বিউটি বোর্ডিং

বিউটি বোর্ডিং…
১ নং শিরিশ দাস লেন, বাংলাবাজার….

অনেক স্মৃতিবিজরিত একটা জায়গা। মূলত এখন খাওয়ার উদ্দেশ্যেই যায় সবাই, দেশি খাবারের ঘরোয়া রান্না’র স্বাদ … তবে ঘুরে দেখার মতো পুরান ঢাকায় এমন সবুজ, শান্ত, নিরিবিলি পাখিডাকা পরিবেশ এখন চিন্তা করা যায় না।

তবে এই বিষয়ে কিছু ইতিহাস জেনে রাখা ভালো …
——-
পেছনের কথাঃ

বিউটি বোর্ডিং ছিল নিঃসন্তান জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের সম্পত্তি।
১১ কাঠা জমির উপর নির্মিত এখন এই জমিদার বাড়ির বয়স প্রায় ১৫০ বছর।
বাংলাদেশের বইয়ের বৃহত্তম মার্কেট বাংলাবাজার সম্পর্কে যার প্রাচীন নাম ছিল বেঙ্গলা নগর এবং এটি মুঘল আমল এর আগে থেকে পর্যটকদের কাছে পরিচিত ছিল। ১৯ শতকে বাংলাদেশে প্রকাশনা ব্যাবসার সূচনা হয় এই বাংলাবাজার থেকে। আর বাংলাবাজারের শ্রীশদাস লেন এর ১ নম্বর বাড়িটিই হলো বিউটি বর্ডিং।

১৯৪৭ সালের আগে বিউটি বোর্ডিংছিল সোনার বাংলা পত্রিকার অফিস এবং মুদ্রন কারখানা। কবি শামসুর রহমান এর প্রথম কবিতা মুদ্রিত হয় এই পত্রিকায়।
পত্রিকা অফিসটি কলকাতা স্থানান্তর হলে পরবর্তিতে এই জমিদার বাড়িটি কিনে নেন প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা ও নলিনী মোহন সাহা । নলিনী মোহন সাহা বাড়িটির কক্ষগুলো একটি দুটি করে ভাড়া দিতে থাকেন এবং নিচতলায় একটি রেস্তোরা স্থাপন করেন।পরবর্তিতে ব্যাবসা ভালো দেখে তিনি তার মেয়ে বিউটির নাম অনুযায়ী বিউটি বোর্ডিং এর ব্যাবসা শুরু করেন।

সাহিত্যের আতুড় ঘর এই বিউটি বোর্ডিং থেকেই স্বদেশ পত্রিকার সুত্রপাত। ততকালিন হাই প্রোফাইল প্রতিভাগুলো সব এখানেই আড্ডা দিত।

আড্ডার ফলশ্রুতিতেই অনেকে তাদের জীবনের সেরা লেখাটি লিখেছেন বোর্ডিং চত্বরটিতে বসে। আবদুল জব্বার খান পরিকল্পনা করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ নির্মাণের। শোনা যায় চিত্রনাট্যের বেশকিছু অংশ লিখেছেনও এখানে বসেই।
এ বোর্ডিংয়ে আড্ডা দেয়ার জন্য আরো আসতেন ফজলে লোহানী, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, সমর দাশ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আল মাহমুদ, সত্য সাহা, গোলাম মুস্তফা, খান আতা, জহির রায়হান, বেলাল চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, সন্তোষ গুপ্ত, ফজল শাহাবুদ্দিন, কবি ইমরুল চৌধুরী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, শফিক রেহমান, আসাদ চৌধুরী, ফয়েজ আহমদ প্রমুখ।
সমর দাস অনেক বিখ্যাত গানের কথায় সুর বসিয়েছেন এখানে আড্ডা দেয়ার ফাঁকেই। জাদুশিল্পী জুয়েল আইচও বেশ কয়েক রাত কাটিয়েছেন বিউটি বোর্ডিংয়ে। শোনা যায়, দেশ ভাগের আগে এ ঐতিহাসিক ভবনে পা রেখেছিলেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস ও পল্লীকবি জসীমউদ্দীন।

কবি শামসুর রাহমান থাকতেন আশেক লেনে, এবং কবি শামসুল হক থাকতেন লক্ষ্মীবাজারে। আর বিউটী বোর্ডিং’র সাথেই অন্য আর একটা পুরনো দালানের দোতলায় থাকতেন কবি শহীদ কাদরী।এখানে আড্ডা দিতে আসতেন সকলে , একজনের চা আরেকজন ভাগ করে খেতেন ।
ভালোই চলছিল সবকিছু……

কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক সেনারা এটি দখলে নেয় এবং প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা, শামস ইরাণী (চলচ্চিত্র শিল্পী), সন্তোষ কুমার দাস (ব্যবসায়ী), প্রেমলাল সাহা (ব্যবসায়ী), ক্ষিতীশ চন্দ্র দে (বোর্ডিং কর্মীর ভাই), নূর মোহাম্মদ মোল্লা (প্রতিবেশী), যোশেফ কোরায়া (অভিনেতা), শীতল কুমার দাস (ম্যানেজার), অখিল চক্রবর্তী (পাচক), সাধন চন্দ্র রায় (কর্মী), সুখরঞ্জন দে (কর্মী), কেশব দত্ত আগারওয়াল (ব্যবসায়ী), নির্মল রায় ও খোকা বাবু (সমাজসেবক), হারাধন বর্মণ (চিত্রশিল্পী), হেমন্ত কুমার সাহা (প্রকাশক), অহীন্দ্র চৌধুরী শংকর (ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব)— এ ১৭ জনকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে ।

স্বাধীনতা পরবর্তি ১৯৭২ সাল পর্যন্ত এটি বন্ধ ছিল। জানা যায় প্রহ্লাদ সাহার সহধর্মিণী প্রতিভা সাহা তার দুই ছেলে তারক সাহা ও সমর সাহাকে নিয়ে পুনরায় চালু করেন বিউটি বোর্ডিং।

এরপর বহু কবি লেখক এখানে বহুবার আড্ডা জমানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আগের মতন সেই সাহিত্যচর্চা , বিতর্ক , আর চায়ের কাপের ঝড় আর ওঠেনি। সৈয়দ শামসুল হক এখান থেকেই সৃষ্টি করেছেন এক মহিলার ছবি, জনক ও কালো কফিন, আরণ্যক, সীমানা ছাড়িয়ের মতো সাহিত্যকর্মগুলো।
বিউটি বোর্ডিং এর ঐতিহ্যকে অম্লান করতে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। আমরা ভ্রমন আড্ডা এখানে বসে করতে পারি । করতে পারি ইতিহাসের চর্চা।
——
বর্তমানে খাবার এবং থাকার ব্যবস্থাঃ
দোতালা বোর্ডিং এর নিচ তলায় খাবার ব্যবস্থা। দুপুরে বেশ ভিড় থাকে তাই ১:৩০টার আগে যাওয়াই ভালো। মেন্যু ভাত,ভর্তা,সবজি ভাজি,ডাল- দাম ১৫ থেকে ২৫ টাকা, সরশে ইলিশ, ইলিশের ডিম ভাজি, মুরগি-৯০ থেকে ১৩০ টাকার মধ্যে। আইটেম সবদিন এক থাকেনা।
খাওয়ার পরও যতক্ষণ ইচ্ছা লনে বা বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে গল্প করা যায়। ফটোগ্রাফির জন্য পারফেক্ট একটা প্লেস। আর কয়েক ঘন্টার জন্য সত্তর আশির দশকে চলে যাওয়া।

ইতিহাস, ছবি এবং তথ্য উপাত্ত সংগৃহীত—

Share:

Leave a Comment