মহেড়া জমিদার বাড়ি
ঢাকার অদূরে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের মহেড়া ইউনিয়নিয়নের মহেড়া গ্রামে অবস্থিত মহেড়া জমিদার বাড়ি , যেখানে নীলাকাশ, ছোট করে ছেটে রাখা সবুজ ঘাসের কার্পেট, শতাধিক বর্ষের সহস্রাধিক স্মৃতি বিজড়িত সুরম্য ভবনসমূহ সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে দর্শনার্থীর অপেক্ষায় থাকে , যা আমাদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করে দেয় । টাংগাইলে অনেকগুলো জমিদার বাড়ি আছে , মহেড়া জমিদার বাড়ি তার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ।জমিদার বাড়ির অপূর্ব কারুকাজ ও নির্মাণশৈলী আপনাকে মুগ্ধ করবে ।বিশাল এলাকা জুড়ে মহেড়া জমিদার বাড়ি অবস্থিত। হঠাৎ দেখলে মনে হবে কালের সাক্ষী হয়ে সবুজ ঘাসের চাদরে যেন ফুটে আছে বিশাল বিশাল শ্বেতপদ্ম! স্পেনের করডোভা নগরীর আদলে নির্মিত ভবনগুলোর নির্মাণ শৈলি রোমান, মোঘল, সিন্দু খেকুদের সাথে মিল রয়েছে।
মহেড়ার জমিদাররা ছিল শাহা বংশের। বংশীয় ভাবে বনেদী ব্যবসায়ী। সুদূর কলকাতা থেকে মহেড়া এসেছিল ব্যবসার জন্য। ১৮৯০ সালে তৎকালীন জমিদারগণ চার ভাই মিলে জমিদারি পত্তন করেন। তাদের নাম বুদাই সাহা, বুদ্ধু সাহা, হরেন্দ্র সাহা এবং কালীচরণ সাহা। তবে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম সবাই রায় চৌধুরী পদবী গ্রহণ করেন। জমিদার বাড়ি নির্মাণ হয় চার অংশে।মহেড়া জমিদার বাড়িটি মূলত চারটি ভবনে বেষ্টিত। মহারাজ লজ, আনন্দ লজ, চৌধুরী লজ এবং কালীচরণ লজ। বাড়িটির মোট ৮ একর জমির উপর অবস্থিত। জমিদার বাড়ির সামনেই রয়েছে ‘বিশাখা সাগর’ নামে বিশাল এক দীঘি। বাড়িতে প্রবেশের জন্য রয়েছে ২টি সুরম্য গেট। ভবনের পিছনে রয়েছে পাসরা পুকুর এবং রানী পুকুর।
বৃটিশ সরকার জমিদার প্রথা চালু করলে কালীচরণ সাহা ও আনন্দ সাহার পুত্ররা করটিয়ার ২৪ পরগনার জমিদারদের নিকট থেকে একটি অংশ বিপুল অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করে নেন। শুরু হয় জমিদারী শাসন ও শোষন। কালীচরণ সাহা ও আনন্দমোহন সাহার উত্তরাধিকারী রাজেন্দ্র রায় চৌধুরী পর্যায় ক্রমে জমিদারী পরিচালনা করেন। এসব শাসকগণ এলাকায় বিদ্যালয়, রাস্তা ঘাট, পানির ব্যবস্থা সহ অনেক জনকল্যানমূলক কাজ করেন।বৃটিশ শাসনের শেষের দিকে জমিদার শাসন বাতিল হয় এবং পরবর্তিতে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভগের পর জমিদারদের অধিকাংশই ভারতে চলে যান।
প্রাসাদ কমপ্লেক্সে প্রবেশ করার জন্য কালিচরন লজ আর চৌধুরী লজের সামনে রয়েছে দুটি সিংহ দরজা। এর মধ্যে চৌধুরী লজের সিংহ দরজার সমানে বিশাখা সাগরের পারে উঁচু ছয়টি স্বতন্ত্র কোরান্থিয়ান ধাঁচের স্তম্ভ সারি থাকায় ধারনা করা যায় এটাই জমিদার বাড়ির মূল প্রবেশ পথ ছিলো।
এক নং গেইট দিয়ে প্রবেশ করলে প্রথমে চোখে পড়বে কালিচরন লজের সামনের চোখ ধাধানো নকশার এক তলা ভবন, যা বর্তমানে মিউজিয়াম হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে ।এই ভবনের সাথে কালিচরন লজ এমন জ্যামিতিক বিন্যাসে তৈরি করা হয়েছে , দূর থেকে দেখলে একে কালিচরন লজের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে হয় ।ভবনের সামনের দিকের উন্মুক্ত কক্ষে দুই সারি অনুচ্চ স্তম্ভের উপরে নির্মিত ত্রিফয়েল আর্চের সারি এবং দেয়ালে তিনটি বড় কুলঙ্গি। ভবনের চূড়ায় ত্রিকোণাকার পেডিমেন্টে পদ্ম, শঙ্খ, গদা, চক্র ও ‘ওম’ চিহ্ন দেখে ধারনা করা যায় , এটা সম্ভবত মন্দির ছিলো । এই ভবনের সামনে বড় একটা ঘাসে ছাওয়া লন আর একপাশে গোমস্তা ভবন’ নামের এক তলা স্থাপনা।
কালিচরন লজের পশ্চিম পাশের দ্বিতল ভবনের নাম চৌধুরী লজ ।চুন সুরকি আর ইটের সমন্বয়ে তৈরি ভবনটির কার্নিশ, প্যানেলের কারুকাজ চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। এর দোতলায় উঠার সিঁড়ির রেলিং আর বারান্দায় আছে কাস্ট আয়রনের কারুকাজ করা রেলিং।এর সামনের বাগানে বাঘ, হরিণ আর বিভিন্ন পশু-পাখির মূর্তি রয়েছে। সেই আমলে জমিদাররা পশু-পাখি পুষতেন। সেই স্মৃতিতেই বুঝি মূর্তিগুলো বানানো।
চৌধুরি লজের পেছনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গার পরে একতলা আরেকটি ভবন, যা বর্তমানে অথিতি ভবন নামে পরিচিত । ভবনটির সামনের দিকে অনুচ্চ স্তম্ভের উপরে নির্মিত ত্রিফয়েল আর্চ যুক্ত প্রবেশদ্বার আছে।
অলংকরণের দিক থেকে আনন্দ লজটিকে সবচেয়ে সুন্দর মনে হয়। প্রাসাদের সম্মুখভাগে দোতলা পর্যন্ত লম্বা ছয়টি কোরান্থিয় স্তম্ভ , সামনের দিকে দুপাশে কারুকাজ করা দুটি ভ্যানিসিয় ঝুল বারান্দা , ছাদের রেলিং এবং কার্নিশে ফুলের মালা আর জ্যামিতিক অলংকরণ প্রাসাদটিতে আলাদা সৌন্দর্য্য যোগ করেছে।দু’পাশের বারান্দার উপরে প্যাঁচানো ধাঁচের লেগো দেখে মনে হয় এটি মহেড়া জমিদারির সিল!
জমিদার বাড়ির সর্ব পশ্চিমের ভবনের নাম মহারাজ লজ । এই লজ হচ্ছে সর্ববৃহৎ স্থাপনা, যা জমিদার গজেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরীর। ১২টি কক্ষ নিয়ে ভবনটি স্থাপিত।এসব স্থাপনা ছাড়াও এই জমিদারি কমপ্লেক্সের পেছনের দিকে রানী মহল, কর্মচারীদের থাকার জন্য নায়েব ভবন ও কাচারি ভবন নামে দুটি একতলা ভবন আছে । জমিদার বাড়ির সমস্ত এলাকা সুউচ্চ প্রাচির দ্বারা সুরক্ষিত।
১৯৭১ সালের ১৪ ই মে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে পাকবাহিনী মহেড়া জমিদার বাড়ীতে হামলা করে ।জমিদার কূলবধু যোগমায়া রায় চৌধুরীসহ পাঁচজন গ্রামবাসীকে চৌধুরী লজের মন্দিরের পেছনে একত্রে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে তারা। তাদের মধ্যে স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক পন্ডিত বিমল কুমার সরকার, মনিন্দ্র কুমার চক্রবর্তী, অতুল চন্দ্র সাহা এবং নোয়াই বণিক ছিলেন। এরপরই জমিদার পরিবার দেশত্যাগ করেন।
মহেড়া জমিদারবাড়ি সভ্যতা আর ঐতিহ্যের এক অমূল্য নিদর্শন।অনিন্দ্যসুন্দর কারুকার্য আর বিশাল মহলগুলো আজো দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে ।পুরোনো হাজারো স্মৃতি, সুখ-দুঃখের কীর্তি লেপে আছে এই বাড়ির প্রতিটি পরতে।এই জমিদাররা অন্যান্য জমিদারদের মত অত্যাচারী ছিল না। করেছিল এলাকায় উন্নয়নের জন্য অনেক কাজ। তবু মেনে নিতে হয় তাদের করুন পরিনতি। এর প্রতিটি ইট , প্রতিটি দেয়ালে লেখা আছে বেদনা বিধুর ইতিহাস। মহেড়া এখন পিকনিক স্পট, পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার। তবে ইতিহাস খোজা মানুষের কাছে মহেড়া এক হাসি কান্না আর আর্তনাদের ইতিহাস।
ঢাকার মহাখালি থেকে নিরালা বাসে অথবা কল্যানপুরের খালেক পেট্রোল পাম্পের সামনে থেকে সোনিয়া / সকাল সন্ধ্যা বাসে উঠে পাকুল্লার পর পুলিশ রোড / ডুবাইল বাস স্ট্যান্ড নেমে সি এন জি নিয়ে জমিদার বাড়ি যেতে পারেন।
Post Copied From:Rassel Hossain>Travelers of Bangladesh (ToB)