যে শরতের দেখা পেয়েছি গোমুখে গিয়ে

ছোট্ট এই জীবনে যতটা না সমুদ্র দেখেছি, তার চেয়ে অনেক বেশী পাহাড় দেখা হয়েছে। অনেক অনেক বার পাহাড়ে গিয়েছি, ভিন্ন ভিন্ন লোকেশনে। আমাদের বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি। এছাড়া সান্দাকুফু, সিমলা, মানালি, কাশ্মীর, লেহ-লাদাখ আর মুন্নারের নানা যায়গার, নানা রকম পাহাড় দেখেছি। এবং প্রায় প্রতিবারই কোন না কোন শরতে পাহাড়ে যাওয়া হয়েছে।

কিন্তু এবার শরতে গিয়েছিলাম গোমুখ। আর এবার পাহাড়ে গিয়ে যে শরতের দেখা পেয়েছি, তেমন শরত এই জীবনে আমি কোনদিন দেখিনি। যে শরতের পাহাড়ের রূপ, আকাশের সাঁজ, নদীর উচ্ছলতা, বাতাসের চঞ্চলতা, মেঘেদের রঙ বদলের খেলা, সাদা পাহাড়ের নানা রকম রূপের খেলা আগে কোনদিন, কোন পাহাড়ে দেখিনি।

আর শরতের এমন অপরূপ রূপ শুরু হল ঠিক গাঙ্গত্রী থেকে দেড় থেকে দুই কিলোমিটার ট্রেক করে চেক পয়েন্টের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে পথ চলতে শুরু করতেই। তখন ভোঁর কেটে গিয়ে সকালের সবে শুরু হয়েছে। ঝরঝরে রোদের আলোয় চারপাশ ঝলমল করে উঠছে। সূর্যের আলোর উষ্ণতা পেয়ে আকাশে জড়িয়ে থাকা মেঘ-কুয়াসা কেটে গেল নিমিষেই। ঝলমলে নীলে ছেয়ে গেছে পুরো পৃথিবীর বিশাল আকাশ।

রোদের আলো পরে গাছে গাছে সদ্য গজানো সবুজ পাতার ডগা গুলোয় যেন হলুদের রঙ লেগেছে। পাশে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ জলে ঝিকঝিকে রুপালী ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে অনবরত। আর মাঝে মাঝে দূর আকাশের মাথায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল বরফ জড়ানো তুষার পাহাড়ের স্বর্ণালী, রুপালী আর নানা রকম বর্ণীল রূপ।

এসব দেখে দেখে মনে হচ্ছিল না হেটে, ব্যাগটাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে রেখে ঠায় বসে থাকি কিছুক্ষণ। না হয় কোন পাহাড়ের সাথে ঝুলে থাকা পাথরের উপরে নিজেও ঝুলে থাকি। শীত সকালের রোদ গায়ে মাখি, ঝিরঝিরে বাতাসে ভেসে বেড়াই, নীল আকাশের মাঝে মাঝে জমে থাকা নরম কোমল মেঘেদের সাথে উড়ে উড়ে যাই, এক পাহাড় থেকে আর পাহাড়ের কোলে। অথবা পাহাড়ের ঝুরো পাথরে গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে যাই অনন্ত যৌবনা গঙ্গার তীরে। আর না হয় অলস অবসরে শুয়ে থাকি কোন এক কাঠের সিঁড়ি দিয়ে বানানো ঝুলন্ত সেতুতে।

অবশ্য কোন কিছুই তেমন করার মত ছিলোনা বাস্তবে। পুরোটাই একা একা পথ চলায় নিজের মত করে রঙিন কল্পনা মাত্র। একা, একা বলছি এই কারনে যে, আমার সাথে কোলকাতার যে দুজন বন্ধু ছিল তারা এতোই ধীর লয়ে হাঁটছিল যে আমি সেটা মানিয়ে নিতে না পেরে ওনাদেরকে বলে নিজের মত পথ চলতে শুরু করেছিলাম। যেখানে গিয়ে থামতে ইচ্ছা করে সেখানে থেমে যেতাম আর ওনারা না এসে পৌছা পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম। ওনারা আমার বিশ্রামের যায়গায় এসে বিশ্রাম নিতে শুরু করাতে আমি আবার নিজের সাথে কথা বলতে বলতে, ছবি তুলতে, তুলতে, পাহাড়, নদী, গাছপালা, আকাশ, মেঘ, তুষার জড়ানো চূড়া দেখতে দেখতে সামনের দিকে এগোতে থাকতাম।

তবে কোথাও নিজের কল্পনার সাথে নিজেকে সংযুক্ত করতে না পারার একটা আক্ষেপ তৈরি হয়েছিল যেন। না পারছি কোথাও ঠায় বসে থাকতে, না পারছিলাম পাহাড় থেকে পাহাড়ে উড়ে যেতে, না সম্ভব ছিল উড়ে যাওয়া মেঘেদের সাথে ভেসে বেড়ানো, বা বাতাসের সাথে উড়ে উড়ে হারিয়ে যাওয়া অথবা পাহাড়ি ঝুরো পাথরে গড়িয়ে গড়িয়ে গঙ্গার তীরে গিয়ে আকাশের নীলের দিকে তাকিয়ে অনন্ত অবসরে শুয়ে থাকা।

কিন্তু কেন আর কিভাবে যেন বিধাতা আমার অন্যান্য সকল চাওয়ার মত করেই এইসব চাওয়ার মধ্যেই একটা ঠিক ঠিক পূরণ করে দিলেন! যা ছিল সেই পার্থিবতায় আমার কাছে অপার্থিব প্রাপ্তি, আর ওপার সুখের মত কিছু সময়, মুহূর্ত আর কাল।

না, আমি পাহাড় থেকে লাভ দেইনি, মেঘেদের সাথে ভেসে বেড়াতে পারিনি, বাতাসের সাথে কোথাও উড়ে চলে যাইনি, আকাশে নীলে হারাতে পারিনি আর শ্বেতশুভ্র পাহাড়ের চূড়া ছুতে পারিনি। কিন্তু আমি পেয়েছিলাম, চলতে চলতে নানা রকম স্বপ্ন দেখা শেষ স্বপ্নের দেখা। বাস্তবতায়, আমার হাতের মুঠোয়।

ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি ট্রেইলে একা একা পথ চলতে চলতে, একটা সময় পাহাড়ি ট্রেইল অনেক নিচের দিকে নেমে যেতে শুরু করলো। যেহেতু একটাই পথ, এই পাহাড়ি ট্রেইলে সেহেতু আর অন্য কোনদিকে যাওয়ার সুযোগ নেই বলে আমিও সেই পাহাড়ি ট্রেইলের ঝুরো পাথরের পথে খুব সাবধানে পা ফেলে ফেলে নিচের দিকে নামতে শুরু করলাম।

১০ থেকে ১৫ মিনিট এভাবে এক নাগাড়ে নেমে যেখানে থামলাম, সেটা ঠিক ঠিক যেন আমার কল্পনার রঙের সাথে রাঙানো স্বপ্ন সত্য করে দেয়ার মত যায়গা। একদম হুবহু আমার কল্পনার রঙ দিয়ে আঁকা স্বপ্নের সবটুকু সত্য করে দিয়েছে। পাহাড়ি ট্রেইল ধরে নিচে নেমে যেখানে দাড়িয়েছি সেটা পাথরে পাথরে জড়িয়ে থাকা পাহাড়ের শরীর বেয়ে গঙ্গার একটি ধারার বুকের উপরে দুই পাহাড়ের সাথে সংযোগ করা কাঠের ঝুলন্ত সেতু!

যে সেতুর নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গার ধারার সাথে এসে মিশেছে অন্য পাহাড় থেকে ঝরে পরা, পাহাড়ের শরীর বেয়ে নেমে আসা সেই পাহাড়ের একটি ঝর্ণাধারা। এভাবে পাহাড়ের তলদেশে এসে নদী ও ঝর্ণার মিলনের মুখে ঝুলন্ত কাঠের ছোট্ট সেতু পেয়ে আমি খুশিতে দিশেহারা প্রায়।

কোন কিছু না ভেবেই, স্বপ্নের পুরোটুকু সত্য করতে সেই ঝুলন্ত সিঁড়ির উপরেই শুয়ে পরলাম। আকাশ জোড়া ঝকঝকে নীল আকাশের দিকে কত সময় তাকিয়েছিলাম জানিনা। পাথরের মাঝে মাঝে বাঁধা পেয়ে ছুটে চলা নদীর কলরবে কান পেতে ছিলাম। কখনো কখনো শুনছিলাম পাহাড় থেকে নেমে আশা সুখের ঝর্ণা ধারার গান।

মাঝে মাঝে একটু বেশী বাতাস দোলা দিয়ে যাচ্ছিল ঝুলন্ত কাঠের সেতুকে, যা আরও বেশী রোমাঞ্চিত করে তুলেছিল সেই সময়কে, সুখের সেতুতে দুলে দুলে দোল খাওয়ার মুহূর্ত গুলোকে, আকাশ ভরা এমন নীলের অপরূপ সাঁজের দিকে অপলক তাকিয়ে ছিলাম যতক্ষণ পর্যন্ত না অন্য কোন কেউ বা অন্য কোন ট্রেকার টিম এসে এই পথ পেরিয়ে যেতে না চায় ততক্ষণ। সময় দেখিনি, ঘড়ির দিকে তাকাইনি, উঠে যাওয়ার জন্য উসখুস করিনি।

এমন স্বপ্নিল যায়গায় আবার কবে আসতে পারবো, আদৌ আর পারবো কিনা কে জানে? তাই যখন আমার রেখে আশা কোলকাতার সেই দুই সহযাত্রীরা এখানে এসে পৌঁছেছে তার পরেই আমি আবার সেই সত্য স্বপ্নের পাহাড়ি নদীর উপরের ঝুলন্ত সেতু থেকে উঠে নতুন করে পথ চলতে শুরু করেছিলাম।

আর বিধাতার কাছে জানিয়েছিলাম অসীম কৃতজ্ঞতা, আমার সকালে বোনা স্বপ্ন, একা একা করা বর্ণীল কল্পনাকে এভাবে সত্যি করে, মনভরে উপভোগ করতে দেয়ার জন্য। আমি সত্যি, সত্যি-ই ভীষণ ভাগ্যবান, বিধাতার কাছে যখন যা মন থেকে চেয়েছি বা পেতে আগ্রহী হয়েছি, তিনি আমাকে সব দিয়েছেন, সবই প্রায়।

Share:

Leave a Comment