নীল নয়নার কাজল চোখে গোমুখ

গাঙ্গোত্রী থেকে তিনজন মিলে গোমুখের পথে ট্রেক শুরু করেছিলাম। চারদিকের সবুজ পাহাড়, দূরের শ্বেতশুভ্র পর্বতমালা, পাশ দিয়ে বসে যাওয়া প্রমত্তা গঙ্গা দেখতে দেখতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। একটা যায়গায় এসে প্রথমবারের মত একটা স্বপ্নের ঝুলন্ত সেতু পেলাম সেটা গঙ্গার স্রোত ধারার সাথে মিশে যেতে চাওয়ায় একটি বেশ বড় ঝর্ণার সাথেই ঝর্ণা ধারার উপর থেকে দুই পাহাড়ের সংযোগ ঘটিয়েছে। বেশ ঝুঁকিপূর্ণ, কিছুটা নড়বড়ে কাঠের সেই সেতু পেরিয়ে ওপারে পৌঁছেই এক নীল নয়নার চোখে পড়লো!

আহা, কিসের পাহাড়, কিসের তুষার, কিসের গঙ্গার জলধারা আর কিসের নীল আকাশ? সবকিছু যে এক নিমিষেই তার মায়াবী চাহুনি, লাজুক হাসি আর কাঁচের চুড়ির মত কণ্ঠের কাছে হার মেনে গেল! উফ, কি দরকার ছিল এমন কারো চোখে চোখ পড়ার? কি দরকার ছিল অমন হাসি বিনিময়ের আর কি-ইবা দরকার ছিল রেশমি চুড়ির মত কণ্ঠের হাই বলে ওঠার! তার উপর পরিচিতি পর্বে যখন জানলাম সে এসেছে অন্যতম প্রিয় দেশ আর্জেন্টিনা থেকে, তখন তো ভালোলাগা যেন আরও বেড়ে গেল মুহূর্তেই!

বিশাল বড় একটা আর্জেন্টাইন টিম, ৩০ জনের গ্রুপ ছিল বোধয়, গোমুখ যাচ্ছে ইয়োগা ধ্যান করতে! ভাবা যায়, সেই কয়েক হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে এই বিশাল একটা টিম শুধু ইয়োগা করতে এমন দুর্গম একটা ট্রেকে এসেছে। ভাবছিলাম, ওদের দেখছিলাম আর হাঁটছিলাম। একটু সামনে গিয়ে পাহাড় থেকে প্রায় ঝুলে থাকা একটা পাথরের উপরে ব্যাগটা নামিয়ে বসে পড়লাম, একটু বিশ্রাম নেব বলে। আমি বসে বসে পাহাড়ের গায়ে গায়ে ওদের হেটে যাওয়া দেখছি। আর ওদের অনেকে আমার এই ঝুলে পড়া পাথরের উপরে বসে থাকা দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।

এদের মধ্যে এক জোড়া চোখ মনে হল যেন আমাকে একটু বেশী বেশী করেই দেখছিল, কিছুটা বিস্ময় নিয়ে! আবার মনের ভুলও হতে পারে সন্দেহ রয়েই গেল। তাই আমি বসে রইলেও, মনের দরজায় যেহেতু একটা সুখের কড়া নাড়া টের পেয়েছি, তাই চুপ করে সেই বিস্মিত চোখ জোড়া যার সেদিকে বা তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়েই ছিলাম। লেখক না হলেও, লেখালেখি যেহেতু একটু আধটু ভালোবাসি তাই কিভাবে কিভাবে যেন কত খবর এই চোখ, মন আর আবেগের কাছে ধরা পড়ে যায়! ঠিক তাই হল, যা সন্দেহ করেছিলাম।

