প্রতাপপুর রাজবাড়ি, ফেনী

ঐতিহাসিক নিদর্শণে টান অনুভব করেন এমন মানুষরা এ ঈদে ঘুরে আসতে পারেন।

ভারতীয় উপমহাদেশে মোঘল আমল থেকে ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত বহুল আলোচিত, বিতর্কিত এবং গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় ছিলো জমিদারি প্রথা। প্রভাব প্রতিপত্তির সাথে বিশাল জমিদারি সামলানো জমিদারদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি বর্তমানে ঐতিহাসিক নিদর্শন। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ইতিহাসের সাক্ষি হয়ে দাড়িয়ে আছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন। এসব ঐতিহাসিক নিদর্শের অন্যতম একটি হলো ফেনীর প্রতাপপুর রাজবাড়ি।

ফেনীর মহিপাল থেকে মাত্র ১৮ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে দাগনভূঞা উপজেলার পূর্বচন্দ্রপুর
ইউনিয়নের প্রতাপপুর গ্রামে প্রতাপপুর রাজবাড়ির অবস্থান। ইতিহাসের স্টুডেন্ট হয়ে যেখানে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক নিদর্শণ নিয়ে কাজ করা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে সেখানে এখনো নিজের জেলার বিখ্যাত জমিদারবাড়িতে আমার পা পড়েনি।
রাজকৃঞ্চ সাহার এ রাজবাড়ি দেখার জন্য কয়েক মাস ধরেই মন আনচান করছে আর চোখ চরম অস্থির হয়ে আছে কিন্তু সময় আর সুযোগ বলে বেটে মিলছিলো না। অপেক্ষা রাজার দাপটে চরম প্রভাবে বিশাল জায়গা জুড়ে রাজকিয় কায়দায় দাড়িয়ে থাকা রাজবাড়ির অর্ধভগ্ন নিদর্শণ দেখে চোখ জোড়াকে শান্ত করার।

অবশেষে ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসে ২৮ মে সকাল ১১ টায় দুই বন্ধু মিলে বাইক হাকিয়ে যাত্রা শুরু করি। রাজবাড়ি যাচ্ছি তাই বাইকে গেলেও কেমন জানি ঘোড়ায় চড়ার অনুভূতি পাচ্ছি। আগের রাতে অনলাইনে ভালো করে জেনে নিতে চেষ্টা করলাম রাজবাড়ির ইতিহাস। এখন অপেক্ষা নিজ চোখে দেখার। মহিপাল থেকে মাত্র ৪০ মিনিটে পৌঁছে গেলাম প্রতাপপুর স্কুলের সামনে। এখানে দাড়িয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করতেই “বড় বাড়ি যাইবেন! সামনের মোড় থেইক্কা বামে ঘুইরলেই পাইবেন”। বুঝা গেল স্থানিয় মানুষ প্রতাপপুর রাজবাড়িকে বড় বাড়ি বা রাজবাড়ি নামেই চিনে।

প্রবেশ পথেই প্রথমে চোখে পড়লো সনাতন ধর্মালম্বীদের পূজার ঘরের আদলে তৈরী কাচারি ঘর। এ বাড়িতে এখন কেউ না থাকলেও এখনো প্রতি বছর বৈশাখে সনাতন ধর্মালম্বীরা এ বাড়িকে ঘিরে তিন দিনব্যাপী উৎসব পালন করেন। আর তখন রাজকৃষ্ণ সাহার বাংশধরদের আগমন ঘটে। বাড়ির সামনে বিশাল মেলা বসে। আশেপাশের গ্রাম সহ দূর দূরান্তের মানুষ মেলা দেখতে ছুটে আসেন। এ কাচারি ঘরের সামনেই বিশাল চালতা গাছ। এমন বিশাল চালতা গাছ খুব একটা দেখা যায় না। চালতা গাছের দিকে তাকেই মনে হয় রাজকীয় ভাবে ডালপালা মেলে বিশাল জায়গা দখন করে এখনো রাজকৃষ্ণ সাহার প্রতিনিধিত্ব করে যাচ্ছে।

চালতা গাছ পেছনে ফেলে সামনে তাকালেই চোখে পড়ে রাজপ্রসাদ। দুই রাজপ্রসাদের মাঝ দিয়ে বাড়ির আরো ভেতরে প্রবেশের পথ। ভেতরে প্রবেশ করতেই চেখে পড়ে সামনে পাশাপাশি তিনটি রাজপ্রসাদ রাজকিয় ভাব মাধুর্য নিয়ে দাড়িয়ে আছে। ডানে ফিরে তাকালে চোখে পড়বে দ্বিতল বিশিষ্ট বড় রাজ প্রসাদ। স্থানিয় মানুষ থেকে জানা যায় রাজকৃষ্ণ সাহা এ প্রসাদেই থাকতেন। তার পাশেই আরেকটি ছোট ঘর। জানা যায় রাজকৃষ্ণ সাহারা পাঁচ ভাই ছিলেন। পাঁচ ভাই পাঁচ ঘরে বসবাস করতেন। পাঁচটি প্রসাদে পাশেই পাঁচটি পুকুর এবং ঘর থেকে সোজা পুকুর ঘাটে যাওয়ার রাস্তা ছিলো যার চিহ্ন এখনো আছে। দুইটি পুকুরে ইটের তৈরী সুন্দর ঘাট অর্ধভগ্ন অবস্থায় এখনো অক্ষত আছে।
পুকুরগুলো বাড়ির চারপাশে সুন্দর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।

উইকিপিড়িয়া সহ বিভিন্ন উৎস মতে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে রাজকৃষ্ণ সাহা ৮’শ শতক জায়গার উপর এ বিশাল দৃষ্টিনন্দন বাড়ি নির্মাণ করেন। বাড়িতে ১০ টি ঘর এবং ১৩ টি পুকুর ছিলো। এত বেশি পুকুর বিশিষ্ট জমিদার বাড়ি বাংলাদেশে তেমন দেখা যায় না। তবে কালের বিবর্তণে বর্তমানে ৬ টা পুকুর আর ৬ টা ঘর ঐতিহাসিক নিদর্শণ হিসেবে দাড়িয়ে আছে। বাড়িটি সরকারি বা বেসরকারি কোন ঐতিহাসিক নিদর্শন রক্ষনাবেক্ষণ সস্থার তত্বাবধানে না থাকয় দিন দিন ঐতিহ্য নষ্ট হচ্ছে। কোন ঘরে কোন ভাই থাকতো তা বুঝার কোন উপায় নেই। কোন নেম প্লেট বা খোদাই করা কোন নামের অস্তিত্ব নাই।

স্থানিয় মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায় ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত রাজকৃষ্ণ সাহার বংশধররা এখানে বসবাস করতেন। তখন এলাকায় প্রচুর ডাকাতির প্রকোপ ছিলো। স্থানিয় মানুষদের তথ্য মতে ডাকাতি করতে এসে সুযোগ বুঝে প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে বউ-ঝিদের উপর অত্যাচার চালাত। গ্রামটি ফেনী জেলার একদম বর্ডারে অবস্থিত হওয়ায় থানা থেকে পুলিশ পৌঁছাতে অনেক সময় লাগতো। গ্রামটি বর্তমানে দাগনভূঞা থানার আন্ডারে হলেও ১৯৯৬ তে ফেনী সদরের আন্ডারে ছিলো।
এক সময় আশাপাশের সব এলকা জমিদারদের আন্ডারে ছিলো। এখানে তারা জমিদারি চালাতো এবং খাজনা আদায় করতো। সঠিক সময়ে খাজনা দিতে ব্যর্থ হলে তারা স্থানিয়দের উপর অত্যাচার চালাতো। দেশ ভাগ হওয়ার পরে আস্তে আস্তে তাদের প্রভাব কমতে শুরু করে। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে দুই জন ভারত চলে যায়। আশাপাশের মানুষ জমিদারির শিকল থেকে মুক্তি পেয়ে যায়। দীর্ঘদিন অত্যাচের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া কিছু অতিউৎসাহি মানুষ প্রতিশোধ নিতে চায় যদিও অধিকাংশ স্থানিয় মানুষ বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করে।

বড় পুকুর ঘাটে জহির মুক্তারের সাথে দেখা হলো।
বয়স অনুমান করলে পঞ্চাশের বেশি হবে। জমিতে কাজ করে ক্লান্ত হয়ে গাছের ছায়ায় পুকুর ঘাটে বসে বসে শরীরকে শান্ত করছেন। আমাদেরকে দেখে নিজ থেকেই কথা শুরু করলেন। “রাজবাড়ি চাইতে আইছেন? আমনেগো বাড়ি কন্ডে?”।
তারপর জহির মুক্তার তার ছোট বেলায় রাজবাড়িতে কমলা চুরি করতে যাওয়ার কথা বলে লজ্বার হাসি ছাড়েন। তখন অনেক ছোট ছিলাম। দিনে কাজের জন্য রাজবাড়িতে গিয়ে কমলার বাগান দেখেছিম। গাছের মধ্যে অনেক কমলা দেখে খুব কমলা খেতে ইচ্ছা জাগলো। রাতের বেলা চুপিচুপি এসে ৮/১০ টা কমলা ছিড়ে লুঙ্গির মধ্যে নিয়ে বাঁধতেছি ঠিক তখনই কানে খড় খড় আওয়াজ আসলো। বুঝতে বাকি রইলো না যে কেউ একজন টের পেয়ে আস্তে আস্তে দরজার চিটকিনি খুলতেছে। যেই বুঝা সেই দিলাব দৌঁড়। দৌঁড়াতে গিয়ে কিসের সাথে লাগছে বলতে পারবো না, পায়ের হাটুর নিছে অনেক খানি কেটে গেছে। বাড়িতে যাওয়ার পরে পায়ের কাটা অংশের কারনে আম্মুর কাছেও ধরা খেয়ে যাই। এসব বলতে বলতে লুঙ্গি একটু উপরে তুলে কাটা দাগ দেখালেন জহির মুক্তার।

জহির মুক্তার থেকে বিদায় নিয়ে বাইকে উঠলাম ফিরে আসার জন্য। ওউ হ্যাঁ আপনাদেরকে দেখাবো বলে বাড়িতে ঘুরতে ঘুরতে বিভিন্ন জায়গায় পোজ দিয়ে অনেক স্থিরচিত্র ধারণ করেছি।

কিভাবে যাবেনঃ

ট্রেনে ফেনী রেল ষ্টেশনে নেমে টমটমে করে ২০ টাকা ভাড়া দিয়ে মহিপাল চলে আসুন। আর বাসে আসলে আপনাকে বাস নামাবেই মহিপালে।
মহিপাল থেকে নোয়াখালি রুটের বাস অথবা সিএনজিতে এড়ে সেবারহাট নামবেন। বাসে ৪০ টাকার মত নিবে। সেবারহাট নেমে যে কাউকে বড় বাড়ি বা রাজবাড়ি বল্লে রাস্তা দেখাই দিবে। সেখানে সি এনজি পাবেন মাত্র ২০ টাকায় একদম রাজবাড়ির কাচারি ঘরের সামনে।

ফেরার পথে মহিপালে বিজয় সিংহ দিঘি এবং দিঘির পাশে পার্কে ঘুরে নিতে পারেন। দুপরে খাবার মহিটালে আরাম করে গ্রহন করতে পারবেন।

পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হোন এবং সচেতনতা সৃষ্টি করুন। যেখানে সেখানে ময়লা ফেলবেন না।

Share:

Leave a Comment