সবুজের টানে আসাম

ব্রহ্মপুত্র ও বরাক উপত্যকা এবং কাছাড় নিয়ে অসমে অসমীয়া বাঙালি বোড়োসহ নানা উপজাতির বাস। পাহাড়, নদী, অরণ্য, চা বাগান এখানের অন্যতম আকর্ষণ। নয়নলোভা নৈসর্গিক সৌন্দর্যের টানে এই কিছুদিন আগেও আবার ভ্রমণে গেলাম আসামে। ভারতের এই রাজ্যে আছে দারুণ বৈচিত্র্য। এ জন্যই অসমে বারবার যাওয়া। অসমকে বাংলাদেশীরা বলে ‘আসাম’। ওখানকার লোকজন বলে অসম। এবারের ভ্রমণটা অন্য পথ দিয়ে। আখাউড়া হয়ে এলাম আগরতলা। রাত কাটানোর পরদিনই অসম রাজ্যে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। সন্ধ্যার বাসে উঠে পরদিন সকালে গিয়ে পৌঁছলাম অসমের শিলচর শহরে। আগরতলা থেকে শিলচরের দূরত্ব ৩১৭ কিলোমিটার। এখানের স্টিমার ঘাটের হোটেল মনোরঞ্জনে উঠলাম। খাওয়ার ব্যবস্থাও ছিল এই হোটেলে। বরাক নদীর ধারে শিলচর বেশ সাজানো-গোছানো শহর। বাঙালিদের বসবাস এখানে বেশি। বলা যায় বাঙালিপ্রধান শহর। অসমের কাছাড় জেলার সদর দফতর বসেছে এই শিলচরে। বিকালে গেলাম গান্ধীবাগে। এখানে গিয়ে দেখলাম শহীদ স্তম্ভ আর মেডিকেল কলেজ। সেদিন ছিল রোববার। অটোচালক বলল, উধারবন্দে শ্রী শ্রী কাঁচা কান্তি দেবী মন্দিরÑ ওখানে গেলে আজ পূজা দেখতে পাবেন। এ কথা শুনে অটোতে উঠে চললাম মন্দিরের দিকে। গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য। কত লোক মন্দিরে ঢুকছে। আমিও ঢুকলাম। কী অপূর্ব এই মন্দিরের গঠনশৈলী। এদিকে কীর্তন গান হচ্ছে। তখন আরও বেশি উৎফুল্ল হলাম। কাছেপিঠেই ব্রজমোহন গোস্বামীর আশ্রম। এর সামনে দাঁড়াতেই একজন বললেন, ওই বৃক্ষতলে যান, কোন মনস্কামনা জানানÑ দেখবেন তা পূর্ণ হবেই।
আশ্রম ছাড়িয়ে ৩ কিমি দূরে খাসপুরে এলাম। ১৭ শতকের কাচারি রাজাদের বিধ্বস্ত রাজধানী ছিল এই খাসপুরে। এদিকে সন্ধ্যা নেমে এসেছে দেখে এবার ফিরলাম শিলচরের দিকে। পরের দিন শ্রী কৃষ্ণের স্মৃতিবিজড়িত মনিহরণ সুরঙ্গ দেখতে গেলাম। এটি ত্রিবেণী নদীর পাশেই। শিবরাত্রি, দোলযাত্রা ও বারুণীর সময়ে এখানে মেলা ও উৎসব হয়। শিলচর থেকে ১১২ কিমি দূরে হাফলঙ ৬৮০ মিটার উচ্চতায় অসমের অন্যতম হিল রিসর্ট। সড়কপথে বাসে হাফলঙে পৌঁছতে ৫ ঘণ্টা লেগে গেল। উঠলাম ট্যুরিস্ট লজে। নর্থ কাছার হিল ডিস্ট্রিক্টের সদর দফতর বসেছে এই হাফলঙে। এখানের প্রাকৃতিক পরিবেশ অসাধারণ। হাফলঙ লেক ঘিরে শহর। এখানে থেকে নৌকায় বেড়ালাম। পাহাড়ি প্রান্তরে দেখলাম নানা প্রজাতির অর্কিডের ছড়াছড়ি। ৯ কিমি দূরের জাটিঙ্গা রেল স্টেশনে গিয়ে শুনলাম, আগস্ট থেকে নভেম্বরের মধ্যে রঙ-বেরঙের পরিযায়ী পাখিরা আসে দলে দলে। তখন ওখানে যারা আসেন তারা হƒদয়বিদারক দৃশ্য দেখতে পান। মৃত্যুফাঁদ পাতে উপজাতীয়রা। এরা বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে মারে পাখি। আর এসব পাখির মাংস খায় উপজাতিরা। হাফলঙ থেকে সন্ধ্যায় বাসে উঠলাম। এবার যাত্রা নওগাঁ। এই শহর থেকে ১৪ কিমি দূরে বর্দ্ধয়া বৈষ্ণব সংস্কারক শ্রী শংকর দেবের জš§স্থান। সেই টানেই ওখানে যাওয়া। বর্দ্ধয়ায় মন্দিরও দেখলাম। নওগাঁ থেকে ৭৫ কিমি দূরে তেজপুর। আগেই জানতাম, ব্রহ্মপুত্রের উত্তর পাড়ে শোনিতপুর জেলার সদর তেজপুরে অসমের সবচেয়ে সুন্দর শহর। এখানে এসে উঠলাম অসম পর্যটনের ট্যুরিস্ট লজে। সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ ছবির মতোন সাজানো শহর তেজপুরকে দেখে অভিভূত হলাম। অতীতের শোনিতপুরই বর্তমানের তেজপুর। পৌরাণিক কাহিনীর বানাসুরে রাজধানী ছিল এই তেজপুর। এখানে গিয়ে দেখলাম, বামুনী পাহাড়ে পাথরের বেশকিছু স্মৃতিচিহ্ন দাপরবতিয়ার গেট, ৫ শতকের গুপ্ত যুগের তোরণের ধ্বংসাবশেষ মহাভৈরবী মন্দির, কোলে পার্ক অগ্নিগড় পাহাড়। তেজপুরে ২ দিন কাটানোর পরে চললাম ডিব্র“গড়ের দিকে। ডিব্র“গড় অসমের অন্যতম বাণিজ্যিক শহর। এখানে এসে মন ভরে দেখলাম চায়ের বাগান। ডিব্র“গড়ও বাঙালি অধ্যুষিত শহর। এই শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্র নদ। এখানে থেকেছিলাম নটরাজ হোটেলে। ডিব্র“গড় থেকে ফেরিতে ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে সোনারিঘাট পৌঁছে অরুণাচলের পাশিঘাট ও আলংয়ে বাসে যাওয়া যায়Ñ কিন্তু ইচ্ছে করেই ওদিকে না গিয়ে এলাম তিন সুখিয়ায়। ডিব্র“গড় থেকে তিন সুকিয়ার দূরত্ব মাত্র ৪৭ কিমি। খুবই ছোট শহর। এখানে একরাত কাটালাম প্যালেস হোটেলে। এখানের দুলিয়াখানে গিয়ে তেলের খনি দেখলাম। এছাড়া নাহারকাটিয়াতেও রয়েছে তেলের খনি।
তিন সুকিয়া থেকে ১২৪ কিমি দূরে শিবসাগর। এটি জেলা শহর। এখানে এসে উঠলাম অসম পর্যটনের ট্যুরিস্ট লজে। অতীতে অহম রাজাদের প্রথম রাজধানী ছিল শিবসাগর থেকে ২৮ কিমি দূরে চরাইকেওতে। ১২৫৩ সালে অহম রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সুকাফা নির্মিত এই রাজধানীতে এখনও রয়েছে স্মৃতিচিহ্ন, তা দেখার জন্য ওখানে গিয়েছিলাম। শিবসাগরে আরও দেখলাম ২০০ বছরের পুরনো প্রাচীন বিশাল জলাশয় অর্থাৎ শিবসাগর। এর পাশেই শিবডোল মন্দির। ১৭৩৪ সালে অহরাজ শিব সিংহ নির্মিত এই শিব মন্দির ভারতের সর্বোচ্চ মন্দির। শিবরাত্রিতে এখানে উৎসব হয়। এখানে গিয়ে এর দু’পাশে দেখলাম বিষ্ণুডোল ও দেবীডোল মন্দির। আরও রয়েছে, অহমরাজ প্রমত্ত সিংহ কর্তৃক নির্মিত দুতলা রয়েল প্যাভিলিয়ন অর্থাৎ রঙঘর। এক সময়ে এর উপরে বসে অহম রাজরা হাতির লড়াই দেখতেন। এক বিকালে শিবসাগরের নিকটবর্তী কায়রঙ্গ ঘর, জয় সাগর জলাশয়, মন্দির, গৌরি সাগর জলাশয়, নামদাঙ পাথরের ব্রিজ ঘুরে দেখলাম।
শিবসাগর দেখা শেষ করে ৫৬ কিমি. দূরের জোড়হাটে এলাম। এখানে উঠলাম ইস্টার্ন হোটেলে। চারদিকে চা বাগান, এর মধ্যে জোড়হাট শহরে বেড়াতে এসে দারুণ বৈচিত্র্য খুঁজে পেলাম। বিকালে এলাম চা গাছের গবেষণা কেন্দ্র আর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে। এখানের মাজুলী দ্বীপে গিয়ে একজন বৈষ্ণবের সঙ্গে দেখা হল। কথায় কথায় দুজনের সম্পর্কটা আরও নিবিড় হল। সে আমাকে কীর্তন গানও শুনিয়েছিল। মাজুলি থেকে পথ গেছে উত্তর লখিমপুরে। দূরত্ব ৪০ কিমি। উত্তর লখিমপুরে গিয়ে জানলাম, এখান থেকে অরুণাচলের রাজধানী ইটানগরের দূরত্ব মাত্র ৫৬ কিমি। উত্তর লখিমপুরে এক রাত কাটালাম পরে জোড়হাট হয়ে গোলঘাটে এলাম। ওখান থেকে শিলচর হয়ে সীমান্তের করিমগঞ্জে এসেছিলাম। এর ওপারেই বাংলাদেশের জকিগঞ্জ। ওই পথ ধরে দেশে ফিরতে চাইলে কী আর হয়। যে পথ দিয়ে এসেছি সেই পথ দিয়েই অর্থাৎ আগরতলায় আবার ফিরে আসা। অতঃপর আখাউড়া হয়ে ঢাকায় ফিরলাম।

Post Copied From:Md Faruque Hossain‎>Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment