লাদাখের অজানা পথে, ইচ্ছে সুখের স্বপ্ন ভ্রমণ

এই পথ দিয়ে যখন আমাদের গাড়ি ছুটে চলছিল তখন কি যে ইচ্ছে হয়েছিল কিভাবে বোঝাই? একবার ইচ্ছে হয়েছিল ইস, ইস যদি সত্যি সত্যি পাখির মত উড়ে যেতে চলে যেতে পারতাম এই পাথুরে পাহাড়, নাম না জানা খরস্রোতা নদী, গভীর খাঁদ, বালুচর, অচেনা ঝর্ণা ধারা পেরিয়ে, ওই যে ওপারের আলতো সবুজের মায়াময় পাহাড়ের গায়ে গায়ে ছোট ছোট যে পাথুরে বাড়ি গুলো দেখা যাচ্ছে, বাড়ি গুলোর মাঝে মাঝে যে উন্মুক্ত সবুজের মিহি গালিচা, সেখানে গিয়ে ঠায় বসে থাকি আকাশের দিকে তাকিয়ে অথবা বাড়ি গুলোর কোন একটার ছাদে গিয়ে অলস শুয়ে থাকি অনন্ত সময়ের জন্য। তাহলে কি খুব বেশী ক্ষতি হত আমাদের? খুব বেশী কিছু কি অদেখা রয়ে যেত সেই দিনের জন্য?

কিন্তু সব কথা কি আর সব সময় ব্যাক্ত করা যায়? সব কথা কি তক্ষুনি মুখ ফুটে বের হয়? সব ইচ্ছা কি ইচ্ছা হলেই জানানো যায়? সব স্বপ্নই কি প্রকাশ করা যায়? বা বাস্তবে এসে ধরা দেয়? সব ভাবনাই কি রঙধনু হয়ে আকাশ বর্ণীল করে দেয়? দেয়না। মাঝে মাঝে আমরা কিছু কিছু স্বপ্ন দেখি, যে স্বপ্ন গুলো শুধুই স্বপ্ন, সুখের স্বপ্ন, একা একা নিজের মত করে আবেশে তলিয়ে যাওয়ার মত সুখ, ভাবনার অতল দীঘিতে সুখ সাতার কাঁটার মত আনন্দের, মনকে হাজারো রঙে রাঙিয়ে তুলে নিজের মত করে রঙে রঙিন হয়ে যাওয়ার মত উচ্ছ্বাসের।

এই পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে চারদিকের রুক্ষ প্রকৃতির মাঝে একদম হঠাৎ করেই অমন আলতো সবুজে মোড়ানো পাহাড়ের গায়ে পাথুরে বাড়ি, পাহাড়ের শরীর বেঁয়ে ঝরে পড়া সুখের ঝর্ণা ধারার অনন্ত সুখের আলিঙ্গনে নিজেকে সপে দিতে, নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃশ্য দেখে আমার ঠিক অমন কিছু ইচ্ছা হয়েছিল। কিছু অসহ্য সুখের স্বপ্নে বিভোর হয়েছিলাম, মনকে কল্পনার হাজারো রঙে রাঙিয়ে বর্ণীল করেছিলাম, নিজেকে নিজেই যেন ভাসিয়ে দিয়েছিলাম স্বপ্নের এক সুখ সাগরে, নীরব নদীতে, সবুজ পাহাড়ের গায়ে গায়ে, ওই ঝর্ণা ধারা গুলোর সুখের উচ্ছ্বাসে, নীল আকাশের নীলিমাতে, দারুন শীতের মাঝেই যেন এক চিলতে সূর্যের উষ্ণ স্পর্শ হয়ে ছুঁয়ে দিয়েছিল সুখের শিহরণে।

নাহ সে কথা বলা হয়নি তখন। নিজেকেও অতটা বুঝতে পারিনি সেই সময়, অত বেশী ভাবনায় তলিয়ে যেতে পারিনি সেই সময়ে, যতক্ষণ ওই সবুজের চাদর জড়ানো পাহাড়, ওই পাখির নীড়ের মত ছোট্ট ছোট্ট পাথুরে বাড়ি গুলো, পাশের ঝরে যাওয়া রুপালী ঝর্ণাধারা, নদীর কলকল ধ্বনি কানে এসেছে, চোখে লেগে থেকেছে, অনুভবে স্পর্শ করতে পেরেছি ততক্ষণ ওদের জন্য অতটা ব্যাকুলতা ছিলোনা। কিন্তু, কিন্তু যখন ওইসব অপার্থিব প্রকৃত, সম্মোহিত পাহাড়, আকুল করা সবুজ আর ব্যাকুল করা ঝর্ণাধারা গুলো ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে লাগলো, চোখের দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যেতে শুরু করলো, ঝর্ণার ঝরে পরার শব্দগুলো যখন বিলীন হতে শুরু করলো, তখনই ধীরে ধীরে আমার অসম্ভব এই ইচ্ছে গুলো একে একে মনে-প্রানে আর মননে যেন তাদের অসীম আকুলতা প্রকাশ করতে শুরু করেছিল। কিন্তু ততক্ষণে ওদের ছেড়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছে আমাদের গাড়ি। চওড়া পথের বেশ কিছুটা সমতলের দীর্ঘ পথ পেয়ে। আর সেদিন থেকে আমার মধ্যে এক অদ্ভুত ইচ্ছা, অবাক স্বপ্ন আর অসীম অপেক্ষা ভর করে আছে…

