মালদ্বীপ যেন সিম্পলের মধ্যে একটু গর্জিয়াস ভ্রমণ

আট দিন শ্রীলঙ্কা ঘুরে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য মালদ্বীপ। মালদ্বীপের জন্য বরাদ্দ পাচ দিন। আমি প্রাইভেট আইল্যান্ড চয়েজ করেনি এর পিছনে আমার যুক্তি, যেহেতু আমি ঘুরতে পছন্দ করি তাই এখানে একরাতে এক লাখ টাকা খরচ না করে, পারলে এই টাকা দিয়ে পরে আর একটা ট্যুর দিবো,ওয়াটার বাংলোর আনন্দের চেয়ে আমি ওই টাকাটা দিয়ে আর একটা প্লেসে ঘুরাটাকে বেশি প্রাধান্য দেই। যাইহোক প্রথম রাত এয়ারপোর্ট দ্বীপ হুল্লুমালে আর পরবর্তী চার রাত লোকাল আইল্যান্ড মাফুশি তে থাকার প্ল্যান আমাদের। মাফুশি লোকাল আইল্যান্ড গুলির মধ্যে বেশ জমজমাট তাই এটাকেই আমরা বেছে নিয়েছি থাকার জন্য আর এখান থেকে বিভিন্ন ট্যুর, এক্টিভিটিজও বেশ কমে করা যায়।

যেহেতু মালদ্বীপ আমাদের সবার ঘুরতে যাওয়ার বাকেট লিস্টের খুব জনপ্রিয় একটি নাম তাই আমি আমার পাচ দিনের ঘুরার বর্ননা খরচ সহ তুলে ধরছি।

প্রথম দিনঃ শ্রীলঙ্কা থেকে আমাদের ফ্লাইট ছিল দুপুর দেড়টায়, তিন টা নাগাদ মালদ্বীপে চলে এলাম। হোটেলের ফ্রি এয়ারপোর্ট পিক আপ ছিলো। আগেই মেইলে বলে দিয়েছিল এয়ারপোর্টে এসে ইনফরমেশন ডেস্ক থেকে ফোন করতে, সেই অনুযায়ী ফোন করার দশ মিনিটের মধ্যে হোটেলের নামের প্ল্যাকার্ড নিয়ে একজন আমাদের পিক করলো। যেতে দশ মিনিটের মতো লাগলো হুল্লুমালে হোটেলে। বিকালে আশেপাশে হেটে ঘুরে দেখলাম আর রাতে হোটেলের রেস্টুরেন্ট থেকে ডিনার সেরে নিলাম।

খরচঃ হোটেল রুম ভাড়া একরাতে ৮৫ ডলার। হোটেল ছিল রেভতি বিচ হোটেল।
ডিনারঃ ১৫ ডলার
মোটঃ ১০০ ডলার।

দ্বিতীয় দিনঃ সকালে হোটেলের নাস্তা সেরে সমুদ্র পাড়ে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে রুমে চলে আসলাম,মালদ্বীপে এই সময় বেশ গরম। রিসেপশন থেকে বললো ব্রিজের উপর দিয়ে তোমরা যদি মাফুশি ঘাটে সরাসরি যেতে চাও তবে এখান থেকে থেকে গাড়ি নিতে পারো,১০ ডলার পরবে।আমরা ভেবে দেখলাম খারাপ না,কারন অন্য পথ হলো হোটেল থেকে গাড়ি করে হুল্লুমালে ঘাটে যেয়ে ফেরি নিয়ে মালে,এরপর মালে ঘাট থেকে ৩০ রুফিয়া দিয়ে মাফুশি ঘাটে।ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে এই গরমের মধ্যে আমরা তাই গাড়ির কথা বলে দিলাম হোটেলে। বার টায় চেক আউট করে পাশের রেস্টুরেন্ট থেকে লাঞ্চ সেরে একটায় গাড়িতে করে মাফুশি ঘাটে। লোকাল ফেরিতে টিকেট কাটলাম ৬৬ রুফিয়া দিয়ে তিনজনের।আড়াই টার ফেরি ছিল।সময়মতো ফেরি ছেড়ে মাঝে গুল্লি আইল্যান্ডে থেমে পোনে দুই ঘন্টায় মাফুশিতে। সেখান থেকে হোটেলের লোক পিক করে নিয়ে গিয়েছে।বিকালে বাহিরে হেটে ঘুরে দেখে নিলাম আশেপাশ টা।রাতে হোটেলে বাফেট ডিনারের ব্যাবস্থা ছিলো, সেখানেই ডিনার করে নিয়েছি।

দ্বিতীয় দিনের খরচঃ হুল্লুমালে হোটেল থেকে মাফুশি ঘাটঃ ১০ ডলার
মালে থেকে মাফুশি লোকাল ফেরিঃ ৪ ডলারের কিছু বেশি।
হোটেল ভাড়া চার রাতেরঃ ৩০০ ডলার। হোটেল ছিল সানরাইজ বিচ হোটেল।
লাঞ্চঃ ১৫ ডলার
ডিনারঃ বাফেট পার পারসন ১০ ডলার করে দুইজনের ২০ ডলার।
মোটঃ ৩৬০

তৃতীয় দিনঃ আজকে আমাদের মাফুশিতে ঘুরেফিরে বেড়ানোর প্ল্যান। সকালে হোটেলে নাস্তা সেরে চারপাশে একটু ঘুরে বিকিনি বিচে যেয়ে বসে সময় কাটালাম,আমার কাছে বিকিনি বিচের বিচ টা বেশ ভাল লেগেছে, জমজমাট। আমি একটা সানবেড ভাড়া করে বসলাম আর মেয়ে আর মেয়ের বাবা বিচে সাতার কেটেছে অনেক সময়,বিচ টা সাতার করার জন্য পারফেক্ট। দুপুরে রুমে চলে আসলাম কারন বাহিরে তপ্ত গরম আর আসার সময় একটা পিজা নিয়ে আসলাম লাঞ্চের জন্য। বিকালে মেয়ে আর মেয়ের বাবা নাইট ফিশিং য়ে গিয়েছে এরিনা হোটেল থেকে প্যাকেজে। রাত সাড়ে আট টা নাগাদ ওরা ফিরে আসে। ফিশিং প্যাকেজ রাতের ডিনার সহ মানে যে মাছ ধরা হবে সেই মাছ বারবিকিউ করে দিবে সাথে ভাত সালাদ।খুব সুন্দর পরিবেশে এরিনা হোটেলের সমুদ্র পাড়ে ডিনার করে নিলাম আমরা দুইজন, মেয়ে যায়নি মন খারাপ করে কারন সে একটাও মাছ ধরতে পারেনি বলে।

তৃতীয় দিনের খরচঃ
সানবেড ভাড়াঃ বিকিনি বিচে ৫ ডলার সারাদিনের জন্য
লাঞ্চঃ ১২ ডলার,পিজা আর ড্রিংকস।
নাইট ফিশিংঃ একজনের ২৫ ডলার করে দুইজনের ৪০ ডলার ডিনার সহ।(আমার মেয়ের ১৫ ডলার নিয়েছে)
মোটঃ ৫৭ ডলার

চতুর্থ দিনঃ আজকে আমরা প্রাইভেট রিসোর্টে ডে ভিজিটে যাবো,আগের দিনই আই কম থেকে প্যাকেজে বুকিং দিয়েছিলাম।সকাল সাড়ে আটটায় স্পিডবোট আমাদের নিয়ে রিসোর্টে পৌঁছে দেয় আর বিকাল পাচটায় পিক করবে বলে যায়।প্যাকেজে আছে সকালের স্ন্যাকস, বাফেট লাঞ্চ,বিকালের স্ন্যাকস, সারাদিন হার্ড ড্রিংকস, জুস,স্ফট ড্রিংকস, তোয়ালে,সানবেড। প্রাইভেট আইল্যান্ডে থাকতে না পারলেও এইখানে ডে ভিজিটে এসে কিছুটা হলেও দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে। লোকাল আইল্যান্ডে থাকলে অবশ্যই প্রাইভেট আইল্যান্ডে একদিন ডে ভিজিটে আশা উচিত,এতে মালদ্বীপের ওয়াটার বাংলো ও দেখা হয় আর তোলা যায় অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি।একটু খরচ বেশি কিন্তু ষোল আনা উসুল আর সারাদিন এতো খাবেন যে রাতে আপনার ডিনারের খরচ ও বেচে যাবে।

চতুর্থ দিনের খরচঃ পার পারসন রিসোর্ট ডে ভিজিট ১১০ করে তিন জনের ২৭৫ ( আমার মেয়ের হাফ)
মোটঃ ২৭৫ ডলার।

পঞ্চম দিনঃ এই দিন আমরা স্নোকলিং ট্যুরে যাবো,আই কম থেকে আগের দিন রাতেই বুকিং দিয়েছিলাম। সকালে নাস্তা সেরে সকাল সাড়ে দশটায় স্পিডবোটে করে নিয়ে যায় দুই পয়েন্টে স্নোকলিং করিয়ে স্যান্ড ব্যানকে নিয়ে যায়,সেখানে লাইট লাঞ্চ দেয় এরপর এখানে কিছু সময় ছবি তোলার পর দেখাতে নিয়ে যায় ডলফিন, ( ডলফিন দেখা ৫০/৫০ সম্ভাবনা) এরপর সাড়ে তিন টা নাগাদ ফিরে আসা। ওরা লাইফজ্যাকেট, স্নোকলিং গিয়ার আর পানির নিচের ছবি আর ভিডিও করে দেয়। রাতে আমরা এরিনা হোটেলের বাফেট ডিনার করেছিলাম।

পঞ্চম দিনের খরচঃ
স্নোকলিং প্যাকেজ পার পারসন ২৫ ডলার করে আমাদের তিন জনের ৬৩ ডলার ( আমার মেয়ের হাফ)
ডিনারঃ বাফেট পার পারসন ১২ ডলার করে তিনজনের ৩০ ডলার।
কিছু সুভিনিউর শপিংঃ ৪০ ডলারের মতো
মোটঃ ১৩৩ ডলার

ষষ্ঠ দিনঃ আমাদের ফিরার ফ্লাইট দুপুর তিনটায়।লোকাল ফেরি সকাল সাড়ে সাতটায় তাই আমরা ফেরির বদলে স্পিডবোটে যাবো বলে ঠিক করলাম,কানি স্পিডবোট থেকে পার পারসন ১৫ ডলার করে তিনজনের ৪০ ডলার। স্পিডবোট মালে ঘাটে লোক নামিয়ে আমাদের এয়ারপোর্ট ঘাটে নামিয়ে দিলো,ফেরিতে সময় লাগে ৪০ মিনিটের মতো।

ষষ্ঠ দিনের খরচঃ ৪৫ ডলার, ভাড়া আর টিপস।

পাচ দিনে তিন টা এক্টিভিটিজ প্যাকেজ আর টুকটাক শপিং সহ তিনজনের এয়ার টিকেট ছাড়া মোট খরচ ৯৭৫ ডলারের মতো।

কিছু অন্যান্য ইনফরমেশনঃ

টিকেটঃ আমি সৌদি থেকে ফ্লাই করেছি তাই দেশ থেকে কেমন দাম হবে পারফেক্ট আইডিয়া দিতে পারবো না তবে ৪০০০০ হাজারের মতো লাগে।

ভিসাঃ ভিসা অন এরাইভাল, আমাদের কিছু জিজ্ঞাসা করে নি,টুপটাপ সিল দিয়ে দিয়েছে। তবে সেফ সাইডে টিকেটের কপি আর হোটেল বুকিং এর পেপার সাথে রাখতে পারেন।

হোটেলঃ মালদ্বীপের হোটেল একটু দামী, আমি মাফুশি তে বিচ ভিউ ট্রিপল রুম পার নাইট ৭৫ ডলার করে পেয়েছিলাম নাস্তা সহ বুকিং দিয়েছি দুই মাস আগে বুকিং ডট কম থেকে। তবে বিচ ভিউ ছাড়া হোটেল হলে আরও কমে রুম পাওয়া যায়। আর এখানে সব কিছুতে ট্যাক্স অনেক বেশি।

ট্রান্সপোর্টঃ আমি যাওয়ার সময় লোকাল ফেরিতে গিয়েছি,পার পারসন ২২ রুফিয়া করে দুপুর আড়াই টায় ছেড়ে যায় শুক্রবার ছাড়া সব দিন।আর স্পিডবোট আছে সব দিন। সারাদিন একাধিক টাইমে ছেড়ে যায় এয়ারপোর্ট আর মালে ঘাট থেকে। পার পারসন ১৫ /২০ ডলার। আই কম, এরিনা,কানি বিভিন্ন স্পিডবোট সার্ভিস আছে,যেতে হলে আগে থেকে মেইল করে বুকিন দিতে হবে আর আসার সময় মাফুশি থেকে আগের দিন বুকিং দিলেই হয়।

কারেন্সিঃ এখানে ১ ডলারে ১৫ রুফিয়ার কিছু বেশি দেয় তবে সব জায়গায় বিল ডলার আর রুফিয়ায় দেয়া যায় তাই ১০০ ডলার ভাংগিয়ে নিলেই হয় আর বাকি সব কিছু ডলারেই পে করলে হয়।আপনার যদি ক্রেডিট কার্ড থাকে সেটা দিয়েও পে করা যায়।

কেনাকাটাঃ মাফুশি তে বেশ অনেক গুলি সুভ্যিনিয়র শপ আছে, টুকটাক গিফট দেয়ার জন্য আর নিজের কালেকশানে রাখার জন্য চাবির রিং,ম্যাগনেট এই টাইপের ছোট ছোট জিনিস ৩ ডলার থেকে ১০ ডলারের মধ্যে কিনতে পারবেন।

এক্টিভিটিজঃ মাফুশিতে বেশ কয়েকটি ট্যুর কোম্পানি আছে, আমরা আই কম থেকে গিয়েছি আর ফিশিং ট্রিপটি আমাদের হোটেলের ট্যুর ডেস্ক থেকে নিয়েছি। সব ট্যুর কোম্পানির প্যাকেজের দাম একই তাই দুই একটায় কথা বলে যেটা ভালো লাগে সেখান থেকে টুরে গেলেই হয়।স্কুবা ড্রাইভিং যদি কেউ করতে চান তার জন্য গুনতে হবে ১০০/১২০ ডলার পার পারসন।

আমি মালদ্বীপের চেয়ে সুন্দর প্রকৃতির রুপ দেখেছি কিন্তু কখনো তার সৌন্দর্য ক্যামেরায় ধরে আনতে পারি নি, এমনকি আমি একসাথে যেহেতু শ্রীলঙ্কা আর মালদ্বীপ ঘুরলাম,ভাল লেগেছে কিন্তু শ্রীলঙ্কা ঘুরে কিন্তু মালদ্বীপের মতো এতো ফটোজনিক জায়গা আসলেই খুব কম আছে,ক্যামেরাতে যেন এর রুপ দ্বিগুণ হয়ে ধরা দেয়।

আমরা যেখানেই ঘুরতে যাই না কেনো, আমাদের হ্যান্ড ব্যাগ বা ট্রাভেল ব্যাগে একটা এক্সটা ব্যাগ রাখি যেখানে নিজেদের খাবারের উদ্ধৃত গুলি জমিয়ে রাখি,পড়ে ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট স্থানে ব্যাগটা ফেলে দেই। ঘুরতে গেলে অবশ্যই যেখানে সেখানে ময়লা না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানেই ময়লা ফেলুন।

Source: Nitu Zaman‎ <Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment