মিশন চন্দ্রনাথ মন্দির

অনেক দিন ধরেই চন্দ্রনাথ মন্দিরে যাই যাই করেও যাওয়া হচ্ছিল না। সেই সুযোগ আসল ১৪ তারিখ। ইন্ডিয়ান ভিসার ফাইল জমা দিতে চট্টগ্রাম গেলাম। প্ল্যান ছিল ফাইল জমা দিয়া পাহাড়ে উঠব। কিন্তু ফাইল জমা দিতেই ৪ ঘণ্টা লেগে যায়। ফলে সেদিনের প্ল্যানটা মাঠে মারা যায়। কাল গেলাম পাসপোর্ট আনতে। যেহেতু বিকাল ৫টায় পাসপোর্ট ডেলিভারি দেয় তাই আগেই পাহাড়ে গেলাম। খুবই সহজ একটা রিজ লাইন। কিন্তু এ সহজ ট্রেইলটা যে আমার জন্য কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠছিল তা শুধু আমি জানি। স্ট্যামিনার চূড়ান্ত পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। তবে শুনুন সে কাহিনী।
পাহাড়ে উঠার আনন্দে শুরু থেকেই বেশ উৎফুল্ল ছিলাম। কুমিল্লা থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার ট্রাভেল করে সীতাকুণ্ড নামলাম। সেখান থেকে সিএনজি দিয়ে একবারে পাহাড়ের পাদদেশে। ট্রেকিং শুরু করলাম একবারে কাটায় সাড়ে ১২টায়। প্রথমে চওড়া রাস্তা। ৫ মিনিট পরেই শুরু হল খাড়া সিঁড়ি। মাত্র ৫০টার মত সিঁড়ি পার হতেই শরীর কেমন যেন করে উঠল। মনে হচ্ছে মাথা ঘুরিয়ে পরে যাব। ঘাড়, কাঁধে ব্যথা শুরু হল। আমার স্ট্যামিনা তো এত কম না যে মাত্র ৫০ এর মত সিঁড়িতেই কাত হয়ে যাব। মনে খটকা লাগল তবে কী মাউন্টেইন সিকনেসে ধরেছে? পরে বুঝেছিলাম প্রায় ১৫০ কিলোমিটার জার্নি করে বিশ্রাম না করা, সকালে দুটো পরোটা খাওয়ার পর আর কিছু না খাওয়া, দুপরের তপ্ত রোদের কারণেই এমন হইছে। একটু পরেই দেখলাম একটা দোকান। টালমাটাল শরীর নিয়া কোন মতে দোকানটায় বসলাম। পানি কিনে খেলাম। অবশিষ্ট পানিটুকু সাথে নিয়ে নিলাম।

আবার হাটা শুরু করলাম। কিন্তু একটু পরেই মনে হল মাথা ঘুরিয়ে পরে যাব। শরীর কুলাচ্ছে না। পা চলতেই চায় না। তারপরও একজনকে জিজ্ঞেস করে বাঁয়ের পথ ধরে উঠতে লাগলাম। কিন্তু কোনমতে রোদ পার হয়েই ধপাস করে সিঁড়িতে বসে পরলাম। গরুর মত নিঃশ্বাস ফেলছি। একঢোক পানি খেলাম। কিছুক্ষণ জিরিয়ে আবার হাটা ধরলাম। কিন্তু বেশি আগাতে পারলাম না। ১০০ হাতের মত গিয়ে আবারও বসে গেলাম। শরীরে এক ফোটা শক্তিও অবশিষ্ট নাই। পা যেন অবশ। মনে হচ্ছে মারাই পরব। শরীর থেকে দরদর করে ঘাম ঝরছে। ফিরে আসব কিনা চিন্তা করছি। কিন্তু ফিরে আসার শক্তিও যে অবশিষ্ট নাই। সেখান থেকে স্পষ্টই চুড়াটা দেখা যাচ্ছে। সেটা তো অনেক দূরে। এখানেই এই অবস্থা তাইলে বাকি পথ যাব কিভাবে। ৫ মিনিট পর আবারও মনের শক্তির জোরেই হাটা শুরু করলাম। একটু এগিয়ে পা আর চলতে চায় না। চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। মনে হচ্ছে এখনই অজ্ঞান হয়ে যাব। এবার আর বসেও থাকতে পারলাম না। ঘাসের উপরেই শুয়ে পরলাম। আর সাথে থাকা সামান্য পানি যে উপকার করেছিল কল্পনার বাইরে। শুয়ে শুয়ে চুড়াটার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম আমাকে সেখানে যেতেই হবে। আমাকে পারতেই হবে। এত সহজে হাল ছেড়ে দিলে হবে না।

শরীর তখন ধুলাবালিতে একাকার। এই অবস্থায় পানি খেয়ে মনের জোরেই আবার উঠে দাঁড়ালাম। এইবার সিঁড়ি কম। তাই বেশ খানিকটা যেতে পারলাম। শরীর যখন আর কুলচ্ছিল না তখন আবার বসে পরলাম। প্রতিবার জিরানোর সময় ২/১ ঢোকের বেশি পানি খাই না। চুড়াটা দেখে আন্দাজ করতে পারছিলাম সেখানে যেতে আমাকে আরও কতবার জিরাতে হবে। যে পানি আছে সেটা দিয়ে চুড়ার কাছাকাছিও যেতে পারব না। তখন খুব হতাশা লাগল। এরপর আরও একবার ঘাসের উপর শুয়ে, ২ বার জিরিয়ে একটা মন্দিরের কাছে গিয়ে পৌঁছলাম। গিয়ে দেখি একজন মহিলা এনার্জি ড্রিংক বিক্রি করছে। আর পায় কে। স্পিড কিনে গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম। আমি এতই দুর্বল ছিলাম যে স্পিডের ছিপিটাও খুলতে পারছিলাম না। দোকানি মহিলা খুলে দেয়। স্পিড খেয়ে সেখানে ২০ মিনিটের মত বিশ্রাম নিয়ে শরীর চাঙ্গা করি। এই প্রথম ২৫ টাকার জিনিষ ৫০ টাকায় কিনতেও কষ্ট হচ্ছিল না। আমি থাকতেই সেখানে আরও ২টা ছেলে আসে।

পরে ৩ জন একসাথে চুড়ায় রওনা দেই। পথে ২ বার জিরিয়ে ১৫ মিনিটের মাঝেই চুড়ায় উঠে যাই। চুড়ায় উঠেই চারদিকের পরিবেশ দেখেই সব কষ্ট সার্থক মনে হয়। এমন পরিবেশের জন্য আবারও এরচেয়ে দুর্বল শরীর নিয়াও উঠতে চাই। চুড়ায় প্রায় আধা ঘণ্টা প্রকৃতি উপভোগ করে ডানের সিঁড়ির পথ দিয়ে নেমে আসি। সীতাকুণ্ড আসতে আসতে সাড়ে ৩টা বেজে যায়। খাওয়ার সময় নাই। কারণ ৪ঃ৩০ এর আগে এম্বাসিতে যাইতে হবে। না খেয়েই রওনা দিলাম। ৪ঃ৪০ এ পৌঁছলাম এম্বাসিতে। গিয়া দেখি বিশাল লাইন। ৫ঃ১৫ এর দিকে ভিসা নিয়া চলে আসি কুমিল্লা।
.
টিপস:
*আই রিপিট এইটা খুবই সহজ ট্রেইল। উঠতে তেমন সমস্যা হয় না। শুধু আপনার শরীরে এনার্জি থাকলেই হবে। বিপজ্জনক ট্রেইল সেগুলাই যেগুলাতে শরীরে এনার্জি থাকা স্বত্তেও পথের দুর্গমতার কারণে হাটা দুষ্কর হয়ে পরে।
*শরীরের এনার্জি ঠিক রাখতে অবশ্যই সাথে বেশি করে পানি নিবেন। এ ছাড়া সফট ড্রিংকস, খাবার স্যালাইন, কেক, চকলেট রাখবেন। পথে জিরাতে জিরাতে এসব খাবেন। তাইলে তেমন কষ্ট লাগবে না।
*পাহাড় ট্রেকিং শুরু করার আগে পারলে ৩০ মিনিট বিশ্রাম নিবেন। দীর্ঘ জার্নির ফলে বিশ্রাম না নিলে ফুসফুসে প্রভাব পরে। আমার ক্ষেত্রে সেটাই হইছিল।
*উঠার জন্য দুইটা পথ আছে। যে পথেই যান না কেন সিঁড়ি অলমোস্ট সমান। সো দুই পথেই প্রচুর সিঁড়ি ডিঙ্গাতে হবে।
*ইকো পার্কের দিক দিয়া নামবেন না। ঐখানে কাউকে পেলেই সন্ত্রাসীরা এটাক করে।
কিভাবে যাবেনঃ ঢাকা-সীতাকুণ্ড-চন্দ্রনাথ মন্দির

Post Copied From:Masud Sarker Rana‎>Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment