শান্তিনিকেতন পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম

শান্তিনিকেতন পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের নিকট অবস্থিত একটি আশ্রম ও শিক্ষাকেন্দ্র। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিভৃতে ঈশ্বরচিন্তা ও ধর্মালোচনার উদ্দেশ্যে বোলপুর শহরের উত্তরাংশে এই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা কালক্রমে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ নেয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবনের দ্বিতীয়ার্ধের অধিকাংশ সময় শান্তিনিকেতন আশ্রমে অতিবাহিত করেছিলেন। তাঁর সাহিত্য ও সৃষ্টিকর্মে এই আশ্রম ও আশ্রম-সংলগ্ন প্রাকৃতিক পরিবেশের উপস্থিতি সমুজ্জ্বল।

শান্তিনিকেতন চত্বরে নিজের ও অন্যান্য আশ্রমিকদের বসবাসের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনিন্দ্য স্থাপত্যসৌকর্যমণ্ডিত একাধিক ভবন নির্মাণ করিয়েছিলেন।পরবর্তীকালে আশ্রমনিবাসী বিভিন্ন শিল্পী ও ভাস্করের সৃষ্টিকর্মে সজ্জিত হয়ে এই আশ্রম একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনস্থল হয়ে ওঠে। ১৯৫১ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে।

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়:-

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বীরভূম জেলার বোলপুর শহরে অবস্থিত। ১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেন।১৯৫১ সালে এটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে।কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য। দেশবিদেশ থেকে প্রচুর ছাত্রছাত্রী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা করতে আসেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য প্রাক্তনীদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, অস্কারবিজয়ী চিত্র-পরিচালক সত্যজিৎ রায়, ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রমুখ।

ইন্দিরা গান্ধী কবিগুরুর সরাসরি ছাত্রী ছিলেন।পরবর্তীতে ইন্দিরা গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে শান্তিনিকেতন আসতেন।ইন্দিরা গান্ধী প্রতিবার শান্তিনিকেতন এসে ছাত্রী অবস্হায় যে কমন ডাইনিংয়ে বসে খাবার খেতেন প্রধানমন্ত্রী এবং বিশ্বভারতীর উপাচার্য হওয়ার পরও সেই কমন ডাইনিংয়ে বসে ছাত্রীদের সাথে খাবার খেতেন।

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রী পদাধিকার বলে উপাচার্য।কবিগুরু স্বয়ং এই নিয়ম করে দিয়ে গিয়েছেন এবং কবিগুরুর নিজ বিশ্বভারতীর পাঠ্যসূচী তৈরী করে গিয়েছেন।এখনও সেই পাঠ্যসূচী অনুযায়ী পড়ানো হয়।

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গন:-

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি প্রাঙ্গন অবস্থিত। শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন।

শান্তিনিকেতন গৃহ:-

ঊনবিংশ শতাব্দী মাঝের সময় ১৮৬০ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বোলপুরের কাছে একটি অনুর্বর জমি ক্রয় করে “শান্তিনিকেতন” নামে গৃহটি নির্মাণ করেন। কালক্রমে পার্শ্ববর্তী সম্পুর্ণ এলাকার নাম হয় শান্তিনিকেতন।

ছাতিম তলা:-

তিনি
আমার প্রানের আরাম
মনের আনন্দ
আত্মার শান্তি…

ছাতিম তলা থেকেই শান্তিনিকেতনের সৃষ্টি।এই ছাতিম তলা থেকেই প্রতি বছর ৭ই পৌষ,পৌষ মেলার উদ্বোধন হয়।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন রায়পুরের জমিদারবাড়িতে নিমন্ত্রন রক্ষা করতে আসছিলেন তখন এই ছাতিমতলায় কিছুক্ষণ এর জন্য বিশ্রাম করেন এবং এখানে তিনি তার “প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি” পেয়েছিলেন। তখন রায়পুরের জমিদারের কাছ থেকে ষোলো আনার বিনিময়ে ২০ বিঘা জমি পাট্টা নেন।বর্তমানে প্রতি বছর ৭ই পৌষ সকালে এখানে উপাসনার মাধ্যমে পৌষ মেলা উদ্বোধন হয়।

আম্রকুঞ্জ:-

২৮ জানুয়ারী ১৯৩৯ সালে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হবার আগে ২১ জানুয়ারি, এখানে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস আসেন।

কলা ভবন:-

এই বিভাগে শিল্পসমন্ধীয় যাবতীয় গঠনমূলক কাজ ও সবরকমের চিত্র অঙ্কন শেখান হয়।

শিল্প ভবন:-

এই বিভাগে চারু ও কারুশিল্প সম্বন্ধীয় সমস্ত গঠনমূলক কাজ শেখান হয়।

সঙ্গীত ভবন:-

এই বিভাগে কণ্ঠ ও যন্ত্র সঙ্গীত, নৃত্য ও অভিনয় শেখানো হয়।

বিদ্যা ভবন:-

এখানে প্রাচীন, আধুনিক ও অন্যান্য ভাষা, সাহিত্য ও দর্শন যথা সংস্কৃত, পালি, বাংলা, হিন্দী, উর্দু ভাষা অধ্যয়ন এবং বৈদিক, বৌদ্ধ ও গুপ্ত সময়কাল।আরবি, পারসি ইত্যাদি বিদেশী ভাষা এবং এই সম্বন্ধীয় গবেষকদের বিষয়ে।

শিক্ষা ভবন:-

এই বিভাগে সাধারণ জ্ঞান ও শিক্ষা প্রদান করা হয় যা সমস্ত ছাত্রছাত্রীর জন্য আবশ্যিক।

চীনা ভবন:-

এই বিভাগের অন্তর্ভুক্ত শিক্ষানবিশদের চীনা ভাষাগুলি ও সাহিত্য, চীনা সংস্কৃতি ও চীনা সভ্যতা ইত্যাদি ও চীনা ছাত্রছাত্রীদের ভারতীয় সংস্কৃতি, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য পড়ান হয়।রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন ছিল সাম্প্রতিক শতাব্দীতে ভারত ও চীনের মধ্যে যে প্রাচীন সাংস্কৃতিক ও সভ্যতার গভীর সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল তাকে পুনরুদ্ধার করতে শান্তিনিকেতন ভিত্তি হোক।তাঁর এই বিশ্বাসকে স্বতন্ত্রভাবে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করেন “টান ইউন শান” যিনি বিশ্বভারতীতে “টান সাহেব” বলে পরিচিত ছিলেন। পড়াশুনা শেষ করে শিক্ষকতা করাকালীন টান সাহেবের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে প্রথমবার দেখা হয়। দুজন সমমনস্ক মানুষ ছিলেন। টান রবীন্দ্রনাথের আহবানে ১৯২৭ সালের জুলাই মাসে ভারতে আসেন। ১৯২৮ সালে তিনি জোড়াসাঁকো হয়ে পাঠভবনের তৎকালীন প্রিন্সিপাল সত্যজীবন পালের সঙ্গে শান্তিনিকেতন আসেন।কয়েকদিনের মধ্যেই সেখানে ৫জন ছাত্র নিয়ে পড়ানো শুরু করেন যারা পরে জ্ঞানীগুণী মানুষ রূপে বিখ্যাত হয়েছিলেন। ১৯২৬ সালে “চেন নাই অই ইয়ের” সঙ্গে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন যিনি একজন গুণী মানুষ ছিলেন এবং টানের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে এসে টান এবং রবীন্দ্রনাথের ইন্দো চীন সাংস্কৃতিক অধ্যয়নের জন্য একটি প্রমুখ আন্তর্জাতিক কেন্দ্র গড়ে তোলার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে সর্বদা সাহায্য করেছিলেন। সাংস্কৃতিক সৌহার্দের মিলন, চীনা ভবনের প্রিন্ট, টান নিজে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরামর্শ করে বানিয়েছিলেন। ১৯৩১ সালে, তিন বছর শান্তিনিকেতনে পড়ানোর পর এই ইন্দো-চীন সৌহার্দের ভাবনাকে প্রচার ও জনপ্রিয় করতে, টান চীনে ফিরত যান। প্রায় দুবছর সেখানে বিভিন্ন বক্তৃতা ও লেখার মাধ্যমে সেখানকার মানুষদের জাগরূক করেন ও ১৯৩৩ সালে নানকিনে ইন্দো-চীন সাংস্কৃতিক সমিতি খোলেন। সেই বছর তিনি ও তাঁর কিছু জ্ঞানীগুণী বন্ধু প্রায় ৫০হাজার বই ও প্রচুর অর্থ শান্তিনিকেতনে দান করেন। সেখানকার কিছু প্রকাশকরা সবরকম চীনা জ্ঞানে সমৃদ্ধ বইও দান করেন। ১৪ এপ্রিল ১৯৩৭ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে চীনা ভবনের উদ্বোধন হয়।শান্তিনেকতন টান সাহেবকে ১৯৭৯ সালে “দেশিকোত্তম” উপাধিতে ভূষিত করে।২০১৭ সালে চীনা ভবনের প্রধান অভিজিত ব্যানার্জী।সম্প্রতি চীনা ভবন চারটি সহানুভূতিশীল স্মারক (এম ও ইউ) সই করেছে দুই দেশের ছাত্রছাত্রীদের জন্য ছোট ছোট শিক্ষা আদানপ্রদান জাতীয় প্রকল্পের জন্য।

বিনয় ভবন:-

বিনয় ভবন ১৯৪৮ সালে কলা ও কারুশিল্প এবং সঙ্গীত শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত এবং পরবর্তীকালে ১৯৫১ সালে একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ হিসেবে গড়ে ওঠে।বিনয় ভবন শিক্ষকদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য প্রশিক্ষণের পাশাপাশি শিক্ষার অন্যান্য দিশার প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছে। বিনয় ভবন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা ব্যবস্থার একত্রিকরণ পদ্ধতিকে গ্রহণ করে, যার মাধ্যমে বর্ণ বৈচিত্র্যময় সমুদায়কে শিক্ষা, সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা ও সেবা প্রদান করা যায়। যদি শিক্ষা পরিবর্তনের মাধ্যম হয়, তাহলে পর্যাপ্তরূপে প্রশিক্ষণ কর্মীদের থাকার প্রয়োজন জরুরী। এখানে ছাত্র-ছাত্রীরা স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শিক্ষা যথা বি এড, এম এড, এম এ পি এইচ ডি ইত্যাদি করতে পারে।এখানে শারীর শিক্ষায় -এ ছাত্র-ছাত্রীরা খেলাধুলার ব্যাপারে শিক্ষা নিতে পারে।

এছাড়াও শান্তিনিকেতনে হিন্দী ভবন,রবীন্দ্র ভবন,দর্শন সদন,আনন্দ পাঠশালা,রতন কুঠি,নাট্ট্য ঘর,প্রশাসনিক ভবন,কেন্দ্রীয় পাঠাগার,পূর্বপল্লী অতিথি ভবন,আন্তর্জাতীক অতিথি ভবন,শান্তিনিকেতন ডাকঘর,জনসংযোগ কার্যালয়,কৃষি অর্থনৈতিক গবেষণা কেন্দ্র,পিয়ারসন স্মৃতি হাসপাতাল রয়েছে।

মেলা প্রঙ্গন- পৌষ মেলা

১৮৯১ সালে মহর্ষির ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষা নেওয়া এবং পরে উপাসনা গৃহ নির্মাণ এর মত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কে স্মরণীয় করে রাখতে ১৮৯৪ সালে শুরু হওয়া পৌষমেলায় বিক্রি হত শান্তিনিকেতন লাগোয়া কিছু গ্রাম এর মানুষ এর কিছু ঘরোয়া সামগ্রী যেমন, মাটির হাড়ি ,লোহার কড়াই ,পাথরের বাটি,কাচের চুরি ইত্যাদি।যার মূল উদ্দেশ্য ছিল গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ। সময়ের সাথে সাথে মেলা যেমন কলেবরে বেড়েছে তেমনই হারিয়াছে তার সাবেক রং রূপ উদ্দেশ্য।

পৌষমেলা বা পৌষ উৎসব হল শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতন অঞ্চলের প্রধান উৎসব।দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষাগ্রহণ স্মরণে এই উৎসব পালিত হয়। উৎসব ও মেলা শুরু হয় প্রতি বছর ৭ পৌষ; চলে ৬ দিন ধরে।

পল্লী শিক্ষা ভবন:-

বিশ্বভারতী আইন-১৯৮৪ অনুসারে ১৯৬৩ সালের ১লা সেপ্টেম্বর, স্থাপিত “পল্লী শিক্ষা সদন” বাড়িটির নতুন নামকরণ করে “পল্লী শিক্ষা ভবন” রাখা হয়।

যেভাবে যাবেন:-
হাওড়া এবং শিয়ালদাহ স্টেশন থেকে ট্রেনে যেতে পারবেন।কলকাতা থেকে গাড়ী রিজার্ভ করেও যেতে পারেন।

Share:

Leave a Comment