লাল কাঁকড়ার লেবুবন সৈকত

প্রথম দিন লেবুর বন এলাকায় কাঁকড়া খেতে না যেতে পারায় দ্বিতীয় দিন সকাল সকাল উঠে মনে হলো কাঁকড়া ভাজি খেয়ে আসা দরকার। তাই সকাল বেলা বের হয়ে হোটেল থেকে নাস্তা সেরে রওনা হলাম সমুদ্রের পাড় দিয়ে বেড়ি বাঁধের উপর দিয়ে। অঘটন ঘটতে টাইম লাগে না সেটা বুঝতে পারলাম।

সমুদ্র সৈকতে চলাকালীন সময়ে সামনের বাইকের চাকা নরম বালির নিচে আটকে পিয়াল ভাইয়ের বাইক গেলো চিৎপটাং হয়ে পড়ে। সমুদ্রের পাড়ের নরম বালির মধ্যে দিয়ে সামনের দিকে জোরে চালাচ্ছিল দেখেই এই অঘটন ঘটল। কিছু হয়নি বাইকে বসা দুজনের। দেখলাম তারা আবার হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে বালির মধ্যেই। পেছনে দাঁড়িয়ে ওদেরকে টেনে তুললাম সারা গায়ে কাদা বালি মাখা অবস্থা থেকে।

সমুদ্রের পাড়ের উল্লাস। ছবিঃ আতিকুর রহমান শুভ

এরপর আবার আমরা সৈকত থেকে উঠে পাশের বেড়ি বাধের উপর দিয়ে চলতে শুরু করলাম। বেশিক্ষণ সময় লাগলো না। মিনিট পনেরো পর আমরা লেবু বন সৈকতের মধ্যে ঢুকতেই উঠল আরেকটি অঘটন। পেছনে আবিরের মোটরবাইকের মধ্যে একটি পেরেক ঢুকে বাইকের চাকা গেল লিক হয়ে। আর ফিরে যাওয়ার জন্য আমাদের একটি বাইকে ঝামেলা হয়ে গেল।

তাই ওরা সমুদ্রের পাড়ে কিছুক্ষণ বসে তারপর গেল বাইক সারাতে আবার কুয়াকাটার দিকে। আমরা কাঁকড়ার অর্ডার দিয়ে বসে রইলাম। মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যেই তরতাজা কাঁকড়াগুলো ভাজা ভাজা এবং তরকারির মতো হয়ে আমাদের সামনে আসলো। দেখতে খুব বেশি ভালো না হলেও খেতে মোটামুটি সুস্বাদু লাগছিল। সমুদ্রের তাজা কাঁকড়া বলে কথা।

কাঁকড়া ফ্রাই ভক্ষন চলছে।

কাঁকড়া খাবার পর আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম ওদের মটরসাইকেল সেরে আসার। জন্য প্রায় মিনিট চল্লিশেক মতো সময় নিয়ে তারা মোটরসাইকেল সেরে এসে পৌঁছালো লেবু বনে। এরপর ওদের জন্য কাঁকড়া অর্ডার করার পাশাপাশি আমরা আবার নিজেদের জন্য অর্ডার দিলাম। খেতে ভালোই লাগছিল এবং দামও বেশ কম ছিল। প্রতি প্লেট মাত্র ৬০ টাকা। সবাই প্রায় অর্ধেক পেট জুড়ে কাঁকড়া ভাজি খেয়ে নিলাম।

কাঁকড়া খাবার পর আমাদের দেখার বিষয় ছিল সমুদ্রের জোয়ার এবং বিকেলে সানসেট পয়েন্টে গিয়ে সূর্যাস্ত দেখা। হাতে যখন সারা দিন রয়েছে বলে যার যার মতো ইতঃস্তত এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছিলাম। এই অংশগুলোতে সুন্দরবনের কিছু সুন্দরী গাছের পাশাপাশি বেশ কিছু ম্যানগ্রোভ জলাভূমি চোখে পড়ল। সেগুলোর ভেতর দিয়েই ঘুরছিলাম আমরা।

গাছের উঁচু উঁচু শিকড়ে বসেই আড্ডাবাজি করছি আমরা।

বেশ কিছু গল্প অনুযায়ী নাকি এই অঞ্চল একটা সময় সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার ঘুরে বেড়াতো। খাল পার হয়ে সাঁতরে এই এই বনে চলে আসত বাঘগুলো। তাই স্থানীয় কিছু মানুষের মধ্যে এই এলাকাটি স্বাভাবিকভাবে ভয়ংকর হয়ে ছিল দীর্ঘদিন। আমরা যদিও এই গল্পগুলোতে খুব বেশি কান দেইনি। বনের ভেতর দিয়ে ঝোপঝাড় ভেদ করে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম আর গাছ গাছড়ার ভেতর দিয়ে উপরে উঠে আড্ডা দিতে লাগলাম বসে বসে। ভালোই লাগছিল, বাইরে সমুদ্রতটে তখন প্রচণ্ড রোদ্দুর।

