রাখাইনপাড়া মানিকপুর ভ্রমণ বিতান্ত

এক পশলা বৃষ্টির পর ঝলমলে রৌদ্রজ্জ্বল মাতামুহুরির তীর। নদীর বাঁধানো পাড়ে বসে চারপাশটা দেখতে দেখতে গায়ে এসে লাগে বাতাসের আদ্র শীতল শিহরণ। পড়ন্ত দুপুরে মাতামুহুরীর দু’কূল জুড়ে রঙ আর জৈবিক চাঞ্চল্যের ছড়াছড়ি। নদীর জল সবুজ, দুই কূলের রঙ সবুজ। তাদের সঙ্গ দিতেই যেন নদীর ওপর নেমে এসেছে সাদা পেজা তুলোর মত মেঘদলের সাথে আকাশের অবারিত নীল। একদল ছেলেপুলে নদী পাড়ের গাছতলায় মাটিতে চারকোণা ঘর এঁকে বসে নুড়িপাথর দিয়ে কী যেন খেলছিল। আমাদের দেখে মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ হেসে লুটোপুটি খেল, তারপর একছুটে ঝাপিয়ে পড়ল নদীতে!

ভ্রমণসঙ্গী জুয়েলদের বাড়ি কক্সবাজারের মানিকপুর গ্রামে। চকোরিয়া থেকে পাহাড়ী পথের চড়াই উৎরাই মাড়িয়ে আমাদের বাহন ওদের বাড়িতে নামিয়ে দেয়ার সময় সবে দুপুর গড়িয়েছে। বিশ্রাম আর উদরপূর্তিপর্ব শেষ করে বেরিয়ে পড়ি ওদের গ্রাম দেখতে। একপাশে চুনতি-হারবাং পাহাড়শ্রেণী, আরেক পাশে বহতা মাতামুহুরী নদী রেখে মধ্যিখানে ছবির মত সুন্দর গ্রাম মানিকপুর। নদীতীরের পাশ ধরেই গিয়েছে গ্রামের মেঠোপথ। কয়েক কদম হেঁটে পথের বাঁক পার হওয়ার পর প্রাচীন এক মসজিদ দেখে দাড়িয়ে পড়ি। হারানো দিনের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে থাকা মসজিদটি দৃষ্টিনন্দন এক স্থাপনা। জুয়েল বলল, এই মসজিদের নাম- তিন গম্বুজ মসজিদ। তিনটি গম্বুজের পাশাপাশি আছে বারোটি মিনার বা খিলান।

১৮৯০ সালে ব্রিটিশ শাসনামলের সময় ফজল কিউক নামে স্থানীয় এক সমাজহিতৈষী ব্যক্তি মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। মসজিদটির নিমার্ণশৈলী মোঘল স্থাপত্য ধাচের বলে অনেকে ‘মোঘল মসজিদ’ নামেও চেনে। মসজিদের একটু পরই পড়ল গ্রামের হাট। বাঁশবন আর নদীতীরের মাঝে ছোট ছোট কিছু দোকানপাট। রাখাইন সম্প্রদায়ের পাড়া বা বসতি শুরু হয়েছে হাটের পরপরই। রাখাইনপাড়ায় পা দিয়েই যেন বদলে গেল দুইপাশের পুরো ছবি। পথের পাশ ছুঁয়ে রাখাইনদের বাড়িঘর। মাচার ওপর কুটিরগুলোর প্রায় পুরোটা জুড়েই কাঠের আচ্ছাদন। কুচকুচে কালো রংয়ের কাঠ। বাড়ির উঠোন, পাড়ার পথ জুড়ে রাখাইন জনগোষ্টীর সব বয়সীদের সরব পদচারণা। পথের ধূলো উড়িয়ে শৈশবের দুরন্তপনায় খেলছে শিশুরা। কেউ বা সাইকেল চালাচ্ছে।

কাঠের গুড়ির শক্ত ভিতের ওপর দাড়ানো খোলা মাচার ওপর স্কুলের বই মেলে বসেছে দুই রাখাইন কিশোরী। পাড়ার ঘরবাড়ি ছেড়ে এসে সামনে পড়ল নারকেল বাগান। গাছতলায় স্তুপ করে রাখা ডাব পাহারা দিচ্ছে একটি শিশু। নারকেল বাগানের রাস্তার ওপরপাশে খোলা জমি শুরু হয়ে গিয়ে থেমেছে দূরের পাহাড় সারির পাদদেশে। শুকনো মৌসুমে এখানে বানিজ্যিকভাবে ফুল আর তামাকের চাষ হয়। তারপর আবারও শুরু হয়েছে পাড়ার ঘরবাড়ি। উঠোন লাগোয়া মাচাঘরের নিচতলায় বেত বাঁশ দিয়ে ফার্ণিচার তৈরীতে ব্যস্ত ছিল এক রাখাইন। বাড়ির কর্তা তূর্যদা জুয়েলের পূর্ব পরিচিত। হাসিমুখে আমাদের চেয়ার এগিয়ে দিলেন। ফালি করা বেতের টুকরো আর হাতের নানা কারিকুরি দেখে সেখান থেকে ফিরে হেঁটে হেঁটে চলে আসি পাড়ার প্রান্তসীমায়। মাথামুহুরী নদী এখানে অনেকটা ইংরেজি ‘ভি’ বর্ণের মত কোণ তৈরী করে দুইপাশে চলে গেছে।

আমরা দাড়িয়ে আছে কোণের দুইবাহুর ভেতর। নদীর ওপর পাড়ে পানির কিনারা ছুঁড়ে পাহাড় ওঠে গেছে পাথরের খাড়া দেয়াল নিয়ে। এইপাড়ে বালুচর। চরের বালুতে লতানো ঝোপের বুনোকলমী আর নলখাগড়ার ঝোপ। রাখাইন আর বাঙ্গালী মিলেমিশে একদল কিশোর চরে ফুটবল নিয়ে মেতেছে। পরের গন্তব্য রাখাইনপাড়ার পাশের এক লিচু বাগান। অনেক আগে সেই শাবানা ববিতার যুগে এখানে নাকি কোনো এক ছায়াছবির শুটিং হয়েছিল। লিচু বাগানটির তাই বেশ নামডাক। থরেথরে সাজানো লিচুগাছের সারি। বাগানের ভেতরে লম্বা ঘাসের ফাঁকে পিচ্ছিল পথে পা ফেলতে হল সাবধানে। লিচু পাতার ঘন বুনটের ভেতর চোখে পড়ে পাখির বাসা। বাগানের পাশে নদীর পার ধরে দাড়িয়ে আছে সুপারী গাছের সারি। চরের বালুতে পড়েছে তাদের লম্বাটে ছায়া। নদীর পাড়ে জমেছে থকথকে পলিমাটির স্তর। বার্মা সীমান্তের ক্রাউডং বা মাইভার পর্বতে জন্ম মাতামুহুরীর।

তারপর বান্দরবানের সাঙ্গু মাতামুহুরী সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতর হয়ে প্রবাহিত হয়েছে সর্পিল এই নদী। প্রবাহপথে বিস্তীর্ণ পাহাড় অরণ্য থেকে নিয়ে আসছে এই পলি। নদী পেরিয়ে ওইপাশে বেশ উঁচু এক পাহাড় চূড়া। খন্ড খন্ড মেঘেদের দল যেন চূড়ার বনানীর ওপর জেঁকে বসে আছে! লিচু বাগানের পর চোখে পড়ে আবারও পাড়ার ঘরবাড়ি। রাখাইনপাড়ার শেষপ্রান্ত। পাড়ার এই দিকটি বেশ নিরিবিলি। তকতকে পরিচ্ছন্ন উঠোনের পাশ জুড়ে কাঠের সব কুটির। প্রবীণ এক রাখাইন মহিলা পাকা তেঁতুল রোদে শুকাতে দিয়েছেন। তার কাছে গেলে হাসিমুখে একছড়া তেঁতুল হাতে তুলে দেন। হাসিমুখে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ঘুরেফিরে চলে আসি পাড়ার শেষ মাথায়। মাচাঘরের বারান্দায় বসে খেলাধূলার ফাঁকে আমাদের দিকে তাকিয়ে একদল রাখাইন শিশু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বিড়বিড় করে কী যেন বলছে আর হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে! রাখাইনপাড়ার পর উঁচু পাহাড়ের পাদদেশ থেকে চূড়ার ওপর ওঠে গেছে পাকা সিঁড়ি। ধাপে ধাপে ওঠে যাওয়া সিঁড়ি বেয়ে ওঠে গেলাম চূড়ায়। বৌদ্ধ বিহার বা কেয়াং দাড়িয়ে আছে পাহাড়ের ওপর। রাখাইন ঐতিহ্যের শৈলীতে গড়ে ওঠা কেয়াং বানানো হয়েছে কালো কাঠ দিয়ে। কেয়াংয়ের উঠোনে দেখা হয়ে গেল একজন ভিক্ষুর সাথে। সেখান থেকে খানিক দূরে উঠোনের শেষ মাথায় পাহাড়ের ঢালের ওপর সিংহদ্বারবিশিষ্ট জাদি বা প্যাগোডা। প্রবেশ পথের দুইদ্বারে সোনালী রংয়ের একজোড়া সিংহের ভাস্কর্য। জাদির ভেতরে ছোট বড় একজোড়া সূচালো স্তম্ভের রংও সোনালী। পাশেই বসার জন্য বেঞ্চ। জাদির পাশে গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে চোখে পড়ে দূরে অনেক নিচে বন পাহাড়ের মাঝ দিয়ে স্রোতসিনী মাতামুহুরীর বয়ে চলা। কেয়াংয়ের পাহাড় থেকে ফেরার পথে সন্ধ্যা নেমে এলো। আকাশজুড়ে গোধূলী রংয়ের ছড়াছড়ির মাঝে কিচিরমিচির শব্দে আমাদের বিমোহিত করে দূরের পাহাড় সারির দিকে উড়ে গেল একঝাঁক কাঠশালিক।

Source: Shimul Khaled‎ <Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment