স্বপ্নের ভ্রমন আমিয়াখুম ও নাফাখুম (বান্দরবন) যেভাবে যাবেন

কোন জোসনা ভরা রাতে চাদের আলোয় আমিয়াখুমের সৌন্দর্যে ডুবে যাবো কিংবা খুব ভোরে চোখ মেলেই মেঘে ঢাকা দেবতা পাহাড়ের নিচে আমিয়াখুমের ভয়ংকর শব্দে বয়ে চলা দেখে মুগ্ধ হব কিন্তু প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা থাকায় এবার তা আর হলোনা। হুট করেই সিদ্ধান্ত নিলাম বিজয়দিবসের ছুটিকে কাজে লাগিয়ে এই সুযোগে আমিয়াখুমের আহবানে সাড়া দিয়ে আসি। চট্টগ্রাম থেকে রওনা দিয়ে সকালে বান্দরবন গিয়ে ঢাকা থেকে আসা আরো সাথীসহ ৩০জনের বিশাল টিম সকালের নাস্তা সেরে চান্দের গাড়িতে রওনা হলাম উদ্দেশ্য থানচি। আকাবাকা পাহাড়ি পথ পেড়িয়ে প্রায় ৩ঘন্টা পর পৌছালাম থানচি আর সেখানে আমাদের জন্য আগে থেকেই ওৎ পেতেছিলো আমাদের এই ট্রিপের গাইড হাসান। তারপর থানায় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে লাঞ্চের প্যাকেট নিয়ে চলে গেলাম ঘাটে। যদিও পানি কম তবুও সেফটির জন্য লাইফ জ্যাকেট পড়ে বোটে উঠে বসলাম উদ্দেশ্য পদ্মঝিরির মুখ। দুপাশের নয়ানাভিরাম দৃশ্য দেখতে দেখতে লাঞ্চের প্যাকেট খুলে পেট পুজা করে নিলাম আহা কি শান্তি। প্রায় ৪৫মিনিট পর পদ্মঝিরির মুখে নামলাম ততক্ষনে দিনের আলো প্রায় নিভে এসেছে।

সন্ধ্যা নামার ক্ষণেই রওনা হলাম অমানুষিক কষ্টের পথে থুইসাপাড়ার উদ্দেশ্যে। আগের দুবার ৮ঘন্টা লেগেছিলো পৌঁছাতে তাই এবারো সেরকম মানুষিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম ভেবেছিলাম থুইসাপাড়া পৌঁছাতে রাত ১২/১টা বাজবে কিন্তু টীমের হাটার স্পীড ভালো থাকায় আর তুলনামূলক রেস্ট কম নিয়ে সময় নষ্ট না করায় ৬ঘন্টাতেই থুইসাপাড়া পৌঁছে গেলাম যদিও রাতের আধারে পথচলা বেশ কষ্টের আর যদিহয় এরকম দূর্গম পাহাড়ি পথ তবেতো কথাই নেই। এই ট্রেকিং এ টর্চলাইট অবশ্যই খুবই দরকারী। থুইসাপাড়া পৌছে স্বস্তির নিশ্বাস সবাই বেশ ক্লান্ত আর বিদ্ধস্ত। আমাদের জন্য নির্ধারিত ঘরে ব্যাগপত্র রেখে কনকনে ঠান্ডা জলে গোসল সেরে নিলাম তারপর চলে গেলাম পাহাড়ি ভোজে আজকের আয়োজন আলুভর্তা ডাল আর পাহাড়ি মোরগ। খেয়েই একটা নাপা এক্সট্রা মেরে দিলাম কারণ সারা শরীর ব্যাথা আর এই ব্যাথা সকাল পর্যন্ত থাকলে কাল আমিয়াখুম যাওয়া হবেনা।

ভোর ৫ঃ৩০ এ এলার্মে ঘুম ভাংগার কথা থাকলেও তা হলনা পাশেরজনের ডাকাডাকিতে অবশেষে ঘুম ভেঙে উঠে চটপট ব্রাশ করে রেডি হয়ে চলে গেলাম ব্রেকফাস্ট রেডি আজ মেন্যু খিচুড়ি আর ডিমভাজি। খেয়ে আর বিলম্ব না করে কুয়াশা ঘেরা পথে রওনা হলাম দেবতা পাহাড়ের উদ্দেশ্যে আজ গন্তব্য স্বপ্নের আমিয়াখুম। প্রায় দেড়ঘন্টা পর অনেকটা হেসেখেলেই পৌঁছে গেলাম দেবতা পাহাড়ের চূড়ায়। এবার নামার পালা সেই ভয়ংকর খাড়া দেবতা পাহাড়। যতটা ভয় দেখায় মানুষ আসলে ততটা কঠিন না একটু সাবধান থাকলে তার আস্তে ধীরে সময় নিয়ে নামলে খুব কঠিন কিছুনা এই দেবতা পাহাড় ডিঙ্গানো। আমরা ১ঘন্টা ১৫মিনিটেই নিচে নেমে আসি। তারপর আমিয়াখুমের দিকে না গিয়ে ভেলা নিয়ে চলে যাই নাইক্ষং মুখে। যদিও অনেকেই এখানে ভেলায় চড়া হয় বলে একেই ভেলাখুম বলে বিভ্রান্ত করে কিন্তু এইবার আমি নিয়ত করেই আসছিলাম অরিজিনাল ভেলাখুমে যাবোই। নাইক্ষং মুখে ভেলা থেকে নেমে আমি আমাদের টীমের এক ভাই আর আমাদের গাইড চললাম ভেলাখুমের দিকে। বিশাল বিশাল পাথর আর পিচ্ছিল এক ভয়ংকর সেপথ। কিন্তু এত সুন্দর যা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। কিছুদূর যেতেই একটি ক্যাসকেড ও একটি ঝর্ণার মোহনা এক অদ্ভুদ সৌন্দর্য তৈরি করেছে। ভেলাখুমে যাওয়ার পথ যতটা কঠিন ঠিক তারচেয়েও হাজারগুণ বেশি সুন্দর। প্রায় ৪৫মিনিট হেটে পৌঁছে গেলাম ভেলাখুমের মুখে কিন্তু কপাল খারাপ সেখানে কোন ভেলা না থাকায় গভীরে যাওয়া হলনা।

সেখানে বিশাল একটি অজগরের মাথা পরে থাকতে দেখে মনে ঘুরপাক খাচ্ছিলো এই বনে নাজানি আর কতকি আছে। এরপর সেখান থেকে শান্তনা পুরষ্কার দুটো গাছপাকা চালতা নিয়ে হাটা ধরলাম আমিয়াখুমের দিকে। আবার নাইক্ষং মুখ থেকে ভেলায় চড়ে আমিয়াখুম গেলাম। কিন্তু হায় সেখানে মনে হচ্ছিলো লাখো জনতার কোন সমাবেশ চলছে। এত ভীর মানুষ গিজগিজ করছিলো। তাই আর সেখানে বিলম্ব না করে টীমের আরো দুইভাই আর আমাদের পাড়াতো গাইড অং কে সাথে নিয়ে রওনা হলাম সাতভাই খুমের দিকে। ভেলা একটা বৈঠাও একটা তাই অনেক সময় লাগলো সাতভাইখুম পৌঁছাতে। সাতভাইখুম খুব নিস্তব্ধ একটা জায়গা চারদিকে শুনশান নীরবতা। দুপাশে খাড়া পাহাড় আর তার মাঝদিয়ে ভেলার ছলাত ছলাত শব্দ আর মাঝে পাখির ডাক এক অদ্ভুত ভালোলাগা ছুয়ে গেলো। সাতভাই খুমে ঝিরির পাশে কিছু ছবি তুলে আবার ভেলায় চেপে বসলাম কিন্তু এবার জলদি পৌঁছাতে হবে তাই সবাই হাতে বাশ নিয়ে উঠলাম দাড় বেয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কিন্তু এটাও খুব বেশি ফলপ্রসূ হলনা শেষে অং কে বললাম মাছ ধরার জন্য যে জাল বেধে রাখছে তার রশি ধরে টেনে টেনে এগিয়ে চলতে আর এই টেকনিকটা বেশ কাজে দিলো স্রোতের বিপরীতে হওয়া স্বত্ত্বেও প্রায় অর্ধেক সময়েই ফিরে এলাম আমিয়াখুম। ততক্ষনে আমাদের টিমের বাকি সবাই ফেরার পথ ধরেছে আমাদের গাইড হাসান আমাদের জন্য আমিয়াখুমে একা বসেছিলো। আমিয়াখুমে যেতেই ভালো লাগলো সেই লোকে লোকারণ্য আমিয়াখুম এখন পুরোই ফাকা।

গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে তার পাড়ে কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে বসে রইলাম। গাইডের তাড়ায় শেষে রওনা দিতেই হল ফেরার পালা। এবার মাত্র ৪৫মিনিটেই দেবতা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে এলাম। ক্ষুধায় পেট চো চো করছিলো কারন সকালে রওনা হওয়ার পর আর কিছুই খাওয়া হয়নি। চূড়ায় উঠে দেখি টিমের বাকিরা রেস্ট নিচ্ছে, কয়েকটা বিস্কুট খেয়ে ঘাসের উপর শুয়ে পড়লাম ১৫মিনিটের রেস্ট নিয়ে আবার হাটা শুরু। যখন পাড়ায় পৌঁছালাম তখন সন্ধ্যার আধার ঘনিয়ে এসেছে। পাড়ায় পানির স্বল্পতা থাকায় সেইরাতে আর গোসল করা হয়নি। ফ্রেশ হয়ে ড্রেস চেঞ্জ করেই খেতে চলে গেলাম ক্ষুধায় জান যায়যায় অবস্থা। কিন্তু রান্না শেষ হয়নি দেখে আড্ডা মেরে ক্ষুধা ভুলে থাকার বৃথা চেষ্টা করছিলাম। আমাদের টীমের এক ভাইয়ের মতে আমি নাকি এই ট্রিপে গাছেরটাও খাইছি তলারটাও খাইছি মানে সবচেয়ে বেশি স্পট কভার করছি অবশেষে খাবার এলো আমরা পাহাড়ি মোরগ দিয়ে যার যতটুকু সাধ্য খেলাম। খেয়ে বাকিরা বাশির সুর আর আড্ডায় মেতে থাকলেও আমার কাছে তখন ঘুমই স্বর্গসুখ।

পরদিন খুব ভোরে উঠে সবাই ব্যাগ গুছিয়ে রেডি হচ্ছে আজ আবার ট্রেকিং উদ্দেশ্য নাফাখুম। দ্রুত সবাই রেডি হয়ে খিচুড়ি আর ডিমভাজি মেরে দিয়ে হাটা শুরু করলাম। কিছুদূর যেতেই জলপাই গাছ পেয়ে টীমের সবার যে আগ্রাসী অবস্থা দেখলাম তাতে মনেহচ্ছিলো জলপাই আমাদের জাতীয় ফল অবশ্য আমার ব্যাগেও তখন দু দুটো পাকা চালতা থুইসাপাড়া থেকে নাফাখুম এই ট্রেইলটা অসম্ভব সুন্দর আর এত স্বচ্ছ পানি যে চারপাশের প্রকৃতি যেন পানিতে প্রতিফলিত হচ্ছে। ৩ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম নাফাখুম। আবার সেই লোকে লোকারণ্য অবস্থা। প্রিয় গাইড হারন ভাইয়ের সাথে দেখা হল কুশল বিনিময় শেষে কয়েকটা ছবি তুলে চলে গেলাম লাইফ জ্যাকেট খুজতে।

টীমের এক সাথী কেবল নাফাখুমে ঝাপ দিবে বলে এতদূর কষ্ট করে গিয়েছে। যদিও সাতার না জানা লোকদের জন্য ব্যাপারটা বেশ রিস্কি তবুও শখের তোলা ৮০টাকা। লাইফ জ্যাকেট এরেঞ্জ করে তাকে উপর থেকে ঝাপ দেওয়ার সুযোগ করে দিতে পেরে কিছুটা চাপমুক্ত হলাম। ঝাপাঝাপি শেষে আবার হাটা শুরু উদ্দেশ্য রেমাক্রি। প্রায় দেড়ঘন্টা হাটার পর রেমাক্রি পৌছাতেই সবাই নেমে পড়লো রেমাক্রি ঝিরিতে গা ভেজাতে। প্রায় ঘন্টাখানেক জলকেলী করে আবার বোটে উঠে পড়লাম এবার গন্তব্য তিন্দু বড়পাথর হয়ে থানচি। আবারো বোটে বসে লাঞ্চ অত:পর তিন্দুর বড় বড় দৈত্যাকার পাথরের মাঝদিয়ে একেবেকে বয়ে চলা। থানচি পৌঁছে আবারো চান্দের গাড়ি চড়ে বান্দরবনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। শীতে কাপতে কাপতে বান্দরবান পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খেয়ে আবার বাসে চড়ে রওনা হলাম এবার ঘরে ফেরার পালা। রাত ১২টায় চট্টগ্রাম নামার মধ্যদিয়ে শেষ হল ৩দিনের স্বপ্নময় ভ্রমন।

যাওয়ার উপায়ঃ দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে প্রথমে বান্দরবান যেতে হবে। সেখান থেকে চান্দের গাড়ি বা বাসে থানচি। সেখান থেকে গাইড নিয়ে থুইসাপাড়া।

থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাঃ থুইসাপাড়ায় আদিবাসীদের ঘরেই থাকতে হবে এবং খাওয়ার ব্যবস্থাও তারাই করবে। থাকা খাওয়া বাবদ থুইসাপাড়ায় জনপ্রতি খরচ হবে ৩০০-৩৫০টাকা। বার্বিকিউ করতে চাইলে গাইড সব এরেঞ্জ করে দিবে।

পরামর্শঃ

  • ট্রেকিং এ অবশ্যই ভালো গ্রিপওয়ালা জুতা নিয়ে যাবেন।
  • টর্চলাইট অবশ্যই নিবেন কারন পাহাড়ে রাতে এটা ছাড়া বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
  • ভোটার আইডি বা জন্মসনদের ফটোকপি অবশ্যই সাথে নিবেন, এটা ছাড়া আপনি কোনমতেই থানচি থেকে পার্মিশন পাবেন না।
  • ব্যাগ যথাসম্ভব হালকা নিবেন আর এইসময়ে গেলে অন্তত একটি শীতেএ পোষাক নিবেন।
  • গাইডের পরামর্শ বা লাইফ জ্যাকেট ছাড়া পানিতে নামবেন না।

অনুরোধঃ আপনার বহন করে নিয়ে যাওয়া কোন অপচনশীল দ্রব্য ফেলে আসবেন না। ময়লা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলবেন। মনে রাখবেন আপনি ঘুরতে যাচ্ছেন নোংরা করতে নয়।

Share:

Leave a Comment