রোদের তাপ আর বালির গরমের থেকে বনের মধ্যে ঢুকে গাছের উপর বসে থাকা ঢের ভালো ছিল। গল্প করতে করতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে আসলো। এদিকে সবার ক্ষুধাও লেগেছে বেশ ভালো মতো, কিন্তু খেতে হলে যেতে হবে আমাদের কুয়াকাটা শহরে। তাই অগত্যা দেরি না করে বাইক নিয়ে আবার বের হয়ে গেলাম কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে।

সমুদ্রের সাথে কিছু একান্ত সময়। ছবিঃ আতিকুর রহমান শুভ

আগের দিন যে হোটেলে গিয়েছিলাম সেই হোটেলে খাওয়া দাওয়া শেষ করলাম আমরা সামুদ্রিক বেশ কিছু মাছ দিয়ে। কক্সবাজারের তুলনায় কুয়াকাটায় দেখলাম খাবারের দাম বেশ কম। বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছগুলোর দাম কক্সবাজার বা সেন্টমার্টিনের থেকে অনেক কম। তাই যে যত খুশি খেতে পারছিলাম এখানে এসে। খাবার দাবার শেষে আমরা আবার হোটেলে ফিরলাম কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার জন্য।

হোটেলে বসে বিশ্রাম নিতে গিয়েই কয়েকজন গেল ঘুমিয়ে। কিন্তু বিকেলের পর আমাদের যাবার কথা সানসেট পয়েন্টে। সেখান থেকে রক্তিম সূর্যাস্ত দেখতে হবে। আমি আর শুভ হোটেল থেকে বের হয়ে সামনে সমুদ্রের পাড় ধরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করতে চলে গেলাম। তটরেখা ধরে হাঁটতে হাঁটতে আর গল্প করতে করতে কখন যে সময় পার হয়ে যায় সেটাই বুঝে ওঠা দায়।

বিশাল সাইজের কিছু সামুদ্রিক কাঁকড়া, দেখতে আবার চিকেন ফ্রাই এর মতো।

বিকেল নেমে এলে আমরা আবার হোটেলে ফিরে গেলাম। দলের বাদবাকিদের ডেকে তুলে রওনা দিলাম লেবু বনের উদ্দেশ্যে। মোটরসাইকেল সেখানেই পার্ক করে রেখে আমার আবার কাঁকড়া খাবার ইচ্ছা হলো। খেতে যে আহামরি ভালো ঠিক সেরকমও না। কিন্তু কেন জানি বারবার খেতে ইচ্ছা হচ্ছিলো। তাই আবার আমরা সবাই বসে কাঁকড়া অর্ডার দিলাম। খাবার পর চলে গেলাম সানসেট পয়েন্টের দিকে।

বিকালের দিকে মোটামুটি জোয়ারের পানি কমে এসেছে। দুপুরে যখন ফিরে যাচ্ছিলাম তখন সমুদ্রের জল প্রায় কাঁকড়ার দোকানগুলো পর্যন্ত চলে আসছিল। এখন আবার কমে এসেছে। অন্যদিকে সানসেট পয়েন্টের দিকে যত এগোচ্ছি সামনে বিশাল সুন্দরবনটি দৃশ্যমান হচ্ছে। আর সূর্য থেকে রক্তিম আভা ছড়াচ্ছে। সানসেট পয়েন্ট পৌঁছানোর কিছু পরেই দেখলাম সূর্য আস্তে আস্তে ঢুকে যাচ্ছে সমুদ্রের জলের নিচে।

গোধূলির রক্তিম আভায় লেবুবন সমুদ্রতট।

অন্ধকার হয়ে আসার পর আর তেমন কিছু করার ছিল না। আমরা যার যার ফোনের লাইট জ্বালিয়ে সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে আবার লেবু বাগান ফিরে আসলাম। স্থানীয় কিছু কিছু মানুষ বলল এখানে বেশি রাত অব্দি থাকার নিয়ম নেই দর্শনার্থীদের। এলাকা ভালো না, তাই ফিরে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় ছিল না। কুয়াকাটা ফিরে এসে হোটেলে মোটরসাইকেল রেখে যখন হালকা অন্ধকারের মধ্য দিয়ে সমুদ্রের দিকে হাঁটছিলাম যেন কোনো এক স্বর্গীয় প্রশান্তি মন জুড়িয়ে দিচ্ছিল।

Share:

Leave a Comment