রাজা রামপালের পদুম্বা ওরফে পাবনা
পুরো বাংলাদেশ ঘুরে বেড়ানোর ব্রত নিয়েছিলাম বছর চারেক আগে। এরমধ্যে ঘুরে বেড়াতে পেরেছি মোটে ত্রিশ জেলা। গোটা বাংলার অর্ধেকেরও কম। তবে দেড় শতাধিক ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখেছি। অথচ ভ্রমণবিলাস শুরু করার গল্পটাই আমার লেখা হয়নি। পাল নৃপতি রামপালের সময়কার পদুম্বা জনপদে ঘুরে বেড়ানোর গল্পই শোনাবো আজ। ঠিক তিন বছর সাত মাস আগের কথা।
নীল-পিনি দুই বান্ধবীকে জানালাম, চৌদ্দ তারিখ ঢাকায় আসব। ওরা বলল, যেভাবেই হোক তেরো তারিখ যেন আসি। কারণ কী? কারণ হলো চৌদ্দ তারিখ ওদের ভার্সিটি লাইফের শেষ প্রোগ্রাম হবে। আর তাতে আমারো উপস্থিত থাকতে হবে।
আমি সবসময়ই বন্ধু নির্ভর মানুষ। বন্ধুরা কিছু একটা করতে বলবে, আর আমি সেটা করব না- এটা হতেই পারে না। প্রচণ্ড দুর্যোগ মাথায় চেপে চললাম ঢাকায়। পরদিন ওদের ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামেও গেলাম। প্রোগ্রাম থেকে বাসায় ফেরার মিনিটখানেক আগে নীলান্তি আমাকে ডেকে বলল, ‘পাবনা যাবি?’ আমি তো থতমত খেয়ে গেলাম। অন্তত ওইমূহুর্তে তো আমি পাগলাগারদে যাওয়ার মতো কোনো কাজ করিনি। সাদাসিধে ভঙ্গিতে খানিকটা দূরে বসে নোটিফিকেশন চেক করছিলাম। তাহলে কেন আমাকে পাবন দস্যুর আড্ডাস্থলে যেতে বলছে?
আমাকে উদভ্রান্তের মতো তাকাতে দেখে ও বলল, ‘ইমরানের ভাইয়ের বিয়ে কালকে। আমরা সব্বাই নাইটকোচে পাবনা যাচ্ছি। তুইও চল।’
আমি অবিশ্বাসী ভঙ্গীতে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘কী বলিস আবল তাবল? আমি ক্যামনে যাব?’
ও আস্থার হাসি হেসে বলল, ‘কালকেই ফিরব। চল যাই। আমাদের বাংলাদেশ ভ্রমণের প্রথম ধাপ না হয় এই সাডেন ট্যুর দিয়েই হোক?’
কথাটা ম্যাজিকের মতো কাজ করল। আমার বহুদিনের শখ পুরো বাংলাদেশ ঘুরব। কিন্তু পড়াশোনা, আত্মীয়তার সুবাদে ঢাকা-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম ছাড়া আর কোথাওই যেতে পারিনি। ওগুলোও ঘুরে বেড়ানোর উসিলায় হয়নি। বহুবার প্ল্যান প্রোগ্রাম করা হয়েছিল, কিন্তু পরে ভেস্তে গেছে। তাই এবার আর বারণ করলাম না। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মানসিক হসপিটালটা দেখার সুযোগ পেয়ে তা হাতছাড়া করাটা কিছুতেই ঠিক হবে না। সেই সাথে কেন পাবনাতেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মানসিক হসপিটাল বানানো হলো, সেটাও জানা যাবে।
এরপর খুব দ্রুত ঘটনা ঘটতে লাগল। বাসে আমরা ষোলোজন চেপে বসতেই শুরু হলো আমাদের যাত্রা।
প্রথমবারের মতো উত্তরবঙ্গে যাচ্ছি।
প্রথমবারের মতো যমুনাসেতু পার হচ্ছি।
প্রথমবারের মতো পরিবারের অনুমতি ছাড়াই দেশের আরেক মাথায় ছুটছি।
অন্যরকম একটা অনুভূতি। ফিসফিসে গলায় গান গাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়েও গলা চড়ে যাওয়া, বাসের অন্যান্য যাত্রিদের ডিস্টার্ব হওয়ায় কন্ডাক্টরের বকা খাওয়া, দশ সেকেন্ড কাউন্ট করে করে, আবছা আলোয় ইউসুফের দেখানো জায়গাগুলো দেখার চেষ্টা করা, একে অপরকে পচিয়ে গলা ছেড়ে হাসতে হাসতে আমাদের বাস ভ্রমণ শেষ হলো।
বাস থেকে নেমে সিএনজিতে করে ইমরানের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। তখন ভোর হচ্ছে। রাস্তার দুপাশ দেখতে দেখতে যাচ্ছি। বাংলাদেশের আর দশটা গ্রামের মতোই। ব্যতিক্রমী যেটা খুব করে চোখে পড়ল, সেটা হলো একটা সাদা ঘোড়া। ফসলী জমির মাঝখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। বইপত্রে ঘোড়া খুব সাধারণ একটা প্রাণী হলেও ঘোড়ার গাড়ি কিংবা চিড়িয়াখানা ছাড়া হাটে-ঘাটে-মাঠে কখনোও ঘোড়া চোখে পড়েনি। ক্ষেতে খামারেও নয়।
ইমরানদের বাড়ি পাবনার সুজানগর উপজেলায়। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ইমরানদের বাসায় ঢুকলাম। ঝুম বৃষ্টি শুরু হওয়াতে আমাদের ঘুরতে বের হবার সমস্ত প্ল্যান মাঠে মারা গেল। প্রত্যেকবারই বৃষ্টির দুই মিনিটের বিরতিতে বের হবার প্রস্তুতি নিই, আর দুই মিনিট পরই আবার আগের চেয়েও জোরে বৃষ্টি শুরু হয়।
ঝুম বৃষ্টি, টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ, আর রাত জাগা ক্লান্তিতে আমাদের ষোল জনের মধ্যকার এগারো জনেরই উইকেট পড়ে গেল। উইকেট পড়ে যাওয়ার মানে হলো, আমি, নীল, পিনি, জুলহাস আর ইমরান ছাড়া সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমন্তদের নিয়ে কিছুক্ষণ খুব হাসাহাসি করলাম আমরা। ছবি তুললাম। আমি খুব ঘুমকাতুরে হওয়ার পরও ঐ মূহুর্তটায় না ঘুমানোর কারণে সব ধরণের পচানী থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম।
বৃষ্টিবন্দী হয়ে বসে থাকতে থাকতে হাঁফ ধরে গেল আমাদের। টিপির টিপির বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আমরা পাঁচজন বাইরে বেরিয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি পুরো দলই বেরিয়ে এসেছে। তক্ষুনি পাগলাগারদে থুককু, হেমায়েতপুরে যেতে চাইলেও ইমরান বলল, ‘হেমায়েতপুর এখান থেকে বেশ দূরে।’
ওর কথা শুনে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আমাদের পাংশু হয়ে যাওয়া মুখ দেখেই হয়তো ও তাড়াতাড়ি বললো, ‘আমরা যাওয়ার সময় হেমায়েতপুর হয়ে ঢাকায় ফিরলে সুবিধা হবে। তাছাড়া যেকোনো মূহুর্তেই আবার ঝুম বৃষ্টি নেমে যেতে পারে। তারচেয়ে বরং পদ্মার পাড়ে চল। যাবি?’
তাই-ই সই। পাবনায় নাকি রিকশা চলে না। পদ্মার পাড়ে যেতে হলে ভ্যানে করে যেতে হবে। এবার লাফিয়ে উঠলাম। জীবনে একবারই ভ্যানে উঠেছিলাম। আশেপাশের মানুষ আমাকে দেখে হাঁ করে তাকিয়েছিল। অথচ পাবনাতে ভ্যানই হলো যাতায়াতের সবচেয়ে ভালো মাধ্যম! কিছুতেই মিস করা যাবে না।
ভ্যানে যেতে যেতে অনেক অনেক কিছু চোখে পড়ল। রাস্তার দুপাশে অসংখ্য গাছ। সেটা থাকতেই পারে, স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিকতাটা হলো, গ্রীষ্ম পার হয়ে বর্ষা শুরু হয়ে গেলেও, আম-জাম-কাঠালের আধিক্য। প্রতি পাঁচ কদম পরপর কাঁঠাল গাছ, যেটার উপর থেকে নিচ পর্যন্ত কাঁঠাল ধরে আছে। আম গাছে শয়ে শয়ে আম, ছোট বড় সব ধরনের গাছেই। বিশাল আকৃতির জাম গাছের নিচে পাকা জাম বিছিয়ে পড়ে আছে।
যদি এরকম একটা দুইটা গাছ দেখতাম, তাহলে অদ্ভুত লাগত না। কিন্তু পাঁচ কদম পর পর এত ফলবান গাছ দেখে আমাদের সবার চোখ ছানাবড়া। এত ফল, অথচ কেউ খায় না। আর আমাদের এলাকায় হলে এসব ফল কবে চুরি হয়ে যেত। আবার বিশাল বিশাল কৃষ্ণচূড়া ফুল গাছও দেখলাম অনেকগুলো, যেগুলো এখনো ফুলে ছেয়ে আছে। চাঁদপুরের প্রায় সব কৃষ্ণচূড়ার ফুল ঝরে গেছে, অথচ পাবনায় যেন মাত্র নতুন করে ফুটলো। বুঝলাম না, পাবনায় মধুমাস কী দেরী করে আসে?
আরেকটা ব্যাপার দেখলাম, সুজানগরে অনেক স্কুল। নদীর ঘাটে যেতে যেতে আট-দশটার মতো স্কুলই দেখেছি। ওগুলোতে আবার বিশাল বড় বড় খেলার মাঠ আছে। আরো আছে রাজবাড়ির ডিজাইনের অনেকগুলো পুরোনো আমলের বাড়ি।
মোটর বসানো ভ্যানে এক ঘণ্টা চড়ে অবশেষে পদ্মার পাড়ে পৌঁছলাম। চাঁদপুরের যারা এই পোস্ট পড়ছেন, তারা নিশ্চয়ই ভাবছেন, এই মেয়ে পাবনায় গিয়ে সত্যিই পাগল হয়ে গেছে? এক ঘণ্টা জার্নি করে নদী দেখতে এসেছি, এটা শুনে অবাক হওয়াটাই স্বাভাবিক। আরো অবাক করে দিই। সবাই কাছের একটা চরে যেতে চাইলে ইমরান নকা (নৌকা, পাবনায় নৌকাকে নকা ডাকে) ভাড়া করতে গেল। ভাড়া শুনে আমার চোখ উল্টে যায়। দশ মিনিটের নৌপথ নাকি এক হাজার টাকা! আমি, নীল-পিনি হাসব না কাঁদব, বুঝলাম না। এরপর বহুক্ষণ দর কষাকষি করে সেটাকে দুইশতে আনা হলো। আমরা চরে গেলাম।
মনপুরা ছবি যে ধরনের চর দেখিয়েছে, ঠিক সেই ধরনের চর। চাঁদপুরেও এরকম চর আছে। চরে ঘুরলাম, বালিতে পা দিয়ে নিজেদের নাম লিখলাম, অদ্ভুত প্রজাতির পোকা দেখলাম, কাদাবালিতে (আমরা ভেবেছিলাম চোরাবালি) পা ডুবিয়ে জামাকাপড়ের বারোটা বাজালাম, ছবি তুললাম। আধা ঘণ্টা চরে ঘোরাঘুরি করে যখন নকা নিয়ে তীরে পৌঁছলাম, তখন ঘড়িতে সময় মাত্র দশটা পঁচিশ!
বাসায় ফিরে গোসল করে সবাই ঘুম দিল। আমিও কিছুক্ষণ এদিকে সেদিকে ঘোরাঘুরি করে, বিয়েতে যাওয়ার জন্য রেডি হলাম। কিছু করার নেই বলে ওই অবস্থাতেই ঘুমালাম। ঘুম ভাংলো আধা ঘণ্টার মধ্যেই, ঝুম বৃষ্টির শব্দে। তখনো সবাই ঘুমে কাদা। প্রচণ্ড মাথাব্যথার প্রকোপে এক কাপ চায়ের অভাব খুব বেশি বোধ করছিলাম। সেই সকাল থেকেই আমরা চা খেতে চাচ্ছি, কিন্তু কেন যেন চা খাওয়াই হচ্ছে না। কয়েকবার বলেও ফেলেছি, “পাবনায় চা হলো আমাদের জন্য দুস্প্রাপ্য জিনিস”।
হেলাফেলায় কথাটা বললেও এটা যে সত্যি হয়ে যাবে, বুঝিনি। বহু খুঁজে একটা দোকানেই দুধ চা পেলাম। দোকানি চা বানালো অদ্ভুত উপায়ে। হাফ কাপ দুধের সাথে ছাকনিতে চাপাতার গুঁড়ো নিয়ে তাতে গরম পানি ঢেলে দিল। খেতে লাগলো বিস্বাদ। অবশেষে বুঝতে পারলাম, দুধ চা কী জিনিস, পাবনার লোকেরা জানে না।
সবচেয়ে মজার ঘটনা ঘটলো দুপুরে খেতে বসে। এই ঘটনার কথা আজও মনে পড়লে আমরা সবাই এক চোট হেসে নিই। খেতে বসে প্লেটে পোলাও নিতেই ইমরান বলল, “ডাল নে?”
ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললাম, ডাল পরে নিব। মাংস দিয়ে খাওয়া শেষ হতে আমরা সবাই ডাল নিলাম। পাশ থেকে ইমরানের আম্মু বলল, “ওরা যে সবাই উল্টা খায়?”
আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। বুঝলাম, পাবনার লোকেরা আগে ডাল দিয়ে ভাত খায়। এখন পর্যন্ত এত জায়গায় ঘুরেছি, এরকমটা আর কখনোই দেখিনি। ছোট একটা দেশ, তার আবার কত ধরন, কত রঙ!
সব মিলিয়ে প্রথম ভ্রমণের অভিজ্ঞতা দারুণ ছিল। তবে সেবারে একটা সমস্যার কারণে হেমায়েতপুর যাওয়া হয়নি। আশা করি শীঘ্রই আবার ঘুরে আসব, ‘পদুম্বা’ নাম থেকে আবির্ভুত রাজা রামপালের পাবনা থেকে।