স্কাই ওয়াকের গোধূলি সন্ধ্যা

কদম শেষ, শেষ মুহূর্তে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েছিলাম পেলিং এর স্কাই ওয়াকের প্রবেশদ্বার দিয়ে। আমিই একদম শেষ ব্যাক্তি যে ঠিক ৫ টায় ভিতরে ঢুকেছে। যাই হোক, বেশ বড়সড় একটা রঙিন ভবন আর তার বিশাল গেট পেরিয়ে গেলেই ধাপহীন সিঁড়ি এঁকেবেঁকে উঠে গেছে পাহাড়ের উপরে বানানো একটা বিসৃত ছাঁদের মত প্রসস্থ সমতল যায়গা। যেটাকে পাহাড়ের একটা বিশাল আঙিনা বা উঠোন বললেও ভুল বলা হবেনা। যে বিসৃত উঠোনে নানা রকমের মানুষের জটলা লেগে আছে। কেউ নানা রকম ভঙ্গীতে ছবি তুলছে, কেউ কেউ হেটে হেটে ক্লান্ত হয়ে সবাই মিলে গল্প করছে আর অনেককেই দেখলাম পিতলের ধর্মীয় চাকার মত কিছু উপাদানে মনোযোগী হতে।

সেদিকেই প্রথমে চোখ চলে গেল, যার সাথেই ছোট্ট গেট দিয়ে জুতা খুলে প্রবেশ করলেই স্বচ্ছ কাঁচের ওয়াকওয়ে। যেটা ততক্ষণে প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। সামনে একটা দড়ি টাঙিয়ে রেখেছে। কেউ ছিলোনা বলে দড়ি টপকে ঢুকে গেলাম। বাহ, পাহাড় চুড়ার ঠাণ্ডা পরিবেশ আরও বেশী শীতল হয়ে পায়ের তলায় অনুভব করতে লাগলাম। দুইপাশে স্বচ্ছ কাঁচের কোমর সমান দেয়াল আর পায়ের নিচে ৫ থেকে ৬ ফুট প্রশস্ত কাঁচের পথে, পাহাড়ে গায়ে গায়ে স্টিলের চাকার মত তৈরি করে তার উপরে এই কাঁচের হাটার পথ। নিচে তাকালেই মনের মধ্যে একটা ভয় ভয় রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয় বলে সাধারণত নিচের দিকে না তাকিয়েই এক মাথা থেকে আর এক মাথা পর্যন্ত হেটে গেলাম।

খুব দ্রুত একমাথা থেকে আর একমাথা আর ছোট ছোট দুটি কাঁচের গলি হেটে নিলাম, পাছে সময় শেষ হয়ে গেছে বলে ডেকে পাঠালেও আফসোস একটু যেন কম হয়। মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম, শেষ মাথা থেকে ফেরার সময় ধীরে ধীরে ফিরবো আর ছবি তুলবো। তাতে করে আরও কিছুটা সময় পাওয়া যাবে। তখনো আমি কাঁচের পথের দুইপাশে ঠিকমত চোখ মেলে তাকাইনি বা সেই সময় পাইনি। শুধুমাত্র কাঁচের স্কাই ওয়াকে পূর্ণ মনোযোগ দেয়াতে।

একদম পাহাড়ের চূড়ায়, আঁকাবাঁকা এই কাঁচের পথ দারুণ রোমাঞ্চিত করেছিল শেষ বিকেল আর সন্ধ্যা নামার আগের গোধূলি বেলাটুকু। ধীরে ধীরে হেটে ছবি তুলতে তুলতে যখন ওয়াকওয়ের মাঝে এলাম তখন আমার চোখ গেল আরও একটা পাহাড়ের চূড়ায়, যেখানে বিশাল একটা বৌদ্ধ মূর্তি রয়েছে আকাশকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে! প্রায় ১০ মিনিটেও যেটা আমার চোখে পড়েনি। ভেবেছিলাম এই বুঝি ডেকে নেমে যেতে বলে। তেমন শঙ্কা নিয়েই ছবি তুলছিলাম। আর তখনই একটা সদ্য বিবাহিত (খুব সম্ভবত) জুটি সেই কাঁচের পাহাড়ি পথে এলো ক্যামেরা, ক্রু, ডরন নিয়ে তাদের বিশেষ ফটো সেশনে অংশ নিতে। যেটা আমাকে আরও কিছু সময় সেখানে থাকার সুযোগ করে দিয়েছিল।

কাঁচের পাহাড়ি সেতু থেকে চার পাশের যেদিকেই তাকানো যাক না কেন, শুধু পাহাড় আর পাহাড়ের সারি চোখে পরবে। ছোট, বড়, মাঝারি নানা রকমের পাহাড়ের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য বিমোহিত করবে পাহাড় প্রেমী না হলেও। ভাগ্যটা কিছুটা প্রসন্ন হলেও, খুব বেশী সুপ্রসন্ন ছিলোনা পুরো পেলিং সেসময় মেঘ আর কুয়াসার মান অভিমানের পর্ব চলছিল বলে। নইলে আকাশ পরিষ্কার থাকলে পুরো কাঞ্চনজঙ্ঘা আর হিলাময়ের বরফ মোড়ানো চূড়া গুলো দেখার এক অপার্থিব রূপ উপভোগ করতে পারতাম।

অমন পাহাড়ের চূড়ায়, এতো নিরাপদ আর নান্দনিক সেই সাথে দারুণ রোমাঞ্চকর কাঁচের ব্রিজে দাড়িয়ে বা বসে অথবা শুয়ে শুয়ে গোধূলি বেলার হিমালয়য়ের অপূর্ব প্রদর্শনী দেখার সুযোগ আছে এখানে সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। কারন সবাই একটু পর পর সেদিকে গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে দেখছিল, মেঘ সরে গিয়ে একটু কি উঁকি দিতে পারে অপার্থিব হিমালয়য়ের চিরন্তন সৌন্দর্যের এক ফোঁটা, যা দেখে সম্মোহিত হয়ে যাবে সেখানে উপস্থিত সবাই। কিন্তু না, মেঘের ঘনত্ব আর গাড় কুয়াসার অভিমান বেশ কঠিন ছিল বলে, কেউ একটু সরে যেতে চায়নি। তাই আর স্কাইওয়াক থেকে হিমালয় দেখার সুযোগ পাওয়া গেলনা। যেটা একটু হলেও আক্ষেপ জাগিয়েছিল।

কিন্তু তার পরেও, এখানে যেতে পারেছি, হাটতে, বসতে, আর নিজের মত করে বেশ কিছুটা সময় নিয়ে উপভোগ করতে পেরেছি সেটাই কম কিছু ছিলোনা, সেই শেষ বিকেলে। সেই দম্পতির ছবি তোলার সুযোগে আমি একটুখানি গড়িয়ে নিয়েছিলাম কাঁচের পথে, পাহাড়ের চূড়ায়, একটু ভয় আর বেশ কিছুটা রোমাঞ্চ নিয়ে। সেই সাথে ওদের অনুরোধ করে কয়েকটি ছবি তুলে নিয়েছিলাম। চুপচাপ বসেই ছিলাম যতক্ষণ না ডেকে তুলে দেয়, এই ভেবে যে এতো কষ্ট করে উঠেছি যেহেতু, রাতের আঁধার হয়ে গেলেও নেমে যেতে পারবো কিছুটা ঝুঁকি থাকলেও। ঠিক সেই সময়ই দেখি, সকালের সেই দাঁত না মাজা স্প্যানিশও সেখানে এসে হাজির।

আমরা দুজনের তখন বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলাম দুজনকে দেখে। কারন সেও একা আর আমিও। বোধয় দুজনেই মনে মনে ভাবছিলাম যাক যাওয়ার পথে, দীর্ঘ দেড় কিলোমিটার পাহাড়ি অরণ্যের পথ আর একা একা পাড়ি দেবার কিছুটা দুর্ধর্ষতা থেকে মুক্তি পাওয়া গেল। কারন সত্যি মনে মনে একটু যে শঙ্কা জাগেনি তাই নয়। অমন খাড়া অরণ্যর পাহাড়ি পথ একা একা ট্রেক করে নামতে হবে। সেটা কিছুটা অসস্থির হত অবশ্যই। বেশ গাঁ ছমছমে একটা পথে পেরিয়েছিলাম সেই দিনের আলোতেই, মাঝে মাঝে আঁধার হয়ে গিয়েছিল, সন্ধ্যার পরে সেটা আরও ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে যাবে কোন সন্দেহ নেই তাই। আরও ছিলোনা আকাশে কোন চাঁদ, তারা বা কাছে পিঠে কোন আলোকবর্তিকা।

অবশেষে আরও কিছুটা সময়, গোধূলি শেষে, সন্ধ্যা নামিয়ে, ঝলমলে সেই পাহাড়ের চূড়ায় কাঁচের সেতুতে আলো জলে উঠে একটা ভিন্ন রকম আবেশ তৈরি হয়েছিল পেলিং এর স্কাইওয়াকের সবটুকু জুড়ে। তাই যতটা সময় সেখানে ততটা সময়ই সেখানে কাটিয়েছিলাম নানা রকম মানুষ আর তাদের নানা রকম পাগলামি দেখে। কারন রুমে ফিরেই তো অখণ্ড অবসর কাটাতে পারবো জানি। তাই একটু রাত হয়ে গেলেও তেমন কোন ক্ষতি নেই, যেমনই হোক সঙ্গী তো একজন পাচ্ছিই সাথে যেতে, রোমাঞ্চকর পাহাড়ি অরণ্যের অন্ধকারে।

দয়াকরে আমরা কেউ যেন প্রকৃতিকে নোংরা না করি.

Source: Sajol Zahid‎< Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment