সান্দাকফু-ফালুট ট্রেকিং ফিরিস্তি ভ্রমন

গত ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমরা ১৮ জন গিয়েছিলাম সান্দাকফু ফালুট ট্রেকিংয়ে। আমাদের জন প্রতি খরচ হয়েছিল ১৪৪০০ করে। মোট ৬ দিনের ট্রিপ ছিল।
আমরা নভেম্বরের ৩০ তারিখে টুমলিং থেকে ট্রেকিং শুরু করেছিলাম এবং ডিসেম্বরের ৫ তারিখে শ্রীখোলা এসে আমাদের ট্রেকিং শেষ করি। আমরা মোট ৬৩ কিলোমিটার পথ হেটেছিলাম।

প্রথম দিন আমরা চেংড়াবান্ধা থেকে জিপে করে মানেভাঞ্জন চলে যাই। পথে শিলিগুড়িতে লেট লাঞ্চ ছিল। আমরা সকাল এগারোটার দিকে যাত্রা শুরু করে শিলিগুড়ি লাঞ্চ ব্রেকসহ মানেভাঞ্জনে গিয়ে পৌছাই সন্ধ্যা সাতটার দিকে। তখন তাপমাত্রা ছিল ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশে পাশে। চেংড়াবন্ধা থেকে আমাদের মানেভাঞ্জন পর্যন্ত ৮ সিটের টাটা সুমো জীপের ভাড়া নিয়েছিল ২৫০০ রুপি। আর মানে ভাঞ্জনের হোটেল ভাড়া ছিল জন প্রতি ৩০০/৪০০ রুপি।

পথে শিলিগুড়িতে আমরা লাঞ্চ করেছিলাম জনপ্রতি ২৫০ রুপ করে।
মানে ভাঞ্জনে দোকানপাট সবই আছে। ফার্মেসী, প্রসাধনী, চকলেট থেকে শুরু করে আপনি শীতের ভারী কাপড় চোপর সবই পাবেন এবং দাম রিজেনেবল। তবে রাত আটটার পর সব বন্ধ হয়ে যায়। মানেভাঞ্জন থেকেই আপনাকে সিংগালিলা ন্যাশনাল পার্ক অর্থাৎ সান্দাকফু ফালুট যাওয়ার পারমিশান নিতে হবে। পারমিশান নিতে অবশ্যই আপনাকে মূল পাসপোর্ট এবং সাথে করে একটি ফটোকপি নিয়ে যেতে হবে। সময় লাগবে দুই থেকে তিনমিনিট। কোনো টাকা পয়সা লাগবে না। তবে পরবর্তীতে ২০০ রুপি এন্ট্রি ফি লাগবে রেঞ্জের ভিতরে প্রবেশের সময়। ক্যামেরার জন্য লাগবে ১০০ রুপি।

মানেভাঞ্জনে একরাত থেকে আমরা পরদিন সকালে অন্য একটা ল্যান্ডরোভার জীপ নিয়ে টুমলিং পর্যন্ত যাই। ভাড়া পড়ে জীপ প্রতি ১২০০ রুপি। বসতে পারবেন ৮ জন।
টুমলিং থেকে আমাদের ট্রেকিং শুরু হয়। তবে টুমলিং যেতে পথেই ওয়েদার ভালো থাকলে আপনি কাঞ্চনজংঘা রেঞ্জ দেখতে পাবেন পরিস্কার।
বলে রাখা ভালো যে, সিংগালিলা ন্যাশনাল পার্কের রেঞ্জে ঢুকতে হলে আপনাকে অবশ্যই গাইড নিতে হবে। না হলে পারমিশানই পাবেন না। গাইড খরচ একদিনের জন্য একজন গাইডকে দিতে হবে ১২০০ রুপি।

আমরা টুমলিং থেকে ট্রেকিং করে কালাপোখারি গিয়ে পৌছি সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ। শুরু করেছিলাম সকাল এগারোটার দিকে। পথ ছিল মোট ১৪ কিলোমিটার। কালাপোখারিতে রাতে তাপমাত্রা ছিল ৬/৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

রাতে কালাপোখারি যে হোটেলে ছিলাম সেখানে মূলত একরুমে ছয় থেকে আটজন থাকা যায়। মাথা পিছু ২০০/২৫০ রুপি পড়বে পার নাইট। খাবার ওদেরই কান্টিনে খেতে হবে। দাম পড়বে ১৫০ থেকে ২৫০ রুপি। খাবারের মান ভালো।

পরদিন আমরা ট্রেকিং শুরু করেছিলাম সকাল সাড়ে নয়টার দিকে। কালাপোখারি থেকে সান্দাকফু। পথ ছিল সাড়ে ছয় কিলোমিটারের মত। গিয়ে পৌছাই দুপুর একটা নাগাদ। পথে হালকা পাতলা চা নাস্তা করার অপশন আছে। ভারি কিছু খেতে চাইলে গাইডকে দিয়ে আগে থেকে ফোন করে রাখতে বললে সে ব্যবস্থা করে রাখে।
সান্দাকফু কালাপোখারি থেকে উন্নত। মূলত এটাই হচ্ছে পশ্চিম বঙ্গের সব থেকে উচু পর্বত। যার উচ্চতা ১১৯৪১ ফিট। ওয়েদার ভালো থাকলে এখান থেকে আপনি পুরো এভারেস্ট, কাঞ্চনজংঘা, থ্রি সিস্টার্সসহ বেশ কিছু পর্বত শ্রেণীর রেঞ্জ একসাথে ৩৬০ ডিগ্রির প্যানারোমিক ভিউতে দেখতে পারবেন। স্লিপিং বুদ্ধার অস্তিত্ব আপনি এখান থেকেই বুঝতে পারবেন।

সান্দাকফু ভালো মানের হোটেল রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এখানে থাকার জন্য জন প্রতি ২৫০/৫০০ রুপি খরচ পড়বে। খাওয়ার জন্য পড়বে ২০০/২৫০ রুপি। রাতে সান্দাকফুর তাপমাত্রা ছিল ৪/২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

পরদিন আমরা সান্দাকফু থেকে ফালুটের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি সকাল আটটার দিকে। মোট ২১ কিলোমিটারের ট্রেকিং। ফালুট গিয়ে পৌছাই সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ। তাপমাত্র ছিল মাইনাস ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ওয়েদার খারাপ থাকার কারণে আমরা ফালুটে পরদিন সকালে কিছুই দেখতে পাইনি। অথচ কাঞ্চনজংঘা রেঞ্জ দেখার জন্য এটাই হচ্ছে আদর্শ জায়গা। মাত্র ১১ কিলোমিটার দূরেই যার অবস্থান।

তবে সান্দাকফু থেকে ফালুটের ২১ কিলোমিটার পথ ট্রেকিং করে যাবার সময় আপনার মন ভরে যাবে পাহাড়ী সব ভ্যালীর দৃশ্য দেখে দেখে। অসাধারণ সেই দৃশ্য।
ফালুটে মাত্র দুইটি কটেজ রয়েছে থাকার জন্য। একটি সরকারী এবং একটি বেসরকারী। যেখানে আগে থেকে বুকিং করে যাওয়াই ভালো। কোনো কারণে যদি সিট না পান তবে রাতে থাকা নিয়ে বিশাল ঝামেলায় পড়তে হবে। থাকা বাবদ জন প্রতি 250/300 রুপি ধরে রাখতে পারেন। আর খাওয়া বাবদ 200/250 রুপি।
পরদিন আমরা ফালুট থেকে চলে যাই গোরখে। ১৫ কিলোমিটার ট্রেকিং ছিল এবং সম্পূর্ণটাই ছিল কেবল পাহাড়ী খাড়া বেয়ে নিচে নামা। পাহাড়ে ওঠার চেয়ে যে নামা কঠিন তা আপনি এইসময় বুঝতে পারবেন।

এই পুরো ট্রেকিংয়ে আপনার সব থেকে ভালো লাগার জায়গা হতে পারে এই গোর্খে ভ্যালী।। একদম ছবির মত সুন্দর। চারদিকে উচু সবুজ পর্বতে ঘেরা এই গোর্খে ভ্যালীকে দেখে মনে হবে আপনি যে ফার্মারস ল্যান্ডের ভিডিও গেম খেলেছিলেন এটা যেন এখান থেকেই থিম নিয়ে বানানো।
এখানে রাতে থাকতে পারেন। আমরা বিকাল নাগাদ এখানে পৌছে একটা সুদৃশ্য কটেজে উঠেছিলাম। রুমে ৪ জন করে ছিলাম। ভাড়া জনপ্রতি ৪০০ রুপির মত পড়েছিল। খাবারের জন্য দিয়েছিলাম প্রতি বেলা জন প্রতি ২০০/২৫০ রুপি।

এখান থেকে পরদিন আমরা চলে যাই শ্রীখোলা। ট্রেকিং ছিল ১৪ কিলোমিটার। শ্রীখোলা পৌছি আমরা বিকাল নাগাদ। ওখানে আমাদের আগে থেকে ২০০০ রুপি করে ঠিক করে রাখা টয়োটা সুমো জীপে করে চলে যাই ডিরেক্ট মানেভাঞ্জন। পথে এক জায়গায় লেট লাঞ্চ করে নিলাম। মূল্য জন প্রতি ২৫০ রুপি।
ভানেভাঞ্জনে আমরা ওই রাত আগের সেই হোটেলেই থেকে পরদিন সকালে রওনা হয়ে দুপুর নাগাদ বর্ডার পার হই। এরপর কিছু সময় বিশ্রাম করে বিকালের গাড়িতে ঢাকা ব্যাক করি।

এই ছিল আমাদের সান্দাকফু ফালুট ট্রেকিংয়ের পুরো প্ল্যান।
এই ট্রিপে আমাদের ভিতর থেকে একজন ইমার্জেন্সি কাজ পড়ে যাওয়ায় সান্দাকফু থেকে একাই ঢাকা ব্যাক করেছিল। এবং একজন উচ্চতাজনিত কারণে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। একজন সান্দাকফু পৌছে রাতে বমি করেছিল। এছাড়া সবাই ফিট ছিল।
…………………….
সতর্কতাঃ সান্দাকফু থেকে ফালুট পুরো রাস্তাই আপনি গাড়িতে যেতে পারবেন। রাস্তা প্রচন্ড খারাপ হবে। বড় বড় পাথর বিছানো রাস্তা দিয়ে ল্যান্ড রোভার পুরনো ধাচের গাড়িগুলো যেতে আপনার কোমড়সহ সাড়া শরীর ব্যাথা হয়ে যেতে পারে। আর যদি ট্রেকিং করে যেতে চান, তবে আপনার শারিরিক ফিটনেসের উপর অবশ্যই আপনার কনফিডেন্ট থাকতে হবে শতভাগ। মানসিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়লে এই ট্রেকিং আপনার জন্য বিভিষিকাময় হয়ে উঠতে পারে। প্রয়োজনীয় শীতের কাপড় অবশ্যই নিতে হবে যদি শীতকালে যান। তবে এখানে বর্ষাকালে না যাওয়াই উত্তম। তখন প্রচুর বৃষ্টিপাথের কারণে সব ক্যানসেল করা লাগতে পারে।
প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র অবশ্যই সাথে নিতে হবে। সেই সাথে নিতে হবে প্রচুর এনার্জেটিক শুকনা খাবার।

source:  Rajib Ferdous <Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment