিলাম। কিন্তু কাছাকাছি গিয়ে উপায়ন্তর না দেখে কানটুপিও কিনতে হয়েছিল দেড়শ রুপি দিয়ে । সংগী ইকবাল ভাই জ্যাকেট ভাড়া নিলেন একশ রুপিতে, আর সারোয়ার ভাই বীরপুরুষ। গায়ে কাঁটা দিলেও যথারীতি বীরত্ব দেখাচ্ছিলেন তিনি। উল্লেখ্য, লেকের কাছাকাছি একটি হোটেল কাম সপিং সেন্টারে ছোট্ট একটি যাত্রা বিরতি ছিল আমাদের। সেখানেই ওয়াসরুম সারা, গরম কফিতে চুমুক দেয়া ইত্যাদি সেরে নিয়েছিলাম। নাস্তার ব্যবস্থা ছিলো। গরম কাপড় ভাড়া বা কেনা দুটোই মিলবে সেখানে। যথারীতি, পরিবেশনে ছিলেন স্থানীয় নেপালী লেডিরাই।
ফেরার পথে ফিফটিন মাইল নামক জায়গায় আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। আহ কি অদ্ভুত, কি ভয়ংকর সৌন্দর্য! সে সৌন্দর্য আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে, ডুব দিতে ইচ্ছে করবে আপনার, সে সৌন্দর্যের মাঝে। মনে হচ্ছে মেঘ রুপসীরা পাহাড়ের একেবারে নীচ থেকে নৃত্য করতে করতে উপরে উঠে আসছে, আমাদের মন ভিজিয়ে দিতে। আছে ঝর্ণাধারা। শুধু অপলক চোখে তাকিয়ে থেকে স্রষ্টার এ সৃষ্টিকে দেখতে ইচ্ছে করবে। সেখানকার সৌন্দর্য শুধু চোখ মেলে দেখা যায়, তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা যায়। সেই সৌন্দর্যের প্রকাশে ভাষা বড়ই অপ্রতুল, ক্যামেরার লেন্স সেখানে বড়ই অস্বচ্ছ। সুতরাং সেসবের চেষ্টা না করাই ভালো।
শুনেছি নর্থ সিকিম আরো অনেক সুন্দর। ল্যাচেন, লাচুং, গুরুদংমার লেক, ইয়ামথাং ভ্যালি কিংবা গ্রেট চীনের সীমান্ত এলাকা জিরো পয়েন্টের অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো। এবার সময়ের অভাবে যাওয়া হলো না। যাবো নিশ্চয়ই একদিন। সাগরে ঢেউয়ের নৃত্য নিশ্চয়ই অনিন্দ্য সুন্দর এক দৃশ্য, বলার অপেক্ষা রাখে না । কিন্তু পাহাড়ের সৌন্দর্য? বিশেষ করে হিমালয় দুহিতা দার্জিলিং কিংবা গ্যাংটকের পরতে পরতে যে সৌন্দর্য হাতছানি দেবে আপনাকে বারবার সেটা? সত্যি বলছি ভ্রমণের নেশা বেড়ে গেছে আমার, হোক সেটা সাগরের ঢেউয়ের নৃত্যে কিংবা পাহাড়ের অসমতায়, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের নোনা জলে কিংবা সাংগু লেকের পথে পথে । বিশ্বাস করুন, এ এক নেশার জগৎ!
যা কাজে লাগতে পারেঃ
১. রুপি -বর্ডার পার হয়ে ফুলবাড়িতেই টাকা ভাঙ্গানো যায়। আমরা ৮১ রুপি করে রেট পেয়েছিলাম। ফেরার সময় ১২০ টাকা করে পেয়েছিলাম। অবশ্যই দরদাম করে নিবেন। দার্জিলিঙে টাকার রেট খুবই কম দিতে চায়। ডলার নিলে দার্জিলিং বা গ্যাংটকে ভাংতে পারবেন।
২. ভাষা -বাংলা অনেকেই বোঝেন, আবার অনেকেই বোঝেন না, তবে ইংলিশ প্রায় সবাই বোঝেন।
৩. খাবার-দার্জিলিঙয়ে হোটেলের অভাব নেই। গ্যাংটকে খাবার দাবারে কিছু সমস্যা আছে। এই রুটে গেলে, বাংলাবান্ধা বর্ডারের কাছেই, ঘরোয়া পরিবেশে খাওয়ার মতো একটা সুন্দর হোটেল আছে। খাবারের মান বেশ চমৎকার। আমরা যাওয়ার দিন এবং আসার দিন সেখানেই তৃপ্তির সাথে দুপুরের খাবার খেয়েছিলাম।
৪. ট্যাক্সি – যেখানেই যান, শুরুতেই তাকে আপনার রুট প্লান ভালো করে বুঝিয়ে, দরদাম করে ঠিক করে নিবেন।
৫. শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটক এবং রিভার্স বাস সার্ভিস আছে। শেয়ারড কার আছে। পাঁচ/ছয়জনের গ্রুপ হলে ঘুরতে সবচেয়ে ভালো হবে।
৬. সিকিমের বর্ডারে আলাদা পাশ নিতে হয়। নো খরচ। গ্যাংটকের বাইরে সব স্পটের জন্যই পাশ নিতে হবে। ট্যুর অপারেটরাই সব ঠিক করে দেবে। আপনাকে শুধু দরদাম করে নিতে হবে প্যাকেজ হিসেবে । সুতরাং পাসপোর্ট, ভিসা ১০/১২ কপি এবং ফটো ১৫/১৬ কপি নিয়ে যাওয়া উচিৎ।
৭. দার্জিলিং এবং গ্যাংটক + আদার পার্ট অব সিকিম, একসাথে ঘুরতে চাইলে সময় কমপক্ষে সাত দিন হলে ভালো হবে।
৮.খরচ:- ট্রাভেল ট্যাক্স আগেই করে নেবেন টাকা ৫০০। আমাদের জন প্রতি প্রায় ১৪০০০ টাকা করে খরচ হয়েছে । উল্লেখযোগ্যঃ ঢাকা টু পঞ্চগড় ট্রেনের টিকেট আপ-ডাউন জনপ্রতি ২১৪৬ টাকা (এসি স্নিগ্ধা), ইমিগ্রেশন, কাস্টমস জনপ্রতি ১০০ করে দুই বর্ডারেই বাংলা টাকায় দিয়েছিলাম, শিলিগুড়ি টু দার্জিলিং ২০০ রুপি পার পারসন (রিজার্ভ ১৫০০-১৮০০), হোটেল ২০০০/২৫০০ পার নাইট, দার্জিলিং টু গ্যাংটক রিজার্ভ ২২০০ রুপি, গ্যাংটক লোকাল সাইট সিইং রিজার্ভ কার ১২০০ রুপি, সাংগু লেক রিজার্ভ ৫৫০০ রুপি, পাঁচ জন। (নর্থ সিকিম ১৭৫০০ থেকে ২২০০০ রিজার্ভ একরাত থাকা খাওয়াসহ ৫/৬ জন, আমাদের যাওয়া হয়নি সময়ের অভাবে) ।
৯. গ্যাংটকের বাইরে নর্থ সিকিম বা ইস্ট সিকিমে বেশ ঠান্ডা। ওয়েদার ফোরকাস্ট দেখে যাবেন অবশ্যই। গরম কাপড় নিতে ভুলবেন না।
১০.টুকটাক কেনাকাটা দার্জিলিং বা গ্যাংটকে না করে শিলিগুড়িতে করা ভালো হবে। সেক্ষেত্রে ফেরার দিন শিলিগুড়িতে রাত কাটিয়ে কেনাকাটা সেরে বর্ডার পার হউন।
১১. সবশেষে যেটা না বললেই নয়, আমরা যেখানেই যাই না কেন, আমাদের চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব কিন্তু আমাদেরই।
Source: Mk Zaman <Travelers of Bangladesh (ToB)