আমি আবার কোন একদিন এই পথে যাবো। তবে সেবার অবশ্যই একদিন, দুইদিন বা তিন দিনেই মানালি থেকে লাদাখ পৌঁছে যেতে হবে এমন সময়, ভাবনা, সঙ্গী বা অর্থ সাথে করে নিয়ে নয়। একবার আমি এই পথে যেতে চাই অনেক অনেক সময় আর সাধ্য সাথে করে। যেন ইচ্ছে হলেই ওই পথে নেমে যেতে পারি, যেন ইচ্ছে হলেই গাড়িকে ঘুরিয়ে ওই পথে নিয়ে যেতে পারি, যেন ইচ্ছে হলেই একটি বা দুটি দিন অলস অবসরে কাটিয়ে দিতে পারি। ওই সবুজের আলতো চাদর জড়ানো মায়াময় পাহাড়ের গায়ে গায়ে দাড়িয়ে থাকা পাখির বাসার মত ছোট্ট ছোট্ট পাথুরে বাড়ি গুলোর কোন এক ছাদে। যেন ইচ্ছে হলেই সবুজে গড়িয়ে থাকতে পারি কোন এক সূর্য ওঠা উষ্ণ সকালে, উষ্ণ সুখ ছড়ানো কোন এক দুপুরে।

যেন ইচ্ছে হলেই উষ্ণ রোদের আদর ভুলে, বাড়ির ছাদে অলস শুয়ে থাকা সুখকে ঠেলে, সবুজ পাহাড়ের গা বেঁয়ে বেঁয়ে চলে যেতে পারি ওই ঝরে পড়া অনন্ত সুখের রুপালী ঝর্ণা ধারার পাশে, যেন পুরো একটা বিলাসী বিকেল কাটিয়ে দিতে পারি ওর সুর শুনে, ওর সাথে গুনগুনিয়ে, ওর আবেগে ভিজে গিয়ে আর ওর উচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়ে। যেন রুপালী রাতের স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নায় হাজারো তারাদের মাঝে বসে উপভোগ করতে পারি এক অপার্থিব মোহময় রাত, নীরব, নিস্তব্ধ, সুনসান। শুধু ঝর্ণার ঝরে পড়া, আকাশের চাঁদ-তারা, রুপালী জ্যোৎস্না আর অনন্তকাল সুখ হয়ে থাকা কিছু মুহূর্ত যেন জমা করে রাখতে পারি নিজের জন্য।
খুব খুব ভোঁরে ঘুম ভাঙবে জানালার ফাঁক গলে আলতো আলোর ছোঁয়ায়। হাতে একটা ধোঁয়া ওঠা কফির মগ নিয়ে ওর উষ্ণতায় নিজেকে বিলীন করে দিতে দিতে বাইরে গিয়ে দাঁড়াবো। চারপাশের পাহাড়, নদী, ঝর্ণা আর সবুজের মাঝে। দূরের পাহাড় চুড়া গুলোয় তখন সবেমাত্র সূর্যের আলো ঝরে পরতে শুরু করবে। আর সেই সাথে পাহাড় গুলো সেজে উঠবে নানা রঙের সাঁজে। কখনো সোনালি, কখনো রুপালী, কখনো গোলাপি, কখনো কমলা, কখনো বেগুনী, কখনো লাল আর কখনো একই সাথে এতো এতো রঙে যে তাদেরকে আলাদা করা যাবেনা কিছুতেই। গরম কফির মগে চুমুক দিতে দিতে শুধু সম্মোহিত হয়ে তাকিয়েই থাকবো আর তাকিয়েই থাকবো, যতক্ষণ ইচ্ছে হয়…
আরও একবার অন্তত মানালি থেকে লাদাখ যাবার এই অচেনা গ্রামে, অজানা পথে, অসহ্য সুখের পাহাড়ে পাদদেশে।
আমি এমন একটা স্বপ্নময় দিনের অপেক্ষায়…
শুধু পরিবেশ নয়, আসুন আমরা সবাই যে কোন প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষতি বা অপচয় রোধ কোরি।
Source:Sajol Zahid‎ <Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment