সোনালী প্রাসাদ ভ্রমণ গল্প
ফুলেল পথ পেরিয়ে যখন মাইশুর প্যালেসের গেটের সামনে গিয়ে পৌছালাম, তখন সেখানে বেজায় ভীড়। স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে কিশোর, তরুন, যুবক, মধ্যবয়সী এমনকি বুড়োদের জমজমাট আয়োজন। সবাই যে কেন মাইশুর প্যালেস আসতে চায় সেটা কিছুটা বোঝা যাচ্ছিল। নিশ্চই এমন কিছু যা সবাইকে এখানে আসতে বাধ্য করে। ঠিক মনে নেই, খুব সম্ভবত ২০ বা ৫০ রুপি টিকেট কেটে ঢুকতে হয়েছিল। যাক তবে একটা লখ্য তো পুরন হবে অবশেষে। ঘুরে ঘুরে দেখতে পারবো ইতিহাসের সেই টিপু সলতানের স্মৃতি বিজড়িত কতকিছু।
মুল যে প্রবেশ পথ সেখানে ঢোকার আগে সবাইকে জুতা খুলে, ১০ রুপির বিনিময়ে জুতা রেখে যেতে হয়। আমি আলাদা করে আবার এই ১০ রুপি খরচের মধ্যে নেই, যে কারনে জুতা খুলে পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে নিজের ব্যাকপ্যাকের মধ্যেই ঢুকিয়ে দিলাম। তারপর পিঠে নিয়েই ঢুকে গেলাম প্যালেসের ভিতরে। কিন্তু প্রথমে ভিতরে ঢুকেই আমি চুড়ান্ত রকমের হতাশ হয়ে গেলাম। কারন আমার ধারনায় ছিল যেহেতু রেড ফোরটে ঢুকতেই সম্রাটের সিংহাসন দেখা যায়, দেখা যায় সম্রাটের আরো নানা রকম কিছু, এখানেও তেমনই হবে ধরে নিয়েছিলাম।
কিন্তু হায়, এ আমি কোথায় চলে এলাম? এটা তো টিপু সুলতানের সাথে সম্পর্কিত কোন প্রাসাদ বা স্থাপনা নয়, তাহলে এ আমি কোথায় এলাম? আমি কি তবে ভুল যায়গায় চলে এলাম হেটে হেটে? এমনিতেই তিন ঘণ্টার ট্রেন লেট, তার উপর যদি ভুল জায়গায় চলে এসে থাকি তাহলে তো পুরোটাই ভেস্তে গেল বোধয়! কিন্তু সেই মুহূর্তে আর কিছুই করার নেই, যে পথ দিয়ে প্রবেশ করেছি সেদিকে ফিরে যাওয়ার কোন উপায় নেই দেখে সামনের দিকেই এগোতে লাগলাম সবার সাথে।
নানা রকম অস্রে সজ্জিত আঙিনা, কামান, হোলা বারুদ, প্রাচিন কালের যুদ্ধের নানা রকম কিছু দেখে প্রাসাদের আঙিনা পেরিয়ে মুল ভবনে ঢুকতেই একটু আগের সকল আফসোস দুর হয়ে গেল, দেখে এক অপূর্ব সোনালি, রুপালি বিশাল প্রাসাদের অতিথিশালা ও রংগমঞ্চ। মেঝে থেকে যার ছাদ পাঁচ থেকে ছয় তলা ভবনের সমান উচু। চারপাশে বিশাল বিশাল পিলারের নান্দনিক সাজে সেজে দাড়িয়ে থাকা। যেখানে দুনিয়ার সব রঙ যেন তার বর্ণীলতা বিলিয়ে যাচ্ছে অবিরত।
পুরো প্রাসাদেই সোনালি রঙে রেঙে ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে দিনের আলোর রোশনাইয়ে। আর সেই সোনালী-হলুদের মাঝেই রয়েছে আরো যে কত রকমের রঙের মিশেল বোঝানো মুশকিল। নীল, সবুজ, লাল, গোলাপী, কমলা, মেরুন, ধূসরসহ সব রকমের রঙ আর সব রঙের মিশেল। সেই সাথে ছিল দিনের ঝলমলে আলোর অবিরত বিকিরণ। প্রাসাদের উপরের কাঁচের ছাদ থেকে ভিতরে দিনের আলো পরে সকল কিছু যেন তার রুপের বিচ্ছুরণ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিল।
এই জায়গার যেখানেই তাকাই, সেখানেই যেন চোখ আটকে যায়, আর অন্য কোনদিকে চোখ সরাতে ইচ্ছা হয়না। প্রতিটি কোন, দেয়াল, বাঁক, মেঝে, পিলার, ছাদ, বারান্দা, ঝাড়বাতি, আলোর ঝলকানী, সবকিছুতেই কেমন যেন একটা মাদকতা ছিল। একদিকে তাকালে সেদিকেই তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা হয়। অন্যদিকে তাকালে তখন সেদিকেই। প্রতিটা যায়গা, প্রতিটা কোণ, প্রতিটা ইঞ্চিতেই কি যেন মায়া, কিসের যেন টান, কি একটা মাদকতায় যেন আটকে ছিলাম অনেক অনেক সময়।
আমি থমকে দাড়িয়েই ছিলাম ঠায়। হুট করে আসা একদল ব্যাস্ত মানুষের ঢল আমাকে সরিয়ে নিয়ে গেল সেখান থেকে। অথচ ইচ্ছা ছিল অনেক অনেকটা সময় সেখানে দাড়িয়ে, দাড়িয়েই থাকি। ভাবছিলাম সেই অত অত বছর আগে এমন অপরুপ কিছু কেউ কিভাবে ভাবলেন, কেন তৈরি করেছিলেন, কি মানসিকতা ছিল তাদের। কতটা বিলাসী আর সৌন্দর্য সচেতন ছিলেন তারা। আমার এইসব ভাবনায় ছেদ ঘটালো একঢল মানুষের চলে আসা।
সেখান থেকে মানুষের স্রোতের সাথে বেরিয়ে উপরের দিকে উঠে গেলাম। বেজায় ভীড় ছিল সেই উপরের তলায়ও। পুরনো নানা রকম কিছু কাঁচের বেড়াজালের ভিতরে। সবাই সেসবের ছবি তোলায় ভীষণ ব্যাস্ত। সেখানে দাড়ানোর ও কোন উপায় না দেখে সিড়ি দিয়ে পেরিয়ে গেলাম সেই সিড়ি আর বেলকোনি।
এবার গিয়ে পৌছালাম আগের পরিয়ে আসা বিশাল প্রাসাদের একদম অন্দরের মধ্যে। এখানে প্রাসাদ যেন পুরো সোনালী সেজে আছে। চারদিকে শুধু সোনালি আলোর ঝলকানি, যেন সোনায় মোড়ানো সবকিছু। আমি আবারো থমকে দাড়িয়ে গেলাম, বলা যায় বাধ্যই হলাম। দেখে অন্দরের এক অপরুপ রুপ। যেন নতুন কোন বাসর সাজিয়ে রেখেছে কেউ, কোন মহারাজের জন্য। এবার আমি ছবি তুলতে লাগলাম ইচ্ছামত। মনের সাধ মিটিয়ে। এর আগে আমি কোন অন্দরের এমন সাজ, এমন আলো, এমন সোনালি সবকিছু দেখিনি। এমন যে কোনকিছু হতে পারে সেটাই কোনদিন ভাবিনি। আমি মুগ্ধ হয়ে শুধু তাকিয়েই ছিলাম অনন্ত সময়।
অন্দরের প্রতিটি জানালা, প্রতিটি পাথর, দেয়াল, আলো বিকিরণের পথ, বেলকোনি, ঝুলে থাকা ঝাড়বাতি, লাল-নীল-হলুদ-সবুজ আর বেগুনি আলোর রোশনায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। যাবে যে কারো। তবুও তাকিয়ে থাকি, ছবি তুলি, অবাক হই, ফিরে যাওয়াক কালে ফিরে ফিরে তাকাই। প্রাচিন কাঠের সিড়ি বেয়ে বেয়ে নিচে নেমে গেলাম মাইশুর প্যালেসের। অবাক করা মুগ্ধ কিছু সময় কেটে গেল খুব অল্প অনায়াসেই।
বাইরে বের হতেই আমাকে একটা না পাওয়া, একটা সুক্ষ আক্ষেপ যেন ঘিরে ধরলো প্রবলভাবে। আরে আমি তো টিপু সুলতানের প্রাসাদ দেখতে চেয়েছিলাম। এটা যদি সেটা না হয়, তবে সেটা কোথায়? মন আমার অস্থির হল, প্রাণ আমার চঞ্চল হল খুঁজে পেতে টিপু সুলতান, তার প্রাসাদ, তার ইতিহাস আর তাকে।
যদি ইতিহাস জানতে চান, তবে আমার গল্প আপনার জন্য নয়। আমি ইতিহাস লিখতে পছন্দ করিনা, কারন ইতিহাস জানতে চাইলে গুগল আছে, উইকি আছে। আমি শুধু কোন যায়গা আমার কেমন লাগলো, কি অনুভূতি হল, সেইসব লিখতেই পছন্দ করি। এছাড়াও ইতিহাস জানার আরও অনেক উপায় আছে। তাই আমার কোন লেখায় ইতিহাস খুজলে হতাশ হতে হবে।
বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, আমি যখন কোথাও যাই, সেই যায়গা আর তার চারপাশটাকে নিজের একান্ত আপন বলেই মনে করি। তাই নিজের কোন কিছু কি নোংরা করে ধংস করতে পারি? পারিনা। তাই কখনো কোথাও আমি কোন রকম ময়লা ফেলিনা। সেগুলো ব্যাগের পকেটে রেখে দিয়ে উপযুক্ত যায়গা ফেলে সেখানেই ফেলি। আশা করছি আপনিও এমনটা করবেন। ধন্যবাদ।