একটু সামনে এগিয়ে গিয়েই সেই চোখ জোড়া আবার পিছনে ফিরে আমাকে দেখলো, মনে হল যেন একটা মায়াবী হাসি দিল দেখে, যা বাবা ঠিক দেখছি তো! নাকি ভ্রম? নাহ উঠে পড়ি পাহাড়ের ঝুলে পড়া পাথর থেকে, আমার ভ্রমটা ভাঙাতে হবে। আমি কি ভুল দেখেছি না সত্যি? নিজের কাছেই নিজের জিজ্ঞাসা আর সেই সমাধান খুঁজে পেতে ট্রেইলে গিয়ে ব্যাগ পিঠে নিয়ে হাটা শুরু করলাম। এবার একটু দ্রুতই পা চালালাম। ১৫ মিনিটের মধ্যেই আর্জেন্টিনা টিমকে ধরে ফেললাম। এবং যা ভেবেছি সেই মায়াবী চোখে চাহুনি দিয়ে যাওয়া মেয়েটি একদম শেষে বেশ ধীরে ধীরে হেটে চলেছে।

গিয়েই তার পাশাপাশি হয়েই হায় জানালাম। আমার হায় পেয়ে যেন লজ্জায় বেগুনী হয়ে গেল! বেশ মোটা ফ্রেমের চশমার ভিতর থেকেও লাজুক চোখের বাঁকা চাহুনি আমার নজর এড়িয়ে গেলনা। সেও বেশ লজ্জাবনত রেশমি চুড়ির ভাঙচুর কণ্ঠে আমাকেও হায় জানালো। বাহ দীর্ঘ, কষ্টকর পথ চলার আর তো কষ্টই রইলোনা দেখছি! চারদিকে পাহাড়, নিচে প্রমত্তা পদ্মা, দূরে শ্বেতশুভ্র পর্বৎ চূড়া আর পাশে যদি থাকে এমন মায়াবী, লাজুক, কাঁচের চুড়ির মত কণ্ঠের কেউ। আর কি কিছু লাগে?

আমার ভাঙা ইংরেজি আর তার তারচেয়েও ভয়াবহ ইংরেজি দিয়ে একে অন্যের পরিচিতি দিয়ে গেলাম। নাম তার অ্যারিনা। শুরু হল অ্যারিনার সাথে, আশেপাশে, কাছে-দূরে, সামনে পিছনে যার যার মত পথ চলা। মাঝে মাঝে দুই একটি কথা খুব সহজ ইংরেজিতে। যার যতটা সাধ্য সেই দিয়ে। এভাবে নানা গল্প কথায় চিরবাসা আর চিরবাসা থেকে ভুজবাসা পৌঁছে গিয়েছিলাম শেষ বিকেলে। ভীষণ ভীষণ ঠাণ্ডা সত্ত্বেও যে যার মত করে একটু ফ্রেস হয়ে বাইরের শেষ বিকেলের পাহাড়ি গোধূলি উপভোগ করতে বেরিয়েছিলাম।

আর তারপর যা দেখলাম তা অবিশ্বাস্য হয়ে আছে আজো আমার কাছে। না আমি পাহাড়ের কোন রূপ, বরফের কোন রঙ, নদীর কোন উচ্ছলতার কথা বলছিনা। আমি বলছি অ্যারিনার কথা, আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম অ্যারিনাকে, আহা। সেই প্রথম তার দিকে ভালো করে চোখ মেলে তাকিয়েছিলাম। কারন এর আগে, সারাদিনে পুরো ট্রেকে যতবার চোখে চোখ রাখতে গিয়েছি কোথায় আর কিসের লজ্জায় যেন সে চোখ নিচে নামিয়ে নিয়েছিল বারবার। ভীষণ লাজুকতায়। লিখি বলেই সেই লাজুক চাহুনির অর্থ আমি আর আলাদা করে খুঁজতে যাইনি।

তবে ফ্রেস হয়ে বের হবার পরে রিসোর্ট এর সামনে দাঁড়ানো অ্যারিনাকে দেখলাম, দুর্লভ নীল দুটি চোখে মোটা ফ্রেমের উপর থেকেই দেখা গেল বেশ সরু করে টানা কাজল, ভাবা যায় অমন এক বিদেশিনী সেই সুদূর আর্জেন্টিনা থেকে এখানে এই দুর্গম পাহাড়ি ট্রেইলে এসে কাজল পড়েছে! অসম্ভব আর দুর্লভ একটা ব্যাপার অন্তত আমার কাছে। তার উপর তার নীল নয়নে কাজলের প্রলেপ কি যে অপূর্বতা তৈরি করেছিল বলে বা লিখে বোঝাবার মত নয় কিছুতেই। যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসাতে একে একে অন্যরা রুমের ভিতরে চলে গেলেও অ্যারিনা আর তার সাথে দুই একজন রয়েই গেল।

ওদের সাথে নানা রকম গল্প সবাই যে যার মত ভাঙা ইংরেজিতে করে চলেছিলাম। এরই মানে হুট করেই আলো আধারির মাঝে অ্যারিনা আমার সাথে সেলফি তোলার ইচ্ছা পোষণ করে বসাতে আমি যারপর নাই অবাক হয়ে গেলাম। দুই তিনটি সেলফি তুলে আবার বিব্রতবোধ কিছুটা কমে যেতে মনে মনে একটি রোমান্টিক গান বেজে উঠলো! ভাবলাম একটু গাই। কিন্তু না ঠিক করলাম আরও একটু পরীক্ষা করে নেই। সেই পরীক্ষার ফলাফল নিজের পছন্দমত হলেই না হয় সেই গান গাইবো! তাই সেইদিনের গল্প শেষে, রাতের খাওয়ার মাঝে মাঝে চোরা চাহুনির সাথে লাজুক হাসি দেখে দেখে ঘুমোতে চলে গেলাম আর পরদিন সকালের অপেক্ষা করতে লাগলাম।

পরদিন সকালে ট্রেকের শুরুতে আমি ইচ্ছে করেই অ্যারিনার চেয়ে একটু দুরত্ত রেখে ধীরে ধীরে চলছি সামনের দিকে। দেখি সে খোঁজে কিনা? হুম ঠিক একটু পরপর পিছন ফিরে চাইছে দেখতে পেলাম। তার মানে, নাহ থাক। আর একটু দেখে নেই। একটু পরেই এসে গেল তাকে বুঝে নেবার দারুণ সুযোগ। ভ্রম নাকি যা ভাবছি একটু হলেও সত্য? দেখা যাক।

সামনে বেশ কিছুটা খাড়া পাহাড় থেকে নদীর উপরে ঝুলন্ত ব্রিজে নেমে গিয়ে আবার ভাঙা পাহাড়, ঝুরো পাথর বেয়ে উপরে উঠতে হবে বেশ ঝুঁকির পথ। ওদের গাইড আগে আগেই চলে গিয়ে টিমের সবাইকে একজন একজন করে হাত ধরে টেনে তুলেছে। কয়েকজন উঠে যাওয়ার পরে অ্যারিনা অন্য একজনের হাতে ভর দিয়ে উপরে উঠে গেল। এবার তবে দেখি আমি ওখানে গেলে সে আমার হাতটাও ধরে কিনা?

বেশ দ্রুত চলে গেলাম সেই ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের বাঁকে, ঝুরো পাথরের কাছে। যেতেই একটা দারুণ মিষ্টি হাসি দিয়ে তার কোমল হাতটা বাড়িয়ে দিল! আমিও আলতো করে তার নরম হাতে হাত রেখে উপরে উঠে গিয়ে, নীল নয়নার কাজল চোখে চোখ রেখে নরম করে থ্যাংকস দিতেই সে লাজুক হাসি দিয়ে, কাঁচের চুড়ির কণ্ঠ দিয়ে ওয়েলকাম জানালে আমি আর দেরি না করে বেশ জোরেই গেয়ে উঠলাম…

পাল এক পাল…
মেহি থামছা গ্যায়া
তু… হাত মে,
হাত জো দে গ্যায়া…

পরিবেশ নোংরা না করি সেটা যেন সব সময় মাথায় রাখি।

Source: Sajol Zahid‎ <Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment