মহেশখালী সোনাদিয়া ভ্রমণকথা
বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালী কক্সবাজার থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। জনশ্রুতি আছে,১৫৫৯ সালের প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই দ্বীপের সৃষ্টি হয়।পান,মাছ,শুটকি,চিংড়ি,লবণ ও মুক্তা উৎপাদনে এই উপজেলার সুনাম রয়েছে। মহেশখালী উপজেলায় সোনাদিয়া,ধলঘাটা ও মাতারবাড়ি নামে তিনটি ছোট দ্বীপ রয়েছে।
সোনাদিয়া এদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর। এই দ্বীপটির আয়তন প্রায় ৯ বর্গ কিমি। তিন দিকে সমুদ্র সৈকত, সাগর লতায় ঢাকা বালিয়াড়ি, কেয়া- নিশিন্দার ঝোপ, ছোট-বড় খাল বিশিষ্ট প্যারাবন এবং বিচিত্র প্রজাতির জলাচর পাখি দ্বীপটিকে করেছে অনন্য বৈশিষ্ট্যমন্ডিত।দ্বীপের মূল আকর্ষণ সম্ভবত স্বচ্ছ নীল পানি আর সমগ্র সৈকত জূড়ে ছোটাছুটি করা অসংখ্য লাল কাকড়া। সোনাদিয়া দ্বীপের মানব বসতির ইতিহাস মাত্র ১০০-১২৫ বছরের।দ্বীপটি ২টি পাড়ায় বিভক্ত। পূর্ব ও পশ্চিম পাড়া। দ্বীপের মোট জনবসতি প্রায় ২০০০ জন। এই দ্বীপে ২টি মসজিদ, ১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১টি সাইক্লোন সেন্টার, আনুমানিক ১২টি গভীর নলকূপ রয়েছে। পূর্ব পাড়ায় তুলনামূলকভাবে জনবসতি বেশী।
ক্যাম্পিং করার জন্য আদর্শ একটা জায়গা এই সোনাদিয়া, বন্ধুরা মিলে তাবু নিয়ে দুইদিনের জন্য ছুটে যেতে পারেন নির্জন এই দুটি দ্বীপে। বিশেষ করে চাঁদনী রাতে সোনাদিয়ার সৈকতে একটা রাত ক্যাম্পিং আর বার বি কিউ পার্টি করে দেখতে পারেন, দেখুন দুনিয়াটা কত সুন্দর।গত বছর ১৯ জনের দল নিয়ে আমারো সুযোগ হয়েছিলো এই অপার্থিব সৌন্দর্য উপভোগ করার। সেই সুবাদে এই ভ্রমণ বৃত্তান্ত রচনা!
টিওবির নিয়মানুযায়ী এখানে ৫টার বেশি ছবি দেয়া সম্ভব হলো না।তবে এই স্থানের প্রকৃত সৌন্দর্য বোঝার জন্য আপনার নিচের এলবামটা দেখা উচিতঃ
কীভাবে যাবেন?
মহেশখালী-সোনাদিয়া যাওয়ার জন্য আপনাকে আগে চট্টগ্রাম আসতে হবে। চট্টগ্রাম থেকে আপনি দুই ভাবে যেতে পারেন।নৌপথে আর সড়ক পথে।
নৌপথঃ
চট্টগ্রাম থেকে আপনাকে সরাসরি যেতে হবে কক্সবাজার।দামপারা আর নতুন ব্রিজ থেকে অনেক বাস আছে।ভাড়া ২৫০ টাকা জনপ্রতি।আনুমানিক ৪ ঘণ্টায় আপনি পৌঁছে যাবেন।কক্সবাজারের ডলফিন মোড়ে নেমে রিকশা/সিএনজি/টমটম নিয়ে আপনাকে যেতে হবে ৬ নং ঘাট।এক্ষেত্রে টমটম/সিএঞ্জি ১০০ টাকা আর রিকশা ৫০ টাকা ভাড়া নিবে।সেখানে মহেশখালী যাওয়ার জন্যে স্পীড বোট পাবেন। ভাড়া প্রতিজন ৭৫ টাকা। মহেশখালী ঘাটে পৌঁছতে সময় লাগবে ১২-১৫ মিনিট। স্পীড বোটে চড়তে ভয় লাগলে গাছের বোটে চড়ে আসতে পারেন। ভাড়া ৩০ টাকা। সময় লাগবে ৪৫-৫০ মিনিট। মহেশখালী ঘাটে নেমে রিক্সা নিয়ে চলে আসবেন গোরকঘাটা বাজার। ভাড়া ২০ টাকা। এরপর আপনাকে যেতে হবে ঘটিভাঙ্গায়।মহেশখালীর গোরকঘাটা থেকে ঘটিভাঙার দূরত্ব ২৪ কিলোমিটার। ৩-৪ জন হলে একটা সিএনজি নিয়ে যেতে পারেন ঘটিভাঙ্গা। ভাড়া ১৫০-১৭০ টাকা।ঘটিভাঙা নেমে খেয়া নৌকায় সোনাদিয়া চ্যানেল পার হলেই সোনাদিয়া। ভাটার সময় খালে খুব বেশি পানি থাকেনা। সোনাদিয়া যাওয়ার দুটো উপায় আছে। হেঁটে যাওয়া অথবা জোয়ার এলে নৌকা। প্রতিদিন জোয়ারের সময় পশ্চিম সোনাদিয়া থেকে ঘটিভাঙা পর্যন্ত মাত্র একবার একটি ট্রলার ছেড়ে আসে। এই ট্রলারটিই কিছুক্ষণের মধ্যে যাত্রীদের তুলে নিয়ে আবার ফিরতি যাত্রা করে। ভাড়া প্রতিজন ২৫ টাকা।
সড়কপথঃ
চট্টগ্রামের নতুন ব্রিজ থেকে চকরিয়া বা কক্সবাজারগামী যেকোনো বাসে উঠে যেতে হবে।নামতে হবে চকরিয়া বাস টার্মিনালে।সময় লাগবে প্রায় ৩ ঘন্টা। জনপ্রতি ভাড়া ১৭০ টাকা।সেখান থেকে চাঁদের গাড়ী বা জিপ নিয়ে আপনাকে যেতে হবে বদরখালী।এখানে জনপ্রতি ভাড়া ৫০ টাকা করে আর পুরো গাড়ী রিজার্ভ করলে ৭০০ টাকা।গাড়িতে ১৩/১৪ জন বসা যায়।চকরিয়া-বদরখালী রাস্তাটা খুবই সুন্দর।বদরখালী পৌঁছাতে প্রায় ৪০ মিনিট লাগবে।সেখান থেকে আবার সিএনজি করে আপনাকে যেতে হবে মহেশখালীর ঘটিভাঙ্গা।এটা প্রায় ১.৫ ঘন্টা সময় নিবে।পুরো সিএঞ্জি ভাড়া নিবে প্রায় ৪০০ টাকা করে।এরপর আগের পদ্ধতিতে আপনি সোনাদিয়া যেতে পারেন।
আমার পথঃ
এবার আসি আমি কোন পথ অবলম্বন করেছি সে কথায়।যাওয়ার সময় আমি নৌপথে গিয়েছি।তবে এক্ষেত্রে আমি কক্সবাজারের ৬ নং ঘাট থেকে ২ দিনের জন্য একটা ট্রলার রিজার্ভ করে নেই এবং মহেশখালী না গিয়ে সরাসরি সোনাদিয়া চলে যাই। এক্ষেত্রে সুবিধা হচ্ছে,আমরা নিজেদের ইচ্ছা মতন নৌকা নিয়ে আসে পাশের আরো অনেক চড় ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়েছি।পরদিন একই নৌকা আমাদেরকে মহেশখালী নামিয়ে দেয়। ফেরার সময় আমরা সড়ক পথে ফিরে যাই।এতে করে সড়ক ও নৌপথ,২টার মজাই পাওয়া যাবে।আমাদের কাছে ২ দিনের ট্রলার ভাড়া নিয়েছিলো ৪০০০ টাকা।এতে প্রায় ২৫ জন বসা যাবে।
কোথায় ঘুরবেন?
মহেশখালীঃ মহেশখালীতে ঘুরার জন্য টমটম সবচেয়ে ভালো।আমরা সারাদিন ঘুরার জন্য টমটম রিজার্ভ করে নেই।একটা টমট্মে ৮ জন বসতে পারে।আমাদের কাছে পুরো দিনের জন্য ভাড়া নিয়েছে ৮০০ টাকা।মহেশখালীর নিচের স্থানগুলো ঘুরা আবশ্যক।
১।আদিনাথ মন্দির
২।বৌদ্ধ মন্দির
৩।স্বর্ণ মন্দির
৪।মহেশখালী ঘাট
৫।পানের বরজ
৬।রাখাইন পাড়া
৭।সমুদ্র সৈকত
৮।শুটকি বাজার
সোনাদিয়াঃ সোনাদিয়া মূলত ২টি পাড়ায় বিভক্ত।পূর্ব পাড়া আর পশ্চিম পাড়া।মূল বসতি ও ক্যাম্পসাইট হলো পশ্চিম পাড়ায়। পূর্ব পাড়াটা নৌকা দিয়ে যাওয়ার সময়ই ঘুরে ফেলতে হবে।নৌকা আধা ঘণ্টার জন্য ভিড়ীয়ে ঘুরে ফেলে আবার পশ্চিম পাড়া চলে গেলে ভালো হয়। কারণ পায়ে হেটে পূর্ব পাড়া হতে পশ্চিম পাড়া যাওয়াটা বেশ কষ্টসাধ্য।
পশ্চিম পাড়া সৈকতেই মূলত আপনাকে টেন্ট সেট করতে হবে।যদিও এখানে টেন্ট ভাড়া পাওয়া যায়,তবে আমরা সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলাম।পশ্চিম পাড়ায় আছে কাছিম প্রজনন কেন্দ্র।সিজনে আসলে আপনি এখানে কাছিম দেখতে পাবেন।এছাড়াও আছে শুটকিপল্লী যা দেশের সর্ববৃহৎ শুটকি উৎপাদন কেন্দ্র।এখানে আপনি সরাসরি মাঠে রোদ থেকে নিজের পছন্দ মত শুটকি বাছাই করে কিনে নিতে পারবেন।আবার এর পেছনের দিকে সামান্য সোয়াম্প ফরেস্টও আছে।
কোথায় খাবেন?
মহেশখালিতে তো আপনি অনেক হোটেল পাবেন খাওয়ার জন্য,কিন্তু সোনাদিয়া তে হোটেল তো দূরে থাক,কোন টং দোকানও পাবেন না।তাই এক্ষেত্রে আপনাকে স্থানীয় কোন বাড়িতে খাবারের ব্যাবস্থা করতে হবে।আমরা সৈকতের কাছেই সাইফুল ভাই এর বাড়িতে খাবারের আয়োজন করেছি।খাবারের পাশাপাশি তাদের বাথরুম ব্যবহার করেছি আমরা।এছাড়া ওই বাড়ির দুইজন সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে সারা রাত আমাদের তাঁবু পাহাড়ায় ছিলো।এগুলোর সাথে আমাদের ১৯ জনের ৩ বেলা খাবার বাবদ তাকে মোট ৮০০০ টাকা দিতে হয়েছে।খাবারের মেনু ছিলো কোড়াল মাছ,শুটকি ভর্তা,আলু ভর্তা,ডাল।কারো লাগলে সাইফুল ভাই এর সাথে যোগাযোগ করতে পারেন- ০১৮৫০৩৯৩৪৬৩। তিনিই আমাদেরকে ট্রলার ঠিক করে দিয়েছিলেন।
সতর্কতাঃ
১।কক্সবাজারের মত মহেশখালী/সোনাদিয়ার সৈকতে ডেইঞ্জার পয়েন্ট চিহ্নিত করা নেই।নেই কোন রেসকিউ টিম।তাই সাগরে নামার সময় সাবধানে থাকুন।
২।সোনাদিয়ার পুরো দ্বীপে কোন দোকানপাট বা বাজার পাবেন না।তাই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আগে থেকেই নিয়ে আসুন।
৩।সোনাদিয়ায় বিদ্যুত নাই।তাই পাওয়ার ব্যাংক আবশ্যক।
৪।স্থানীয় মানুষজন খুবই অতিথিপরায়ণ।তবু এদের সাথে কোন তর্কাতর্কিতে না যাওয়াই ভালো।
৫।চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় দক্ষতা না থাকলে যোগাযোগে আপনার বেশ ঝামেলা পোহাতে হতে পারে।
৬।জোয়ার-ভাটার ব্যাপারে বিশেষ জ্ঞান রাখা লাগবে।
Source: Saadman Ishraque <Travelers of Bangladesh (ToB)