সাজেক যাওয়ার উদ্দেশ্যে

সাজেক যাওয়ার উদ্দেশ্যে যখন ব্যাগ প্যাক গোছাচ্ছিলাম.. আম্মু বললো সারাবছর তো পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরিস, নায়রী যাওয়ার মত এত প্রস্তুতি কেন এবার?
স্মিত হেসে বললাম, ফিরে এসেই দেখাবো কি জন্য যাচ্ছি সাজেক। যদিও প্ল্যান ছিল সোনাদিয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী টাইপ দ্বীপে রাত কাটাবো কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে বন্ধুদের নিয়ে রওনা হলাম রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের উদ্দেশ্যে। যাত্রাপথে একটি সড়ক দুর্ঘটনার কারনে সৃষ্ট যানজটে আটকা পড়ে দেড় ঘন্টা দেরীতে পৌঁছাই খাগড়াছড়ি বাসস্ট্যান্ডে। ততক্ষনে যথেষ্ট দেরী হয়ে গেছে..
আগেই রিজার্ভ করে রাখা জীপ গাড়িতে চেপে রওনা দেই দিঘীনালা আর্মি চেক পোস্টের দিকে। বলে রাখা ভালো, ট্যুরিস্টদের নিরাপত্তা রক্ষায় আর্মি দুই শিফটে এস্কর্ট প্রদান করে থাকে। একটি সকাল ১১টায়, অন্যটি বিকাল তিনটায়.. অনুরূপ সাজেক থেকেও একই সময়ে এস্কর্ট দুটো ছাড়ে..
বিকাল চারটায় যখন চেক পোস্টে পৌঁছাই, ততক্ষনে এস্কর্ট অনেক দূর ছেড়ে গিয়েছিল। অন্যান্য সময় হয়তো যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যেতনা.. সৌভাগ্যবশত আরও তিনটি গাড়ি এস্কর্ট মিস করে অপেক্ষারত ছিল ওখানে। শেষে বিনা এস্কর্টে চারটি গাড়ি একসাথে কাছাকাছি দূরত্ব রেখে যাওয়ার শর্তে অনুমতি মিললো। সব ফর্মালিটিজ পূরণ করে শুরু হলো এক ভয়াবহ রোমাঞ্চকর যাত্রা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় একদিকে পাহাড়ি আতঙ্ক, অন্যদিকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে উঁচুনিচু রাস্তায় দক্ষ ড্রাইভারের দুর্দান্ত সব স্টান্ড মনে শিহরণ তোলছিল। একেকটি ঢাউস সাইজের উঁচু পাহাড়ে গাড়ি যখন বুলেট গতিতে গাড়ি উঠে, মনে হবে যেন ৪৫ডিগ্রি এঙ্গেলে আকাশে উড়ছেন।

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে সাজেক ভ্যালিতে পৌঁছাই। এবার থাকার ব্যবস্থা করতে হবে..
ছুটির দিন + আগের দিন স্ট্রাইক থাকায় ট্যুরিস্টদের চাপ ছিল বেশী। কোন রিসোর্ট/কটেজ খালি পাচ্ছিলাম না। পরে ড্রাইভারের সহযোগীতায় একটি মাচাং কটেজে এটাচ বাথ সহ দুই বেডের একটি রুম ভাড়া নেই প্রতিরাত ২৫০০ করে।
এখানে খাবার আগে থেকে অর্ডার করে যেতে হয়। একটি জুম রেস্তোরাঁয় ভাত + আলুভর্তা (১বার) + ডাল অর্ডার করলাম প্রতিজন ১০০টাকা করে। লাইট বাজেটের ট্যুরে এটুকুই যথেষ্ট কারন এখানে সবকিছু এক্সপেনসিভ।
খাবার পর্ব সেরে রওনা হলাম হ্যালিপ্যাডে। লোকে লোকারণ্য চারিদিক। কেউ ফানুশ উড়াচ্ছে, কেউ দলবেঁধে বা আনমনে গান গাচ্ছে, কেউ অতি উচ্ছ্বাসে হুদাই চিল্লাচ্ছে.. এ এক অন্য দুনিয়া।
একেকজনের চাহনির ভাষা জানান দেয় এরা বহুদিন খোলা আকাশ দেখেনি, মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেয়নি। এই পরিবেশ ওদের রোবটিক মনকে দান করেছে সীমাহীন উদারতা। অফিসের জাঁদরেল কর্তাটি এখানে অমায়িক, আত্মকেন্দ্রিক মানুষটি মিশুক, কৃপন লোকটি সহযাত্রীকে স্যান্ডউইচ অফার করে, লাজুক মেয়েটি এখানে গলা ছেড়ে গায়…….

ইচ্ছে করছিল ওখানে রাত কাটিয়ে দেই। কিন্তু ভ্রমনক্লান্তি, আকস্মিক বৃষ্টির ভয়, ভোরে মেঘ ভেদ করে সুর্যোদয় দেখার তাড়া থাকায় কটেজে ফিরে যাই। কিন্তু ঘুমাবো কি! পাশের রুমের পোলাপান তাস খেলার অফার দিয়ে বসে। মনে হচ্ছিলো ছেলেগুলো কতদিনের পরিচিত!!
আমাদের কেউ কেউ ওদের রুমে, ওদের কেউ কেউ আমাদের রুমে হাসি ঠাট্টা আনন্দে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। ভোররাতে এ্যালার্মের শব্দে উঠে পড়ি। ফ্রেশ হয়ে ঝুলন্ত বারান্দায় মেঘ দেখতে যাই..
ভোরের আলো তখনো পুরোপুরি ফুটেনি। ঝাপ্সা আর্দ্র হয়ে থাকায় বুঝতে পারি মেঘের ভেলা বারান্দায় ঢুকে পড়েছে।
সূর্যোদয় দেখতে হ্যালিপ্যাডে রওনা দেই। দেখলাম আমাদের আগেই শত শত মানুষ সেখানে জড়ো হয়েছে। মেঘ ভেদ করে সূর্য ঠিক উদয় হয়নি, উদয় হয়েছে আরও অনেক উপর দিয়ে.. তবে মেঘের উপর সূর্যের আলো পড়ার স্বর্গীয় দৃশ্যটি সারাজীবন মানসপটে উঁকি দিবে।
এরপর রওনা হলাম সাজেকের সবচেয়ে উঁচু চূড়া কংলাক পাহাড়ে, যার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ফিট উপরে। জিরো পয়েন্ট থেকে ৩০মিনিট হাঁটলেই কংলাক। খাড়া পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে পুরো এলকার নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করা যায়। কংলাক থেকে ফিরে সকালের নাস্তা সারলাম। ওহ বলতে ভুলে গেছি.. আমাদের পাঁচজনের গ্রুপের সাথে এক দম্পতিও যোগ দেয় খাগড়াছড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে। পুরো যাত্রাপথেই আপুটি ভাইয়ার উপর চোটপাট করেছেন কেন উনাকে মিথ্যা বলে সাজেক নিয়ে আসা হলো!!
বিষয়টা হলো এমন, এক ফাইন দিনে ভাইয়া প্রিয়তমাকে সারপ্রাইজ দিবে বলে সাজেকে একটি সুইট বুকিং করেন। বাসা থেকে বেরোনোর সময় বলেছিলেন শুধুমাত্র চিটাগাং ঘুরবে ওরা। চিটাগাং এসে ভাইয়া সাজেকে রুম বুক করার কথা জানান। কিন্তু আপুর চরম আপত্তি। উনার কন্সার্ন হলো, লোকটি নিজেই অসুস্থ প্লাস বাচ্চা নিয়ে এত দূর ভ্রমণ খুব কষ্টের। তবুও যেহেতু রুম বুকিংয়ের টাকা পে করে ফেলেছে, বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে সাজেক। ভাইয়া চুপচাপ হজম করে গেছেন বৌয়ের চোটপাট। 😜😜
পরেরদিন বেলা ১১টার দিকে ঐ দম্পতির সাথে দেখা। দেখলাম ভাই-আপু আর পিচ্চি তিনজনেই ফুরফুরে মেজাজে। আপুকে বললাম কালকে তো খুব মূখ গোমড়া করে ছিলেন, আজ কি সাজেকের রূপ দেখে ফিদা??? মূখে স্বীকার না করলেও আপু সত্যি সত্যিই সারপ্রাইজড হয়েছিলেন বলা বাহুল্য।

এদিকে বাসায় ফিরে আম্মুকে যখন মেঘের উপর সূর্যের আলোকছটা দেখাচ্ছিলাম, পেছন থেকে ছোটভাই বলে উঠে “ঐগুলা এডিট করা যায় ভাইয়া”
😜

যেভাবে যাবেনঃ ঢাকা/চিটাগাং থেকে শান্তি পরিবহণ, সৌদিয়া, ঈগল, এস আলমে খাগড়াছড়ি বাসস্ট্যান্ড। খাগড়াছড়ি থেকে চান্দের গাড়ি/জীপ, অটোরিক্সা রিজার্ভে সাজেক ভ্যালি। ভাড়া ৬-১১হাজার।

নোটঃ

*সাজেক নারী ও শিশুবান্ধব ট্যুরিস্ট স্পট। ফ্যামিলি ট্যুরে কোন অসুবিধা নেই।

*সাজেকে পানির খুব স্বল্পতা। চেষ্টা করবেন খাওয়ার পানি খাগড়াছড়ি থেকে নিয়ে আসতে। হোটেলে ব্যবহার্য পানি খরচে মিতব্যয়ী হোন।

*বিস্কুট/চিপ্সের প্যাকেট, খালি বোতল, সিগারেটের ফুটকি যেখানে সেখানে ফেলবেননা।

*স্থানীয়দের সাথে অভদ্র আচরণ করবেননা। এক ভাইকে দেখলাম আদিবাসী হোটেল বয়কে ম্যানার শেখাচ্ছেন খুব কদর্য ভাষায়।

*অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে জীপের ছাদের উঠবেননা।

*নিরাপত্তাবাহিনীর সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ করা থেকে বিরত থাকুন।

পরিশেষে সকলের সুস্বাস্থ্য ও নিরাপদ ভ্রমন কামনা করি।

Post Copied From:Junayed M. Rayan‎>Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment